অর্থনীতি
অবস্থা ভালো, চ্যালেঞ্জও আছে

ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ
প্রকাশ: ০৪ নভেম্বর ২০২১ | ১২:০০
করোনাউত্তর বাংলাদেশে প্রায় সর্বক্ষেত্রে নতুন উদ্যমে কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছে। অর্থনৈতিক অবস্থা পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার ভিত্তিতে সরকারের সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো কাজ করছে। এত বড় একটা দুর্যোগ কাটিয়ে আমরা নতুন করে সামনে এগোনোর চেষ্টা করছি। তবে সর্বাবস্থায় মনে করি, এই কর্মপরিকল্পনা আরও সমন্বিত করে গতিশীল করা জরুরি। প্রথমেই জনস্বাস্থ্যের দিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখতে হবে। করোনা পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে বটে, কিন্তু তাতে আত্মতৃপ্তিতে ভুগলে চলবে না। এ সংক্রান্ত অভিজ্ঞতার আলোকে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সতর্ক থাকা বাঞ্ছনীয়।
করোনাঝুঁকি ফের যাতে দেখা না দেয়, এ জন্য প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত তো বটেই, এমনকি ব্যক্তিরও দায়িত্বশীলতার ব্যাপারে সজাগ থাকা চাই। স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটানো যাবে না। স্বাস্থ্য খাতে বিদ্যমান অনিয়ম-দুর্নীতির মূলোৎপাটন করতে হবে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কোনোদিকেই ঢিলে দেওয়া চলবে না। দেশে করোনার টিকা কার্যক্রম চলমান এবং ক্রমেই এর পরিসর বিস্তৃত হচ্ছে। সমগ্র জনগোষ্ঠীকে টিকার আওতায় নিয়ে আসা শুধু জনস্বাস্থ্যের জন্যই নয়; অর্থনীতির জন্যও বড় চ্যালেঞ্জ। করোনা-দুর্যোগে অর্থনৈতিক খাতগুলোতে যে অভিঘাত লেগেছিল, তা কাটিয়ে উঠতে হবে। কাজেই ফের যাতে অর্থনৈতিক খাতগুলোতে কোনো অভিঘাত না লাগে, তা সামাল দিতে দরকার সরকারের সব বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় নিবিড় করা।
অর্থনৈতিক উন্নয়নে আমাদের যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, বিশেষ করে প্রণোদনা কিংবা যে অর্থনৈতিক প্যাকেজগুলো ঘোষণা করা হয়েছে, এসব যথাযথভাবে বাস্তবায়নে তদারকি জোরদার করতে হবে। যারা এসবের সুফলভোগী হওয়ার কথা, তারা তা হচ্ছে কিনা কিংবা অর্থনৈতিক সহায়তা দিয়েই কাজ শেষ, তা যেন মনে না করা হয়। এর পরবর্তী করণীয় সম্পর্কেও নজর গভীর করতে হবে। বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতে নজরটা গভীর করা খুব জরুরি। এ খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় আরও মনোযোগী হওয়ার বিকল্প নেই। রপ্তানি আয়ে ইতোমধ্যে সৃষ্টি হয়েছে নতুন রেকর্ড। এটি অত্যন্ত সুসংবাদ। কৃষিপণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধিতে আরও নজর দিলে এর সুফল হবে বহুমুখী।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প নিয়ে ভাবতে হবে নতুন করে। করোনায় এই স্তরের শিল্পে অভিঘাতের বিরূপ ফল বহুমুখী হয়ে উঠেছে। কর্মসংস্থান বাড়ানো এবং অর্থনৈতিক খাতের সামগ্রিক বিবেচনায় এদিকে গুরুত্ব দিয়ে কাজ শুরু করা চাই। যে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে, এর সুফলভোগী এসব শিল্প খুব একটা হতে পারেনি। ------ বড় শিল্পের প্রতি গুরুত্ব বা মনোযোগ বেশি থাকা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের গুরুত্বও কোনোভাবে খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে এ দুই স্তরই সমান গুরুত্বের দাবিদার। কর্মসংস্থান ও উৎপাদন বাড়াতে বিশেষ কর্মউদ্যোগের যেখানে খুব প্রয়োজন, সেখানে এসব বিষয় দেখতে হবে সমগুরুত্ব দিয়ে। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র প্রসারিত করে কর্মক্ষম হাতগুলোকে উৎপাদন ব্যবস্থায় ফের আরও বড় পরিসরে যুক্ত করতে হবে। তাতে একদিকে সামাজিক কল্যাণ সাধনের পথ সুগম হবে, অন্যদিকে অর্থনৈতিক ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার পথও হবে মসৃণ।
টানা কয়েক মাস ধরে রেমিট্যান্সে ভাটা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে শুরু হয়েছে রেমিট্যান্স কমার ধারা। ২ নভেম্বর সমকালের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একক মাস হিসেবে গত চার মাসের মধ্যে অক্টোবরেই সবচেয়ে কম রেমিট্যান্স এসেছে। তা ছাড়া করোনা আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারেও নেতিবাচক ধাক্কা দিয়েছে। অনেক প্রবাসী কর্মী দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন। তাদের মধ্যে অনেকেরই ফের যাওয়ার ক্ষেত্রে এখনও বিরাজ করছে প্রতিকূল পরিস্থিতি। এদিকেও দৃষ্টি গভীর করতে হবে। আমাদের অর্থনীতির বড় শক্তি প্রবাসী আয়। এই আয়ের ধারা ফিরিয়ে আনতে নানামুখী উদ্যোগ নিতে হবে। প্রবাসী কর্মীদের আয় শুধু সমাজ কিংবা পরিবারের জন্য নয়; দেশের অর্থনীতির সুস্বাস্থ্যের জন্যও জরুরি।
আমাদের প্রতিটি নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানকে আরও সক্রিয় করতে জোর দেওয়ার বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে আমাদের বেশ কিছু দুর্বলতা রয়েছে। যেমন বর্তমানে ই-কমার্স সম্ভাবনাময় একটি দিক। প্রযুক্তির বিকাশের কল্যাণে এই পথ আরও খুলেছিল। কিন্তু সম্প্রতি ই-কমার্সকেন্দ্রিক বড় কিছু কেলেংকারি ঘটে গেছে। এর নিয়ন্ত্রণে করণীয় যা কিছু জরুরি, তাতেও ঘাটতি স্পষ্টত দৃশ্যমান। এক প্রতিষ্ঠান দুষছে অন্য প্রতিষ্ঠানকে। কিন্তু যারা ভোক্তাদের ধোঁকা দিয়ে, তাদের সঙ্গে প্রতারণা করে একের পর এক বিস্ময়কর ঘটনা ঘটাল, তারা কোন শক্তিবলে এমনটি করল? ভোক্তা অধিকার আইনের প্রয়োগেও দেখা যাচ্ছে ঢিলেঢালা ভাব। মোট কথা, যার যে কাজ, করতে হবে প্রশ্নাতীতভাবে। দুর্নীতির ব্যাপারে সরকারের রয়েছে 'শূন্য সহিষ্ণুতা'র অঙ্গীকার। কিন্তু অঙ্গীকারই যথেষ্ট নয়। এ ব্যাপারে নির্মোহ ও কঠোর হতেই হবে। দুর্নীতি নির্মূল অর্থনৈতিক অবস্থা পুনরুদ্ধারে অন্যতম চ্যালেঞ্জ। অন্যায়কারী, অপরাধীর দৃশ্যমান শাস্তি নিশ্চিত করা চাই।
দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে সরকারের তরফে বারবার আহ্বান জানানো হচ্ছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করতে হবে সর্বাগ্রে। সবার জন্য অধিকারের মাঠ সমতল করার বিকল্প নেই। শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়নেই বিনিয়োগ নিশ্চিত হবে না কিংবা বাড়বেও না। উন্নয়ন ও বিনিয়োগ সহযোগী কিংবা সহায়তাকারী সব প্রতিষ্ঠানের কল্যাণের হাত করতে হবে একত্রিত। ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নত করতে হলে হয়রানি, দুর্নীতির নিরসন ঘটিয়ে সহযোগিতামূলক মনোভাব পুষ্ট করা দরকার। যারা বিনিয়োগ করতে আগ্রহী, তারা হোন দেশি কিংবা বিদেশি, তাদের প্রতি সব রকম সহায়তার পথ মসৃণ করার কোনো বিকল্প নেই। ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকি নিরসনে যেসব উপসর্গ বিদ্যমান, সেসব দূর করার ক্ষেত্রে সরকারের আরও জোরালো কর্মপরিকল্পনা চাই। অর্থাৎ সর্বক্ষেত্রে জরুরি হলো সুশাসন।
আমাদের বাজারে অস্থিতিশীলতা নতুন নয়। চাহিদা অনুযায়ী জোগান নিশ্চিত করতেই হবে। সরবরাহের সব পথ করতে হবে নিস্কণ্টক। মধ্যস্বত্বভোগীদের দিকে কঠোর নজর দিতে হবে। বাজার ব্যবস্থাপনায় জোর দিতে হবে। ব্যবস্থা ভালো করতে না পারলে কোনো ভালো পরিকল্পনাতেই সুফল মিলবে না। এখানেও নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানের কথা এসে যায়। যারা বাজার তদারকি করবেন কিংবা অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি বন্ধে যাদের কাজ করার কথা, তাদের জবাবদিহি নিশ্চিত করাও সমভাবে জরুরি। যেসব পণ্য আমদানি করতে হয়, তার দাম যদি আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়ে, তাহলে অভ্যন্তরীণ বাজারেও এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। কিন্তু এই বিষয়কে পুঁজি করে কেউ যাতে অধিক মুনাফা লোটার ছক কষতে না পারে, নজর সার্বক্ষণিক সেদিকে তীক্ষষ্ট রাখা চাই। যে কোনো অশুভ মহল কিংবা শক্তির অপকর্ম দমনে কঠোর থেকে কঠোরতর হতেই হবে। সরকারের পণ্য মজুদও বাড়াতে হবে। আমদানি-রপ্তানির ব্যাপারে যাদের দেখভালের সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব রয়েছে, তাদের ভেবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কখন কোন পণ্যের আমদানি বাড়ানো দরকার কিংবা রপ্তানির ক্ষেত্রে কিছুটা ভাটা দরকার। বিশ্বব্যাপী পণ্য বাজারে কিছুটা অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে বটে, কিন্তু এই অস্থিরতার সুযোগ যাতে দেশের অভ্যন্তরে অসাধু কিংবা স্বার্থান্বেষী মহল নিতে না পারে, এ জন্য জরুরি সার্বক্ষণিক কঠোর নজরদারি ও তদারকি।
মানুষ এমনিতেই চাপে আছে। জীবনযাপনের ক্ষেত্রে খরচের খাত বাধ্য হয়েই অধিকাংশ মানুষ সংকুচিত করেছে। তবে আমাদের অর্থনীতি নিয়ে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ইতিবাচক পূর্বাভাসই দিচ্ছে। আমাদের অর্থনীতি তুলনামূলক ভালো আছে, তা অসত্য নয়। পুঁজিবাজারের পরিস্থিতি সাম্প্রতিক খুব একটা ভালো নয়। এক্ষেত্রে সুশাসন ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় অত্যন্ত জরুরি কার্যকর দূরদর্শী পদক্ষেপ নেওয়া। পুঁজিবাজারের বড় একটি অংশ মানুষের আয়ের ক্ষেত্র। আমাদের সামনে যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে, সেসব মোকাবিলা করতে হবে সংশ্নিষ্ট সবার নিজ নিজ ক্ষেত্রে অধিকতর দায়িত্বশীলতা ও নিষ্ঠার পরিচয় দিয়ে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর
- বিষয় :
- অর্থনীতি
- ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ