প্রতিদিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে প্রবেশের দীর্ঘ সারির চিত্র অনেকেরই অতি পরিচিত। গ্রন্থাগারে প্রবেশের জন্য রাত ১২টা থেকে ব্যাগ দিয়ে সিরিয়াল রাখার তুমুল প্রতিযোগিতা শুরু হয়। সারারাত পেরিয়ে সকাল ৮টায় প্রবেশদ্বার খোলার আগ পর্যন্ত এই সারি গড়ায় ৮০ মিটার দূরে কলাভবন ক্যাফেটেরিয়া পেরিয়ে কলাভবন পর্যন্ত।

অথচ গ্রন্থাগারের ১৫ শতাধিক আসনের বিপরীতে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে মাত্র ৮০ জন শিক্ষক-শিক্ষার্থী বই নিয়ে পড়েছেন। অন্যদিকে বিজ্ঞান গ্রন্থাগারে প্রায় ৬০০ আসনের বিপরীতে প্রতিদিন বই নিয়েছেন গড়ে দু’জন। বিগত বছরগুলোর তথ্যও একই রকম।

গ্রন্থাগারের ইস্যুকৃত বইয়ের তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি মাসে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার থেকে মোট ২ হাজার ৫০৪ জন, ফেব্রুয়ারিতে ২ হাজার ৪৭৭ জন, মার্চে ১ হাজার ৯৭৬ জন, এপ্রিলে ৬৩১ জন, মে মাসে ১ হাজার ৮৮৬ জন, জুনে ১ হাজার ৮১৮ জন বই নিয়েছেন। বিজ্ঞান গ্রন্থাগারে জানুয়ারিতে ৬৮ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১১৬ জন, মার্চে ১২৮ জন, এপ্রিলে ৪১ জন, জুনে ৪২ জন বই নিয়েছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের অপ্রতুল আবাসন ব্যবস্থায় পড়ার পরিবেশ নেই। অন্যদিকে হলগুলোতে পাঠকক্ষও পর্যাপ্ত নয়। তাই সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গ্রন্থাগারের একটি আসন ভালো পছন্দ বটে। নিয়ম অনুযায়ী, কোনো শিক্ষার্থী গ্রন্থাগারে সকাল ৮টায় প্রবেশ করে একটি আসন নিতে পারলে সেদিন রাত ১০টা পর্যন্ত আসনটি তাঁর দখলে থাকে।

কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে গিয়ে কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয়। তারা সবাই চাকরিপ্রার্থী, পড়ছেনও চাকরির বই। শাহরিয়ার আলম নামে একজন বললেন, এখানে পড়ার পরিবেশ ভালো। এ ছাড়া এসি আছে, সবাই চুপচাপ পড়ছে। এমন পরিবেশ ক্যাম্পাসে আর কোথাও নেই।

মাশরুক হোসেন নামে একজন বলেন, অনার্স বা মাস্টার্স শেষ হওয়ার পর যখন ক্যারিয়ার ও পরিবারের চাপ বাড়ে, তখন সবাই লাইব্রেরিমুখী হয়। চাকরিপ্রার্থী ছাড়াও পরীক্ষায় ভালো ফলপ্রত্যাশীরা নিয়মিতই লাইব্রেরিতে আসেন।

এ অবস্থার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক তারিক মনজুর বলেন, বিসিএস চাকরির প্রতি তরুণদের আগ্রহ বেড়েছে। অতীতের মতো এখনও এই চাকরি সম্মানের। বেসরকারি অন্যান্য চাকরিতে যেখানে অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয়, বিসিএস পরীক্ষার ক্ষেত্রে তা লাগে না। তাই একাডেমিক পড়াশোনার চেয়েও শিক্ষার্থীরা বিসিএস প্রস্তুতিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।

এ বিষয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করে গ্রন্থাগারিক অধ্যাপক নাসির উদ্দীন মুন্সী বলেন, ‘আমাদের কষ্টটা হলো, ইউজাররা আসে না। যেসব সুবিধা আমরা দিয়ে রাখছি, তারা যদি বারবার আসত! আমাদের সার্কুলেশন ডেস্কে জিজ্ঞেস করলে তারা গ্রন্থাগার ব্যবহার শেখাবে, তা না হলে আইটি আছে, পাঠ বিভাগ আছে– সবাই শেখাবে। আমরা চাই শিক্ষার্থীরা এসব ব্যবহার করুক। কিন্তু আমাদের কম্পিউটারগুলো, রিসোর্সগুলো খালি পড়ে থাকে।’

তিনি বলেন, বাজারে এখন প্রতিযোগিতা বেশি। তাই দ্বিতীয় বর্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের মধ্যে চাকরির মানসিকতা তৈরি হয়। ফলে চাকরির বিষয়ে পড়ে।

সুবিধা জানেন না শিক্ষার্থীরা

কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে বই ও জার্নালের সংগ্রহ সাত লাখের বেশি। শুধু ২০২১-২২ অর্থবছরে গ্রন্থাগারের জন্য ২ হাজার ৭৯৩টি নতুন বই কেনা হয়েছে। গ্রন্থাগারে স্যাজ পাবলিকেশন, স্প্রিংগার, পিয়ারসন, ম্যাকগ্রিউ হিল, ক্যামব্রিজ ই-বুক অনলাইনসহ ই-বুক সাবস্ক্রিপশন আছে ৫০ হাজারেরও বেশি। ই-জার্নালের সাবস্ক্রিপশন আছে ১৬ হাজারের অধিক। বিশ্ববিদ্যালয় সার্ভারের ইন্টারনেট থেকে ফ্রিতে এগুলোর এক্সেস নেওয়া যায়। এ ছাড়া স্মার্টফোন অথবা দূরবর্তী জায়গা থেকে এক্সেসের জন্য গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষ ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড প্রদান করে থাকে। নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও গ্রন্থাগারের ডিজিটাইজড কালেকশন, দুর্লভ পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ, পুরোনো পত্রিকাসহ নানা রিসোর্স রয়েছে। তবে এগুলো শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা কমই জানেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ওরিয়েন্টেশন দেয় গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষ। তবে নতুন ক্যাম্পাসে এসে অধিকাংশই এটি বুঝে উঠতে পারেন না। ওপরের শ্রেণিতে যখন রিসোর্সের বেশি প্রয়োজন হয়, তখন এটি মনেও থাকে না। গ্রন্থাগারের সুবিধার ব্যাপারে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অধিকাংশ শিক্ষার্থী এসব বিষয়ে অবগত নন।

বিষয়টি স্বীকার করে সহকারী গ্রন্থাগারিক রুবেল মিয়া বলেন, ‘নতুন বই এলে আমরা সে তথ্য জানাতে পারি না। এ জন্য আমাদের ফেসবুক পেজ চালুর কথা রয়েছে। তাহলে শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ততা বাড়বে।’

মাস্টার দা সূর্য সেন হলের শিক্ষার্থী মনির হোসেন বলেন, গ্রামারলি চেক, কোর্সহিরো, কুইলবট– এগুলো বর্তমানে অনেক কাজে লাগে। গ্রন্থাগারে এগুলোর প্রিমিয়াম সুবিধা চালু করা উচিত। এতে সবার আগ্রহ বাড়বে। এ ছাড়া গ্রন্থাগারের প্রবেশপথে কী সুবিধা কোথায় পাওয়া যাবে– এরকম একটি বিলবোর্ড থাকলে অনেকে জানতে পারবে।

এ বিষয়ে গ্রন্থাগারিক অধ্যাপক নাসির উদ্দীন মুন্সী বলেন, ‘কেউ সাবস্ক্রিপশনের বিষয়ে জানালে এবং অনেকের চাহিদা থাকলে আমরা চালু করার চেষ্টা করব।’

বাংলা বিভাগের অধ্যাপক তারিক মনজুরের মতে, শিক্ষার্থীদের লাইব্রেরিমুখী করতে হলে একাডেমিক পড়াশোনার ধরনে পরিবর্তন আনা দরকার। তবে এর চেয়েও বেশি দরকার বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্ন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা। গতানুগতিক ধারার প্রশ্নে মুখস্থবিদ্যা যাচাই করা হয়। পিএসসি এরকম প্রশ্ন যতদিন করবে, ততদিন শিক্ষার্থীদের চাকরির বই থেকে বের করে আনা কঠিন হবে।