ঢাকা মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

ইসলাম ও সমাজ

মহানবীর (সা.) মেরাজ

মহানবীর (সা.) মেরাজ

মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন

প্রকাশ: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ১২:০০


মানব সভ্যতার ইতিহাসে মহানবীর (সা.) মেরাজ গমনের ঐতিহাসিক ঘটনাটি তার শ্রেষ্ঠত্বের নিদর্শন। নবুওয়তের দশম বর্ষ তথা ৬২০ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ রজব পবিত্র মেরাজ সংঘটিত হয়েছিল। মহাগ্রন্থ আল-কোরআন এবং প্রায় অর্ধশত সাহাবায়ে কেরামের বর্ণিত হাদিস থেকে ইসলামের ইতিহাসে মেরাজের সত্যতা নিশ্চিত হয়েছে। বস্তুত এটি কোনো আত্মিক আরোহণ ছিল না, বরং রাসুল (সা.)-এর সশরীরে 'ইসরা' (নৈশ ভ্রমণ) ও 'মেরাজ' (ঊর্ধ্বারোহণ) অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যা কেয়ামত অবধি মানবেতিহাসের এক অলঙ্ঘনীয় বিশ্বরেকর্ড হিসেবে স্বীকৃত হয়ে থাকবে। রাসুলে পাক (সা.)-এর 'সিনা চাক' (বক্ষ বিদারণ), বোরাক (বিদ্যুৎগতির বাহন), রফরফ (সবচেয়ে দ্রুতগতির বাহন), বায়তুল মোকাদ্দাস ভ্রমণ ও নবী-রাসুলদের সম্মিলিত জামাতে নামাজ আদায় ও ইমামতি, মহাকাশ অতিক্রম, প্রতিটি আকাশে অভ্যর্থনা ও বিশিষ্ট নবী-রাসুলদের সাক্ষাৎ, সিদরাতুল মুনতাহা, আরশে আজিম ও মহান প্রভুর দিদার এবং নামাজের আদেশপ্রাপ্তি- ইত্যাকার বিষয়ের মাধ্যমে মেরাজের তাৎপর্যময় ঘটনাকে সুশোভিত করা হয়েছে।
পবিত্র মেরাজের ঘটনাটি আক্ষরিক অর্থেই বিস্ময়কর; এটি অভূতপূর্ব এবং পৃথিবীর অন্য যে কারও জন্য তা ঘটানো অসম্ভব। পৃথিবীর ইতিহাসে এর চেয়ে বিস্ময়কর ঘটনা, এর চেয়ে বড় আর কোনো দৃষ্টান্ত হতে পারে না। এটি সর্বশ্রেষ্ঠ মানবের জন্য সর্ববৃহৎ দৃষ্টান্ত। মেরাজের ঘটনাটি যে কতটা বিস্ময়কর তা মহান আল্লাহর বক্তব্যেই পরিস্কার। আল্লাহপাক বলেন- সুবহানাল্লাজি আসরা বিআবদিহি লাইলাম মিনাল মাসজিদিল হারামি ইলাল মাসজিদিল আকসাল্লাজি বারাকনা হাউলাহু লিনুরিয়াহু মিন আয়াতিনা....। এখানে স্মর্তব্য, আমরা কোনো আজব বা বিস্ময়কর ঘটনা প্রত্যক্ষ করলে বা শুনলে নিজেদের অজান্তে 'সুবহানাল্লাহ' বলে উঠি। এখানে লক্ষণীয়, মহান আল্লাহ মেরাজের মতো অলৌকিক ও অনন্যসাধারণ এ ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে কোরআনে কারিমে তিনি নিজেই 'সুবহান' শব্দ দিয়ে শুরু করেছেন। প্রকৃতপক্ষে এর মধ্য দিয়েই মেরাজের গভীর তাৎপর্য উপলব্ধি করা যায়।
রাসুল (সা.) মেরাজের রাতে উম্মে হানির ঘরে শায়িত ছিলেন। অলৌকিকভাবে সেখানে ফেরেশতাদের সর্দার জিবরাইল (আ.) এসে আবির্ভূত হন এবং মেরাজের সুসংবাদ প্রদান করেন। মানবেতিহাসের শ্রেষ্ঠতম ঘটনার জন্য শারীরিক ও মানসিক যে প্রস্তুতি প্রয়োজন, তা পুরো মাত্রায় নেওয়ার জন্য রাসুল (সা.)-এর জীবনের আরেক অলৌকিক ঘটনা 'বক্ষ বিদীর্ণকরণ' সম্পন্ন হয়। তারপর অত্যন্ত দ্রুতগামী বাহন 'বোরাক', যা কিনা বিদ্যুৎগতিতে বা তার চেয়েও অধিক বেগে ধাবিত হয়, তাতে আরোহণ করেন। এখানে ঘটনার শুরুতেই বক্ষ বিদীর্ণ করা এবং বোরাকের অবতরণও মেরাজের গুরুত্ব ও এর সত্যতার প্রমাণ বহন করে।
অনেকের প্রশ্ন, মানবদেহ নিয়ে সমস্যাসংকুল মহাশূন্য ও এর পথে পথে যেসব স্তর বা বাধা-বিপত্তি রয়েছে সেগুলো কীভাবে অতিক্রম করা গেল? জবাব হলো- সমুদ্রের গভীর তলদেশ থেকেও মহান আল্লাহ তার স্বীয় কুদরতে মানুষকে রক্ষা করেছেন এবং জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডেও মানুষকে পোড়ানো যায়নি শুধু আল্লাহর ইচ্ছার কারণে। আর এটি যদি আল্লাহ হজরত ইউনুস (আ.) বা হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর জন্য করতে পারেন, তবে তার প্রিয় হাবিব মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্য কেন করবেন না বা কেন সে রকম ব্যবস্থা করতে সক্ষম হবেন না? বস্তুত মেরাজের ঘটনাটি এমনই যেটি শুধু বিশ্বাসের বিষয়; কোনো ধরনের যুক্তি দিয়ে এটিকে বিশ্বাস করানো প্রায় অসম্ভব। আর তা বুঝতে পারি আরবের অবিশ্বাসীদের এ সংক্রান্ত অবিশ্বাস দেখে। প্রকারান্তরে শুধু মেরাজের ঘটনা শুনে সঙ্গে সঙ্গে এতে বিশ্বাস স্থাপন করে রাসুলের পরম সাথী হজরত আবু বকর (রা.) 'সিদ্দিক' উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। যার পুরস্কারস্বরূপ রাসুল (সা.) তাকে বলেছিলেন- 'আন্তা আবাবাকরিন, আন্তা সিদ্দিক ওয়া আন্তা আতিকুল্লাহি মিনান্নার।' অর্থাৎ তুমি আবু বকর! তুমি সিদ্দিক! এবং তুমি নিঃসন্দেহে আল্লাহর জাহান্নাম থেকে চিরতরে মুক্ত।
রাসুল (সা.)-এর প্রিয়তমা স্ত্রী খাদিজাতুল কুবরাকে হারিয়ে তিনি মানসিকভাবে যে কষ্ট ভোগ করছিলেন, মেরাজের ঘটনার মাধ্যমে তিনি জীবনের শ্রেষ্ঠতম ও সর্বোত্তম সান্ত্বনাও লাভ করেন। রাসুল (সা.)-এর জীবনে মেরাজের ঘটনা যেমনি অসাধারণ, তাৎপর্যমণ্ডিত ও শিক্ষামূলক; তেমনি মানবেতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ রেকর্ড এবং মহানবীর (সা.) শ্রেষ্ঠত্বের এক অমোঘ নিদর্শন তার এই ঊর্ধ্বজগৎ পরিভ্রমণের অনন্য ঘটনাটি; যেমনটি বিশ্ব সভ্যতায় আমরা আর কোনোকালেই দেখিনি।
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন: চেয়ারম্যান, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন

×