বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুসারে, শুধু চ্যান্সেলর নিযুক্ত বৈধ উপাচার্যই মূল সনদপত্রে সই করতে পারেন। ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য সনদপত্রে সই করতে পারেন না। তবু বছরের পর বছর বৈধ উপাচার্য ছাড়াই চলছে বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়। দেওয়া হচ্ছে সনদও। আইনের বিধান মতে, সব ব্যয় ভাউচার, দেনা পরিশোধ, সব অর্থ লেনদেনে চ্যান্সেলর নিযুক্ত ট্রেজারারের সই থাকতে হবে। বাস্তবে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈধ ট্রেজারার নেই। একাডেমিক কার্যক্রমে গতিশীলতা আনতে ও শিক্ষার মান বজায় রাখতে উপ-উপাচার্য থাকারও বিধান রয়েছে আইনে। প্রকৃতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এর প্রতিফলন কম। এমনকি কোনো উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও ট্রেজারার ছাড়াই দিব্যি চলছে কিছু বিশ্ববিদ্যালয়। এই মুহূর্তে অন্তত ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে এ রকম কার্যক্রম। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ অথবা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) আদেশ, নির্দেশকেও পাত্তা দিচ্ছে না তারা।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিশ্ববিদ্যালয়) মো. আবু ইউসুফ মিয়া সমকালকে বলেন, চিহ্নিত কিছু বিশ্ববিদ্যালয় কোনো ভিসি, প্রোভিসি ও ট্রেজারার ছাড়াই ইচ্ছামতো চালাচ্ছে প্রতিষ্ঠান। এটা এক ধরনের অরাজকতা। দিব্যি দেশের আইন অমান্য করে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করছেন তারা। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে তাদের ডেকে এনে আইন মেনে চলতে একাধিকবার তাগিদ দিয়েছি, তারা কোনো কর্ণপাত করছে না। তাদের মধ্যে আইন ভঙ্গ করার প্রবণতা এতটাই বেড়ে গেছে যে, সরকারের কোনো কথাই তাদের কানে যাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে এ মাসেও বোর্ড অব ট্রাস্টির চেয়ারম্যানদের কয়েকজনকে ডেকে নিয়ে এসে তাগিদ দেওয়া হয়েছে। ভিসি, প্রোভিসি ও ট্রেজারারের শূন্য পদ পূরণের জন্য প্যানেল প্রস্তাব চাওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, এর পরও তারা আইনের বাইরে থাকলে তখন কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, অন্তত ১০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈধ ভিসি, প্রোভিসি ও ট্রেজারার কিছুই নেই। এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হলো- সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি, দি পিপলস ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি, দি মিলেনিয়াম ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়া, ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটি, চিটাগং ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, ফরিদপুরের টাইমস ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, এনপিআই ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ ও ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি-চট্টগ্রাম।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, গত ১৭ অক্টোবর ভিসি না থাকা ৪৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানদের নিয়ে জুমে একটি সভা করেন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. আবু বকর ছিদ্দীক। সেখানে ফরিদপুরের টাইমস ইউনির্ভাসিটি বাংলাদেশের ট্রাস্টি বোর্ড চেয়ারম্যান বেগম শাখাওয়াত বানুর কাছে ভিসি, প্রোভিসি ও ট্রেজারার না থাকার কারণ জানতে চাওয়া হয়। তিনি সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা নিচ্ছেন জানিয়ে এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। অনেক ট্রাস্টি বোর্ড চেয়ারম্যান জানান, শিগগিরই তাঁরা ভিসি নিয়োগে নামের প্যানেল প্রস্তাব পাঠাবেন।

জানা গেছে, নিয়ম অনুসারে ভিসি, প্রোভিসি ও ট্রেজারার নিয়োগের জন্য সংশ্নিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তিনজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদের নাম বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে পাঠায়। ইউজিসি তা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। এর পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় হয়ে তা চ্যান্সেলরের অনুমোদনের জন্য যায়। তিনি অনুমোদন করলে 'চ্যান্সেলরের সচিবালয়' হিসেবে কাজ করা শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংশ্নিষ্ট বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে।

ইউজিসির একাধিক কর্মকর্তা জানান, নিয়মিত বৈধ ভিসি ও ট্রেজারার না থাকলে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়মে সুবিধা হয়। এ কারণে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চ্যান্সেলর অনুমোদিত ভিসি নিয়োগে বিলম্ব করে দিনের পর দিন ভারপ্রাপ্ত ভিসি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পারিচালনা করে। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার ট্রেজারার পদে ট্রাস্টি বোর্ড সদস্যদের আত্মীয়স্বজনই দিব্যি বসে আছেন।

ইউজিসি থেকে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে ১০৯টি। এর মধ্যে ৪৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, ৭৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসি এবং ৪৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রেজারারের পদ শূন্য রয়েছে। তবে এর মধ্যে ৪০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি ও ট্রেজারারের উভয় পদই খালি। ১০টিতে তিন পদেই (ভিসি, প্রোভিসি ও ট্রেজারার) কেউ নেই। শূন্য এসব পদ পূরণের জন্য নামের প্যানেল প্রস্তাব পাঠাতে চলতি বছরের ১১ এপ্রিল সব বিশ্ববিদ্যালয়কে চিঠি দেওয়া হয়। পরে ২৩ আগস্ট ফের তাগিদপত্র দেওয়া হয়।

বর্তমানে উপাচার্য ছাড়াই যেসব বিশ্ববিদ্যালয় চলছে সেগুলো হলো- শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ-উত্তরা, জার্মান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ-গাজীপুর, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি-মোহাম্মদপুর; টাইমস ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ-ফরিদপুর, ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ-পান্থপথ, প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি, গুলশান-২; ফার্স্ট ক্যাপিটাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ-পান্থপথ, ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি-বরিশাল, রূপায়ণ এ কে শামসুজ্জাহা বিশ্ববিদ্যালয়-নারায়ণগঞ্জ, শাহ মখদুম ম্যানেজমেন্ট ইউনিভার্সিটি-রাজশাহী, মাইক্রোল্যান্ড অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি-উত্তরা, শেখ হাসিনা ইউনির্ভাসিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি-ভৈরব, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনির্ভাসিটি-টিকাটুলী, এন. পি. আই. ইউনিভার্সিটি-মানিকগঞ্জ, ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি-চট্টগ্রাম, দি পিপলস ইউনির্ভাসিটি অব বাংলাদেশ-মোহাম্মদপুর, ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়া-বনানী, প্রাইম এশিয়া ইউনির্ভাসিটি-বনানী, গণ বিশ্ববিদ্যালয়-সাভার, ফার্স্ট ক্যাপিটাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ-চুয়াডাঙ্গা।

ট্রেজারার না থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হলো- প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি-গুলশান-২, ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি-বরিশাল, শেখ হাসিনা ইউনির্ভাসিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি-ভৈরব, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি, গ্রিন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, শাহ মখদুম ম্যানেজমেন্ট ইউনিভার্সিটি-রাজশাহী, রাজশাহী আহ্‌ছানিয়া মিশন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা খানবাহাদুর আহ্‌ছানউল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, ফরিদপুরের টাইমস ইউনির্ভাসিটি বাংলাদেশ, ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ ধানমন্ডি, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক ও রয়েল ইউনিভার্সিটি অব ঢাকা প্রমুখ।

অনিয়মের মচ্ছব: আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চলছে বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুসারে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হলেও, জমি কেনার নামে ৩০৪ কোটি টাকা আত্মসাতের দায়ে অভিযুক্ত হয়ে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক চার ট্রাস্টি বোর্ড সদস্য এখন জেলে। তাঁদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি কেনায় দুর্নীতি ছাড়াও প্রতি মিটিংয়ে মোটা অঙ্কের সম্মানি নেওয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকায় দামি ব্র্যান্ডের গাড়ি কেনা, বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকায় ট্রাস্টিদের বিদেশ ভ্রমণ, ট্রাস্টি কোটা চালু করে শিক্ষার্থী ভর্তিসহ নানা অভিযোগ রয়েছে।

প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের আগের চেয়ারম্যান আবদুল খালেকের বিরুদ্ধে বিদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬ জন শিক্ষকের পিএইচডির সনদ জাল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য জাল সনদধারীদের চাকরিচ্যুত করলে, তাঁকেই বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়তে বাধ্য করেন ট্রাস্টিরা। এমনকি ওই ৬ শিক্ষককে ফের চাকরিতে বহাল করা হয়।

এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ টানা ১২ বছর চ্যান্সেলর নিযুক্ত কোনো উপাচার্য ছাড়াই চলছে। ফলে দীর্ঘ এ সময়ে ইচ্ছামতো সনদ ইস্যু করা হয়েছে। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়টির মালিক আবুল হাসান মুহম্মদ সাদেক উপাচার্য হিসেবে সই করেছেন। ফলে তার সই করা সনদগুলো কোনোভাবেই বৈধ মনে করছে না ইউজিসি। এ ছাড়া নিয়মিত সিনেট, সিন্ডিকেট গঠন করা করে ইচ্ছামতো বিশ্ববিদ্যালয়টির আয়-ব্যয় পরিচালনা করেন মুহম্মদ সাদেক ও তাঁর পুত্র।

ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি চট্টগ্রামের (ইউএসটিসি) প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলাম। এখন মালিকানা নিয়ে তাঁর তিন সন্তানের বিরোধ চরমে। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠার প্রায় ৩০ বছর হতে চললেও বিশ্ববিদ্যালয়টির নিজস্ব জমি নেই, রেলওয়ে থেকে লিজ নেওয়া জমিতে বিশ্ববিদ্যালয়টি চলছে।

বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটিতে দীর্ঘদিন ধরে ভিসি, প্রোভিসি ও ট্রেজারার নেই। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন কোর্স, কারিকুলাম ও প্রোগ্রাম আপডেট হয় না। ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ অনুমোদিত আসনের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করেছে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে। ওই সব বিষয়ে পড়ালেখার প্রয়োজনীয় ল্যাবরেটরি সুবিধাও তাদের নেই। মানিকগঞ্জের এনপিআই বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানা নিয়ে দুই পক্ষের দ্বন্দ্ব, শিক্ষক সংকটসহ নানা অভিযোগে তদন্ত চলছে। চুয়াডাঙ্গার ফার্স্ট ক্যাপিটাল ইউনিভার্সিটি ও ফরিদপুরের টাইমস ইউনিভার্সিটিতে প্রয়োজনীয় জায়গা, শিক্ষক, ল্যাবরেটরিসহ কোনো সুবিধাই নেই। নামমাত্র বেতন দেওয়া হয় শিক্ষকদের। কোর্স কারিকুলাম আপডেট করা হয় না।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এসব অনিয়ম প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় দেখভালের দায়িত্বে থাকা কমিশন সদস্য অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দ সমকালকে বলেন, এগুলোর প্রতিটি বিষয়েই ইউজিসি অবহিত। আইনের ভেতরে এগুলোর সমাধান করতে আমরা তাদের তাগাদা দিয়েছি। সবাইকে আইনের পথেই হাঁটতে হবে। আইনের ব্যত্যয় ঘটালে আমরা সেসব প্রতিষ্ঠানের নতুন কোর্স, কারিকুলাম অনুমোদন বন্ধ করে দেব। এর পরও কথা না শুনলে সেখানে শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ করে দেব।