মাধ্যমিক শিক্ষায় ঘুষ
তদন্ত করুন, ব্যবস্থা নিন

ফাইল ছবি
সম্পাদকীয়
প্রকাশ: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ১২:০০
দেশের মাধ্যমিক শিক্ষায় যেভাবে ঘুষের প্রাধান্য দেখা যাচ্ছে, তা একই সঙ্গে হতাশা ও লজ্জাজনক। বৃহস্পতিবার সমকালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বা টিআইবির গবেষণা সূত্রে প্রকাশ, দেশে মাধ্যমিক শিক্ষায় নিয়োগ, বদলি, এমপিওভুক্তি থেকে শুরু করে প্রায় সব কাজে পদে পদে অনিয়ম ও আর্থিক লেনদেন হয়। এমনকি এমপিওভুক্ত স্কুল-কলেজের অধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক ও সহকারী প্রধান শিক্ষক নিয়োগে সাড়ে তিন লাখ থেকে শুরু করে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। এ অর্থ দিতে হয় স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটিকে।
মাধ্যমিক শিক্ষার এ চিত্র অনেকটা 'ওপেন সিক্রেট'। দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষকরা অন্যায়ের শিকার হলেও এটি বন্ধ হয়নি। বস্তুত মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নের প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা এবং আইনি নানা ঘাটতির কারণে এ অনিয়ম চলে আসছে। আমরা জানি, মাধ্যমিক স্তরে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ বা এনটিআরসিএর মাধ্যমে মাধ্যমিক শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। এনটিআরসিএ প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক তথা তিন ধাপে পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষক বাছাই করে থাকে। তারপরও কেন এনটিআরসিএর সুপারিশ করা সহকারী শিক্ষকদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যোগদানের জন্য 'ঘুষ' দিতে হবে? এমপিওভুক্তির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া এবং প্রয়োজনীয় যোগ্যতা অর্জনের মাধ্যমেই একজন শিক্ষক এ সুবিধা পান। এখানেও অতিরিক্ত অর্থ দেওয়ার কোনো কারণই নেই। আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন ও নিরীক্ষার কাজে সংশ্নিষ্ট অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সব শিক্ষকের এক মাসের এমপিওর টাকা দেওয়ার অঘোষিত 'বিধান' কীভাবে অবধারিত হয়ে চলছে, সেটাও অবাক করা বিষয়। এভাবে নিয়মের অনেক কিছুতেই মাধ্যমিক শিক্ষায় ঘুষ দেওয়া প্রচলিত হয়ে গেছে।
আমরা জানি, প্রাথমিক পর্যায়ের অধিকাংশ বিদ্যালয় সরকারি হলেও মাধ্যমিক পর্যায়ে গুটিকতক সরকারি বিদ্যালয় রয়েছে। অধিকাংশ মাধ্যমিক বিদ্যালয় বেসরকারি হওয়ায় এসব প্রতিষ্ঠানের অনেক শিক্ষকই এমপিওভুক্ত হয়ে সরকারি কোষাগার থেকে মাসিক সম্মানী গ্রহণ করেন। এমপিওভুক্ত হওয়া যখন বেসরকারি শিক্ষকদের আরাধ্য, তখন এ নিয়েই চলছে স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম, দুর্নীতি কিংবা ঘুষ। একই সঙ্গে ঘুষ দিয়ে নাকি শিক্ষকরা বদলিও হতে পারেন! অর্থাৎ মাধ্যমিকে বৈধ যে কোনো সুবিধা পেতে অবৈধ পথ অবলম্বন করতে হয়। ঘুষের যে অঙ্ক প্রতিবেদনে এসেছে তাও শিউরে ওঠার মতো। অথচ বেসরকারি শিক্ষকদের মাসিক সম্মানী কিংবা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও যে কম, তা সবাই স্বীকার করবেন। এমপিওভুক্ত শিক্ষক ও কর্মচারীদের সরকারি আর্থিক সুবিধার অপর্যাপ্ততা থাকায় অসন্তোষও কম নয়। এরপরও বারবার মাধ্যমিক শিক্ষায় যেভাবে মাথা গেড়ে বসেছে, তার মানে কোনো শিক্ষক চাইলেও এর অন্যথা করতে পারেন না। কিংবা ঘুষ দিতে রাজি না হলেও হয়তো প্রয়োজনীয় সুবিধাও তিনি প্রাপ্ত হবেন না! এ লজ্জাজনক অবস্থা চলতে দেওয়া যায় না। একজন শিক্ষকের যদি প্রয়োজনীয় যোগ্যতা থাকার পরও তাকে ঘুষ দিয়ে চাকরি শুরু করতে হয়, এর চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে।
মাধ্যমিকে শিক্ষকদের চাকরিতে প্রবেশের মতোই চাকরি শেষ হলেও একই ভোগান্তি পোহাতে হয়। আমরা দেখেছি, অবসর ভাতা তহবিলে পর্যাপ্ত অর্থ না থাকায় অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও কর্মচারীদের এককালীন অবসর ভাতা পেতেও তিন-চার বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হচ্ছে। এমনকি তাদের অবসর ভাতা পাওয়ার সুনির্দিষ্ট তারিখও জানানো হয় না। আমরা মনে করি, ঘুষের এ কারবার প্রসারের পেছনে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রশাসনের দায় কম নয়। এখানে নথি অগ্রায়ন করতে হাদিয়া বা সম্মানীর নাম করে যেভাবে ঘুষকে 'জায়েজ' করা হয়েছে, তাও অগ্রহণযোগ্য। টিআইবির প্রতিবেদনে ক্রয় সংক্রান্ত বিষয়, প্রশিক্ষণ, সম্মানীসহ আরও নানা বিষয়ে দুর্নীতির চিত্র উঠে এসেছে। আমরা চাই, মাধ্যমিকের সব দুর্নীতি তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক। এই অনিয়ম-দুর্নীতি কেবল উদ্বেগজনকই নয় বরং জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের পথেও বড় অন্তরায়। আমরা আশা করি, সরকার ও সংশ্নিষ্ট দায়িত্বশীলদের কার্যকর পদক্ষেপের মাধ্যমে শিক্ষা খাতে সুশাসনের এসব ঘাটতি দূর হবে।
- বিষয় :
- সম্পাদকীয়
- মাধ্যমিক শিক্ষায় ঘুষ