দক্ষিণ এশিয়া
আফগানিস্তানে পরিবর্তন এবং বাংলাদেশে সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া
হারুন হাবীব
প্রকাশ: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ১২:০০ | আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ১৩:০৮
শুধু উপমহাদেশীয় দেশগুলোতে নয়, গোটা বিশ্বেই আফগানিস্তানের তালেবানি পুনরুত্থানকে বিশেষ তাৎপর্যময় ঘটনা হিসেবে দেখা হয়েছে। এদিকে গত ৭ সেপ্টেম্বর পানশির প্রতিরোধের পতনের পর অন্যতম প্রধান তালেবান নেতা এবং জাতিসংঘের কালো তালিকাভুক্ত মোল্লা মোহাম্মদ হাসান আখুন্দ বা আকুন্দজাদাকে প্রধান করে কাবুলের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়েছে। উপপ্রধানমন্ত্রী হয়েছেন তালেবানের সহপ্রতিষ্ঠাতা মোল্লা আব্দুল গনি বারাদার। দেশটিকে 'ইসলামিক আমিরাত'ও ঘোষণা করা হয়েছে। যেদিন সরকার গঠন করা হয়, সেদিনই কাবুলে দেশটির 'অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পাকিস্তানের হস্তক্ষেপ'-এর প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেছে কিছুসংখ্যক আফগান নারী। তালেবান সেখানে গুলিও চালিয়েছে। এর পরও বিক্ষোভ থেমে নেই। তবে তাৎপর্যময় বিষয়, অন্তর্বর্তী আফগান সরকারের গুরুত্বপূর্ণ স্বরাষ্ট্র্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব লাভ করেছেন শীর্ষ জঙ্গি নেতা সিরাজউদ্দিন হাক্কানি, যাকে ধরিয়ে দিতে আমেরিকা ৫০ লাখ ডলার পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। আরও এমন জনাকয়েক ব্যক্তি মন্ত্রিসভায় স্থান পেয়েছেন, যারা আন্তর্জাতিকভাবে শীর্ষ সন্ত্রাসী বলে চিহ্নিত। তালেবানের এ সরকারকে অবশ্য চীন, রাশিয়া ও পাকিস্তান ছাড়া বিশ্বের আর কেউই অভিনন্দন জানায়নি। আমেরিকা, ফ্রান্স, ব্রিটেনসহ পশ্চিমা বিশ্ব ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে।
তালেবান দাবি করেছিল, তারা আর আগের মতো নেই; সময়ের দাবিতে তারা বদলেছে। কিন্তু ১৫ আগস্ট কাবুল দখলের পর থেকে যা ঘটে চলেছে, তা থেকে এই বদলানোর তেমন নজির মিলছে না! নতুন সরকারের প্রধান মোল্লা হাসান আখুন্দ এরই মধ্যে কঠোর শরিয়াহ আইন বলবতের নির্দেশ দিয়েছেন। খবর আসছে, তালেবান যোদ্ধারা সংগীতশিল্পীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে অত্যাচার চালাচ্ছে। তারা দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় অংশের প্রখ্যাত লোকসংগীতশিল্পী ফাওয়াদ আন্দারাবিকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। প্রখ্যাত কবি ও ইতিহাসবিদ আব্দুল্লা আতিফি এবং জনপ্রিয় অভিনেতা নাজার মোহাম্মদকেও খুন করেছে তালেবান যোদ্ধারা।
তালেবান এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, ছেলে ও মেয়েরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একসঙ্গে বসতে পারবে না। পর্দা টানাতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো নারী সম্পূর্ণ মুখ না ঢেকে প্রবেশ করতে পারবে না। পুরুষরা নারী শিক্ষার্থী পড়াতে পারবে না। জানা গেছে, দেশটির ২৫০ জন নারী বিচারকের অনেকেই তালেবানের ক্ষমতালাভে ভীত হয়ে দেশ ছেড়েছেন। যারা পালাতে পারেননি তারা লুকিয়ে আছেন; পালানোর পথ খুঁজছেন।
অন্যদিকে, তালেবানরা তাদের হিংসার রাজনীতির বদল ঘটিয়েছে- এমনটাও ভাবা যাচ্ছে না। তাদের সাধারণ ক্ষমা কার্যকর হয়নি। ঘোর প্রদেশের এক অন্তঃসত্ত্বা নারী পুলিশকে তারা প্রকাশ্যে হত্যা করেছে। খবর বেরিয়েছে, বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি চালিয়ে 'গনিমতের মাল'-এর সন্ধান করা হচ্ছে। নারীরা আবারও মধ্যযুগীয় কঠোরতম দুঃশাসনে পিষ্ট হতে চলেছে। তালেবানবিরোধী অবস্থানের কারণে এরই মধ্যে দেশের সাবেক নারী গভর্নর শামস মাজহারকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। দেশের নারী ফুটবলাররা আতঙ্কিত। ভয়ংকর এ পরিস্থিতিতেও কাবুল ও হেরাতের রাস্তায় কয়েকশ নারী তাদের অধিকার রক্ষায় মিছিল করেছেন। বলা বাহুল্য, দেশটিতে মানবিক সংকট প্রবল হচ্ছে। অর্থাৎ তালেবান যতই বদলানোর কথা বলুক; তাদের মৌলিক অবস্থানের বদল ঘটেনি। যা ঘটেছে তা কৌশলগত।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তালেবানের বিজয়ে স্বয়ং আনন্দ প্রকাশ করেছেন। কট্টরপন্থি গোষ্ঠীগুলো তালেবান সরকারকে প্রকাশ্যে অভিনন্দিত করেছে। অবশ্য এসব প্রতিক্রিয়া অস্বাভাবিক নয়। কারণ পাকিস্তানের মাটিতে সাবেক সোভিয়েত দখলদারিত্ব ঠেকানোর উদ্দেশ্যে, আমেরিকার প্রত্যক্ষ মদদে যে তালেবানের জন্ম দেওয়া হয়েছিল, সে প্রক্রিয়ায় সরাসরি যুক্ত ছিল পাকিস্তানের সেনাবাহিনী।
ভারতের মাটিতেও এরই মধ্যে বিরূপ প্রভাব লক্ষ্য করা গেছে। অতিউৎসাহী ধর্মবাদীরা প্রকাশ্যে তালেবানের বিজয়কে স্বাগত জানিয়েছে। এমনকি 'অল ইন্ডিয়া মুসলিম পারসোনাল ল বোর্ড'-এর জনাকয়েক নেতাও তালেবানের বিজয়কে অভিনন্দিত করেছেন। এ নিয়ে সংশ্নিষ্ট মহলগুলোতে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। দেশটির অন্যতম শক্তিমান অভিনেতা নাসিরউদ্দিন শাহ এই অতিউৎসাহীদের উদ্দেশে সম্প্রতি একটি সাহসী বার্তা প্রচার করে ভারতীয় মুসলমানদের সতর্ক করেছেন এই বলে- তারা যেন না বুঝেশুনে বেশি আহদ্মাদিত না হন। কারণ, তালেবান উগ্র ধর্মতত্ত্ব যে বার্তা দেয়, তা আধুনিক সভ্যতার তত্ত্ব নয়। বলা বাহুল্য, কট্টর হিন্দুত্ববাদী শাসনের বহুবিধ তির্যক সমালোচনা এবং সীমাবদ্ধতার পরও সর্বভারতীয় রাজনীতিতে আজও বহুত্ববাদী সংস্কৃতি বিদ্যমান। সে বিবেচনায় তালেবান সমর্থকরা যদি দেশটিতে খুঁটি গাড়ার চেষ্টা করে, তাতে সামাজিক অস্থিরতাই কেবল বাড়বে না, বরং দেশটির গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি প্রভূত ক্ষতির সম্মুখীন হবে।
অনেক দূরের জনপদ হলেও আফগানিস্তান নানা কারণেই বাংলাদেশে আলোচিত। স্থানীয় যে জঙ্গিরা বাংলার মাটিতে একদিন 'তালেবানি বিপ্লব' সম্পন্ন করার খায়েশ দেখেছিল, এবারের তালেবান পুনরুত্থানে তারা নতুন আশায় বুক বাঁধবে। মনে রাখা উচিত, প্রথমবারের তালেবান পতনের পর এই আফগানফেরতরাই জেএমবি, হুজি ইত্যাদি জঙ্গিগোষ্ঠীর জন্ম দিয়েছিল। এরাই ধর্মীয় উগ্রবাদের পথে বাংলাদেশকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। অতএব, যে বাংলাদেশের ভিত্তি অসাম্প্রদায়িক জাতিসত্তা ও গণতান্ত্রিক চেতনা, সে রাষ্ট্রে আবারও তালেবানি তত্ত্ব আমদানির চেষ্টা হলে তা হবে বড় ক্ষতির কারণ। এ ক্ষতি কেবল রাজনৈতিক অঙ্গনেই সীমাবদ্ধ থাকবে না; একই সঙ্গে আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও সমাজ-প্রগতিকে বিঘ্নিত করবে। অতএব, সর্বাত্মক সতর্কতা প্রয়োজন।
মোট কথা, সাম্প্রতিক তালেবান পুনরুত্থান কেবল বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা ভারত নয়, গোটা উপমহাদেশের জন্যই একটি বড় সতর্কবার্তা। এর প্রধান কারণ তালেবানের নীতি মধ্যযুগীয়, যা মানুষের অর্জিত সভ্যতার পরিপন্থি।
দৃশ্যতই নতুন তালেবান তাদের একটি নীতির বদল ঘটিয়েছে। তারা আগেকার আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতা থেকে বেরিয়ে কয়েকটি দেশের সঙ্গে কৌশলগত সংযোগ স্থাপন করেছে। তালেবানের মুখপাত্র জাবিউল্লা মুজাহিদ প্রকাশ্যেই চীনকে তাদের প্রধান বন্ধু হিসেবে দাবি করেছেন। কাশ্মীর প্রশ্নে তালেবানের পুরোনো নীতির পরিবর্তন না ঘটলেও এরই মধ্যে ভারতের সঙ্গে তারা বৈঠকে করেছে। এ বৈঠকে ভারতের রাষ্ট্রদূত তালেবান প্রতিনিধির সামনে তার দেশের একটি 'ইচ্ছা তালিকা'ও পেশ করেছেন। সে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবের মূল সুর। যাতে বলা হয়েছে, তালেবান যেন আফগানিস্তানের মাটিকে কোনো রকম সন্ত্রাসী কাজে ব্যবহার করতে না দেয়; তারা যেন অন্য দেশে সন্ত্রাস রপ্তানি না করে; দেশত্যাগে ইচ্ছুকদের বাধা প্রদান না করে এবং নারী, শিশু ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার রক্ষা করে। এসব প্রস্তাব কতটা মান্যতা লাভ করবে, তা অবশ্য বলা যাবে না। লক্ষণীয়, নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্যের মধ্যে চীন ও রাশিয়া ওই প্রস্তাবে রাজি হয়নি।
অন্য একটি তাৎপর্যময় পরিবর্তনও দৃষ্টিতে পড়েছে পর্যবেক্ষকদের। তালেবানের বিজয়ের পর আল কায়দা এবং আইসিস বিশ্বব্যাপী জিহাদের ডাক দিয়ে 'সোমালিয়া, ইয়েমেন, চেচনিয়া থেকে চীনের শিনজিয়াং' পর্যন্ত তাদের 'জিহাদ' সম্প্রসারণের যে ডাক দিয়েছিল, অজ্ঞাত কারণে তার দ্রুত পরিবর্তন ঘটিয়েছে তারা। নতুন বিবৃতিতে 'চেচনিয়া ও শিনজিয়াং' বাদ পড়েছে। অন্তর্ভুক্ত হয়েছে 'কাশ্মীর'। এগুলো যথার্থই তাৎপর্যময় পরিবর্তন, যা কিছু দেশকে তৃপ্তি দিলেও বহুসংখ্যক দেশকে ভাবিয়ে তুলবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, তালেবানের বিজয়কে আমরা সার্বিক অর্থে আফগান গণমানুষের বিজয় বলতে পারি কিনা। সম্ভবত না। কারণ এ বিজয় নতুন অনিশ্চয়তার পথ তৈরি করেছে; কেবল আফগানিস্তানে নয়, গোটা উপমহাদেশে। বিশেষ করে কট্টরপন্থি হাক্কানি গোষ্ঠীর ক্রমাগত শক্তি সঞ্চয় পরিস্থিতিকে নাজুক করে তুলবে।
তালেবান মধ্যযুগীয় নীতি বন্ধ করে সুস্থ-স্বাভাবিক ধারায় ফিরে আসুক- এটিই সবার কাম্য। তবে এমন আশাবাদ সুদূর পরাহত বলেই মনে হয়। যে উগ্রবাদ তালেবানের ভিত্তি, তারই উত্তরাধিকার বহন করবে নতুন তালেবান। তবে আফগানিস্তানের ঘটনাপ্রবাহ থেকে মুখ ঘুরিয়ে নয়, চোখ-কান খোলা রেখে পরিস্থিতি অবলোকন করা সমীচীন। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির সাধারণ জনজীবনকে উপেক্ষা করা সংগত হবে না। দেশটির সামাজিক উন্নয়নে শান্তির সুযোগ বিকশিত করার প্রতিটি সুযোগ গ্রহণ করতে হবে। এসব করা গেলেই হয়তো জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ ও কট্টরপন্থা রপ্তানির আশঙ্কা স্তিমিত হওয়ার পথ প্রশস্ত হবে।
নিশ্চিত করেই বলা যায়, তালেবানের পুনরুত্থান বাংলাদেশসহ গোটা অঞ্চলে প্রভাব ফেলবে। সে প্রভাব ইতিবাচক হতে পারে না। অতএব, আখুন্দ সরকারকে স্বীকৃতির প্রশ্নে তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে বিরত থাকাই বাঞ্ছনীয়। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির ভিত্তি রচিত হয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এবং বাংলাদেশের অন্তর্নিহিত সমাজশক্তি তালেবান বিপ্লবের সমার্থক নয়।
মুক্তিযোদ্ধা, লেখক, গবেষক ও বিশ্নেষক
- বিষয় :
- দক্ষিণ এশিয়া
- হারুন হাবীব