অন্যদৃষ্টি
প্রতিবন্ধীর ভোটাধিকার

মোশারফ হোসেন
প্রকাশ: ০৫ মার্চ ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ০৫ মার্চ ২০২২ | ১৪:৩৩
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপ থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে প্রতিবন্ধী। মানুষ প্রতিবন্ধী হয় নানা কারণে। জন্মগত, অপুষ্টিজনিত কারণে পঙ্গুত্ববরণ, রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে অথবা দুর্ঘটনার কারণে গর্ভকালীন অপুষ্টি বা গর্ভকালীন অসচেতনতা, নানা ধরনের রোগব্যাধির কারণে অনেকে প্রতিবন্ধী হয়ে যায়। এ ছাড়া স্নায়বিক সমস্যা, হাড় বা অস্থির অসম অবস্থানও এ জন্য দায়ী।
বাংলাদেশে মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ১৫ শতাংশ প্রতিবন্ধী। দেশে ১২ ধরনের প্রতিবন্ধী আছে। তাদের নিয়ে সমাজে নানা ধরনের ভ্রান্ত ধারণা, রূপক কাহিনি প্রচলিত। এমন মন্তব্যও সমাজে বিদ্যমান, যেমন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে পিতামাতার পাপের ফসল বা সৃষ্টিকর্তার অভিশাপ হিসেবে গণ্য করা হয়। নির্বাচন কমিশনের তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী ভোটার মোট ভোটারের ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ। বাংলাদেশে মোট প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর প্রায় ৩২ শতাংশ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী।
প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নে প্রধান বাধাটা আসে সমাজ-সংস্কৃতি থেকে। তাদের অধিকারগুলোকে যথাযথভাবে সুরক্ষিত না করে অধিকারবঞ্চিত করা হয় নানা উপায়ে। যেমন স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, প্রশিক্ষণ তথা রাজনৈতিক অধিকারের সমান সুযোগ পাওয়া থেকে অনেক দূরে অবস্থান করে এ জনগোষ্ঠী। বাংলাদেশ সরকারের দক্ষতা উন্নয়ন নীতিমালায় প্রতিবন্ধীদের জন্য ৫ শতাংশ কোটার ব্যবস্থাটি উল্লিখিত, যার অর্ধেক হচ্ছে নারী। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন।
ভোটার হওয়া এবং ভোটাধিকার প্রয়োগ করা সব প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির মৌলিক অধিকার। রাষ্ট্র এ নিশ্চয়তা বিধানে ব্যর্থতার পরিচয় দিলে ব্যক্তির অধিকার ভূলুণ্ঠিত হবে। কিন্তু আমাদের দেশের বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় পর্যায় থেকে জাতীয় পর্যায়সহ সর্বস্তরের নির্বাচনে প্রতিবন্ধী নাগরিকদের ভোটাধিকার প্রয়োগের পথ অমসৃণ।
প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, নেদারল্যান্ডস, স্লোভেনিয়া, আলবেনিয়ায় ভোট প্রদানে প্রতিবন্ধীবান্ধব ইভিএম মেশিন প্রচলিত। ২০১৪ সাল থেকে নেপাল, ভুটান, নামিবিয়া, কেনিয়াসহ প্রতিবন্ধীবান্ধব ইভিএম মেশিন ব্যবহারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। আমাদের দেশে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২-এর শুধু দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের সহযোগী ব্যবহারের বিধান রয়েছে। কিন্তু অন্য ধরনের প্রতিবন্ধীদের ভোট প্রদানের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সহযোগিতার উল্লেখ নেই। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর ভোটারের অংশগ্রহণ ছাড়া দেশের গণতন্ত্র কখনও সুসংহত হতে পারে না। তাই নির্বাচন কমিশন পরিপত্র জারি করতে পারে। ভোটার নিবন্ধনবিধিতে পরিবর্তন আনতে পারে। এ ক্ষেত্রে গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশে প্রতিবন্ধী বিষয়ে সংশোধনী প্রস্তাবসহ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে প্রতিবন্ধীবান্ধব যথাসাধ্য কার্যকরী উপায় বের করতে পারলে চরম প্রতিবন্ধী ভোটারও ভোট প্রয়োগ ভোটে প্রার্থিতা হিসেবে অংশ নিতে উৎসাহিত হবেন। এ ছাড়া সমর্থক, নির্বাচন পর্যবেক্ষক হিসেবে অংশগ্রহণ স্বতঃস্ম্ফূর্তভাবে নাগরিক অধিকার ভোগ করতে দায়িত্ববোধ জাগ্রত হবে। দেশে ৪১ হাজার ভোটকেন্দ্র আছে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেমন- স্কুল, মাদ্রাসা, কলেজ, ক্লাব, পাঠাগার, আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে নির্বাচনের ভোটকেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এসব কেন্দ্র প্রতিবন্ধীবান্ধব তথা প্রতিবন্ধী ব্যক্তির প্রবেশগম্য নিরাপদ নিচতলায় হলে, এ ক্ষেত্রে বয়স্ক ও অন্তঃসত্ত্বা নারী ভোটারও সুযোগ পাবেন। পরিচয়পত্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির প্রতিবন্ধিতার ধরন উল্লেখ ছাড়াও পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে ভোটকেন্দ্রে প্রতিবন্ধীরা সশরীরে না গিয়ে যাতে ভোট দিতে পারে, এ ক্ষেত্রে উন্নতমানের প্রযুক্তির সাহায্যে ডিভাইস ব্যবহার করে ভোটদানের ব্যবস্থা করা যায়।
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য প্রযুক্তির সাহায্যে ইভিএম ভয়েজ সংযুক্ত করে ভোটদান পদ্ধতি সহজ করার উপায় বের করতে হবে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ভোটকেন্দ্রে সহযোগিতার জন্য নির্বাচনের দিন যাতায়াতের সুবিধার্থে যানবাহন প্রস্তুত রাখা, হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী প্রতিবন্ধী নাগরিকদের জন্য আলাদা প্রবেশগম্য বুথের ব্যবস্থা করতে হবে। ভোটকেন্দ্রগুলোতে টয়লেটের ব্যবস্থা রাখাটা খুব জরুরি। প্রতিবন্ধীদের অধিকার নিশ্চিত করতে সংশ্নিষ্ট বিভিন্ন দপ্তর, মন্ত্রণালয়সহ আপামর জনসাধারণের এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা রাখাটা সময়ের দাবি।
মোশারফ হোসেন: প্রভাষক, সরকারি ইস্পাহানী ডিগ্রি কলেজ
mamun86cu@gmail.com
- বিষয় :
- অন্যদৃষ্টি
- মোশারফ হোসেন