সমকালীন প্রসঙ্গ
ভাসানচরে জাতিসংঘ ও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন

ড. দেলোয়ার হোসেন
প্রকাশ: ২৮ অক্টোবর ২০২১ | ১২:০০
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে আরেকটি মাইলফলক হচ্ছে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনারের (ইউএনএইচসিআর) সমঝোতা স্মারক সই। গত ৯ অক্টোবর সচিবালয়ে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোহসীন এবং ইউএনএইচসিআরের পক্ষে বাংলাদেশ প্রতিনিধি উহানেন্স ভন ডার ক্লাও সমঝোতা স্মারকে সই করেন। প্রত্যাশা অনুযায়ী, ভাসানচরে থাকা মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের জন্য কাজ শুরু করতে এ সমঝোতার ফলে বাংলাদেশ সরকার ও ইউএনএইচসিআর যৌথভাবে ভাসানচরে রোহিঙ্গা নাগরিকদের খাদ্য ও পুষ্টি, সুপেয় পানি, পয়ঃনিস্কাশন, চিকিৎসা, দক্ষতা প্রশিক্ষণ, জীবিকায়ন, মিয়ানমারের ভাষায় পাঠক্রম ও অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা করবে।
ভাসানচরে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনের এ চুক্তির মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের কল্যাণে সরকারের ইতিবাচক উদ্যোগের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি মিলেছে। স্বাভাবিকভাবে এর ফলে রোহিঙ্গারাই দীর্ঘমেয়াদে উপকৃত হবে। বস্তুত সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে কক্সবাজারের ওপর চাপ কমাতে। সরকার ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তরে নিজস্ব তহবিল থেকে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এ আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। সেখানে এক লাখ রোহিঙ্গা বসবাসের উপযোগী ১২০টি গুচ্ছগ্রামের অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে। মনোরম পরিবেশে সেখানে রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। প্রতিটি রোহিঙ্গা পরিবারের জন্য পাকা ঘরের পাশাপাশি রয়েছে মাছ চাষ, কৃষিকাজ ও পশু পালনের ব্যবস্থা। এমনকি সূচিশিল্পনির্ভর জীবিকার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। এ পর্যন্ত প্রায় ২০ হাজার রোহিঙ্গা ভাসানচরে স্থানান্তরিত হয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যেই বাকি ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তরের কথা ভাবছে সরকার। সেখানে ইতোমধ্যে চল্লিশের অধিক এনজিও কাজ শুরু করেছে।
যদিও ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের সরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে শুরু থেকেই জাতিসংঘ বিরোধিতা করেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় ভাসানচর কতটা ঝুঁকিমুক্ত, রোহিঙ্গাদের অবাধে ভাসানচর থেকে বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডে চলাচলের সুযোগ নিশ্চিত, তাদের স্বেচ্ছায় ভাসানচরে নেওয়া হয়েছে কিনা- এসব বিষয়ে জাতিসংঘের প্রশ্ন ছিল। তারপরও সরকার কক্সবাজার থেকে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের কাজ অব্যাহত রাখে। পরে সেখানে একটি কারিগরি দল পাঠায় জাতিসংঘ। কাছাকাছি সময়ে ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি), ঢাকায় পশ্চিমাসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকের পর জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) দুই সহকারী হাইকমিশনার ভাসানচর সফর করেন। তাদের সফরের পর জাতিসংঘের কারিগরি দলসহ প্রতিনিধি দল ভাসানচর নিয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখায়। বস্তুত সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকা এবং ভাসানচর প্রকল্প সম্পর্কে সঠিক তথ্যের অভাবেই জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো প্রথমদিকে ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তরে নেতিবাচক ভূমিকা পালন করে।
বলাবাহুল্য, ভাসানচর এমন নিরাপদ এলাকা, যেখানে বাংলাদেশের নাগরিকরাও বাস করতেন। বস্তুত, বাংলাদেশের অনেকেই ভাসানচরের আশপাশের দ্বীপে বসবাস করেন। তা ছাড়া বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় বসবাসকারী মানুষের জন্য জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় সাধারণ বিষয়। অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। তারা পর্যাপ্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করেই সেখানে বাস করেন। এমনকি সরকার জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাস থেকে সেখানকার ৪০ বর্গকিলোমিটার এলাকা রক্ষা করতে ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁধও নির্মাণ করেছে। অর্থাৎ সার্বিক সুরক্ষা নিশ্চিত করেই আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত বসবাসের এ ব্যবস্থা বলা চলে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের জন্য উপহারস্বরূপ।
এই চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের যেসব মানবিক সহযোগিতা দিয়ে আসছে, ভাসানচরেও তারা একই সহযোগিতা করবে। ইউএনএইচসিআর গুরুত্বপূর্ণ যে কথাটি বলেছে তা হলো, তারা শুধু এখানেই উত্তম বসবাসের ব্যবস্থা করবে না; ভবিষ্যতে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনেও তাদের প্রস্তুত করবে। বস্তুত রোহিঙ্গাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনই এ সংকটের মূল সমাধান। স্বাভাবিকভাবেই ভাসানচর কিংবা কক্সবাজারে মিয়ানমারের নাগরিকদের থাকার যে ব্যবস্থা করা হয়েছে, তা সাময়িক। মিয়ানমারের এসব বাস্তুচ্যুত নাগরিককে দ্রুত ফিরিয়ে নিতে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থাসহ অন্যান্য দেশ বিশেষ করে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর সদিচ্ছা ও সহায়তা প্রয়োজন। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে নিরাপদ ও সম্মানজক প্রত্যাবাসনের মাধ্যমে মানবতার জয় হবে এবং রোহিঙ্গাদের যে চাপ আমরা বহন করছি তা থেকে বাংলাদেশ মুক্ত হবে।
বলা প্রয়োজন, আমাদের বেসামরিক প্রশাসনের তত্ত্বাবধানেই জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর ভাসানচরে তাদের মানবিক সহযোগিতামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবে। বাংলাদেশ সরকার ভাসানচরে রোহিঙ্গা এবং সেখানে কাজ করা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা, এনজিও কর্মীদের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করবে। ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের আগমন স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেললে তা জাতিসংঘের সাহায্য সংস্থাগুলো দেখবে। ইউএনএইচসিআরের বাংলাদেশের কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টটিভ ভন ডার ক্লাও বলেছেন, বাংলাদেশ সরকার ও তার জনগণের সহযোগিতা, সহমর্মিতার কারণে রোহিঙ্গাদের বাসস্থান, খাদ্য ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা সহজতর হয়েছে।
ভাসানচরে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার এ সমঝোতা স্মারক স্বাভাবিকভাবেই রোহিঙ্গাদের উজ্জীবিত করেছে। এত সুযোগ-সুবিধা দেখে কক্সবাজারে থাকা রোহিঙ্গারা ভাসানচরে যাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তারা এ সিদ্ধান্তকে শুধু স্বাগতই জানায়নি; সমকালের ১৩ অক্টোবর প্রকাশিত প্রতিবেদনে আমরা দেখেছি, কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্পে তারা র্যালি, মিছিল ও মিষ্টি বিতরণ করেছে। তাদের অনেকেই মনে করছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর ঘিঞ্জি পরিবেশে বসবাস করছে বিপুল সংখ্যক মানুষ। ক্যাম্পের এক কক্ষের ছোট একটি ঘরে আট সদস্যের পরিবার নিয়ে বসবাস কষ্টকর। তা ছাড়া ভাসানচরে স্থানান্তর হওয়া স্বজনদের মাধ্যমে তারা জেনেছে, সেখানে বসবাসের পরিবেশ কুতুপালং ক্যাম্পের চেয়ে উন্নত। ভাসানচরে বসবাসরত রোহিঙ্গারাও এতে সন্তোষ প্রকাশ করেছে। তারা আশা করছে, জাতিসংঘের এ অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে তাদের সুযোগ-সুবিধা আরও বাড়বে।
বস্তুত ভাসানচরে মানবিক সহায়তার জন্য জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) সমঝোতা স্মারক বাংলাদেশের কূটনীতির বিজয়। রোহিঙ্গা বিষয়ে বলা চলে, এটি সরকারের আরেক কূটনৈতিক অর্জন। বিশেষ করে জাতিসংঘ এটি অনুধাবন করতে পেরেছে যে, বাংলাদেশ সত্যিকার মানবিক চেতনা থেকেই ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের জন্য এ ব্যবস্থা করেছে। জাতিসংঘের অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে এটাও স্পষ্ট- বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের মাধ্যমে সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ যে প্রসঙ্গটি আগেও বলেছি; এর মাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধান তথা তাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের জন্য প্রস্তুত করা। বস্তুত এ চুক্তির মাধ্যমে ইউএনএইচসিআর আশা করছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের জন্য তাদের সহায়তার হাত আরও বৃদ্ধি করবে। আগের চেয়ে আন্তর্জাতিক ফান্ডিং কক্সবাজারেও কমে গেছে। বাংলাদেশ সরকার বারবার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনেই জোর দিচ্ছে। জাতিসংঘ যাতে এ প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় সক্রিয় ভূমিকা রাখে, সেটাও সরকারের প্রত্যাশা।
ভাসানচর কিংবা কক্সবাজারে মিয়ানমারের নাগরিকদের থাকার যে ব্যবস্থা করা হয়েছে, তা সাময়িক। সুতরাং মিয়ানমারের এসব বাস্তুচ্যুত নাগরিককে দ্রুত ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা আরও জোরদার করা জরুরি। ভাসানচরের ব্যাপারে জাতিসংঘ যেভাবে এগিয়ে এসেছে, একইভাবে রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধানেও জাতিসংঘ উদ্যোগ নেবে- এটাই প্রত্যাশিত।
অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
- বিষয় :
- সমকালীন প্রসঙ্গ
- ড. দেলোয়ার হোসেন