- ঈদ আনন্দ
- 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো' গানের নির্মাণকলা
গান
'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো' গানের নির্মাণকলা

বাংলাদেশের কাউকে যদি প্রশ্ন করা হয় আমাদের জাতীয় সংগীত বাদে আর কোন গানটি তিনি সর্বাধিকবার শুনেছেন এবং প্রথম দুই কলি অন্তত মনে মনে হলেও গেয়েছেন- তবে তার উত্তর হবে 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি'।
'একুশের চেতনা'য় উজ্জীবিত হয়েই বাঙালির রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সবশেষে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে রূপ নেয়। বায়ান্ন'র ভাষা আন্দোলনও এক অর্থে ছিল স্বাধীনতার সংগ্রাম-মাতৃভাষায় কথা বলার, সংস্কৃতি চর্চার এবং দাপ্তরিক কাজ করার দাবিসংবলিত একধরনের মুক্তিযুদ্ধ।
মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার সংগ্রামে রাজপথে যেমন ফুঁসে উঠেছিল ছাত্রসমাজ ও আমজনতা, তেমনি সংস্কৃতিসেবীদের সংবেদনশীলতায় অপ্রতিরোধ্য অভিঘাত তৈরি করেছিল ভাষা আন্দোলন। আক্রান্ত হয়ে সৃষ্টিশীল বাঙালিমাত্রই মাতৃভাষার প্রতি তাদের ভালোবাসার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। সাহিত্যের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়- 'একুশের চেতনা' বলতে আমরা যা বুঝি তা সংস্কৃতিবান বাঙালি-মানসে সঞ্চারিত করার কাজে নেতৃত্ব দিয়েছেন কবি হাসান হাফিজুর রহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ ও আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ। কবি ও প্রাবন্ধিক হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদনায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছে একটি সংকলন যার পথ ধরে আজও একুশ এলেই জাতীয় পর্যায়ের নানা সংগঠন থেকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সংস্কৃতিবান কিশোর-কিশোরীও কখনও একক উদ্যোগে, কখনও তাদের সংগঠনের ব্যানারে, বাংলা ভাষাবিষয়ক লেখা নিয়ে প্রকাশ করে আসছে 'একুশের সংকলন' নামের অজস্র পুস্তিকা।
বাঙালির মানসলোকে 'একুশের চেতনা' সঞ্চারিত করার ক্ষেত্রে উপর্যুক্ত তিন কবির পর অনন্য ভূমিকা রেখেছেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তার 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি' গানটি রচনা করে। এই গান রচনার মাধ্যমে তিনিও হয়ে উঠেছেন একুশের চেতনা-সঞ্চারী অগ্রপথিকদের একজন। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী মূলত সাংবাদিক হিসেবে সমধিক পরিচিত হলেও এই গানের নির্মাণশৈলী সাক্ষ্য দেয়, তিনি অত্যন্ত ছন্দসচেতন একজন কবিও বটেন।
আমাদের দেশে কবিতা ও কথাসাহিত্য নিয়ে মূল্যায়নধর্মী লেখা রয়েছে, বিস্তর কিন্তু আমাদের পণ্ডিতসমাজ গান নিয়ে লেখালেখি করতে অতটা আগ্রহী নন। 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি' গানটির ইতিহাস নিয়ে বেশকিছু লেখা রয়েছে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে 'মূল্যায়নধর্মী' কোনো লেখা আমার চোখে পড়েনি। বর্তমান লেখায় আমি এই গানটির নির্মাণকলা বিষয়ে কিছু তথ্য-উপাত্ত বিশ্নেষণ করে দেখাতে চেয়েছি। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর সময়ে অর্থাৎ পঞ্চাশের দশকে গান লেখা হতো মূলত স্বরবৃত্ত ছন্দে; গান রচনার ক্ষেত্রে মাত্রাবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্ত ছন্দ তখন ছিল খুবই অবহেলিত। 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি' গানটি সে-বিবেচনায় এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। ৬ মাত্রার মাত্রাবৃত্তীয় চালে রচিত এই গানের কলিতে অপূর্ণপর্ব তৈরিতে বেশকিছুু মধ্যখণ্ডনও ব্যবহূত হয়েছে, যা পঞ্চাশের দশকের প্রেক্ষাপটে অভাবনীয়ই বলা যায়:
আমার ভাইয়ের (৬)/ রক্তে রাঙানো (৬)/ একুশে ফেব্রু (৬)/-য়ারি (২)
আমি কি ভুলিতে (৬) পারি (২)।
ছেলে হারা শত (৬)/ মায়ের অশ্রু (৬)/ গড়া-এ ফেব্রু (৬)/-য়ারি (২)
আমার (৩)/ সোনার দেশের (৬)/ রক্তে-রাঙানো (৬)/ একুশে ফেব্রু (৬)/-য়ারি (২) আমি কি ভুলিতে (৬) পারি (২)।
'ফেব্রুয়ারি' শব্দটি মধ্যখণ্ডিত হয়ে তিন মাত্রার 'ফেব্রু' তিন-মাত্রার 'একুশে'র সঙ্গে মিলে ৬ মাত্রার পূর্ণপর্ব তৈরি করেছে, আর খণ্ডিত 'য়ারি' তৈরি করেছে ২ মাত্রার অপূর্ণপর্ব ('আমার' ৩-মাত্রার অতিপর্ব)। একইরকম মধ্যখণ্ডনসংবলিত পর্ববিন্যাস লক্ষণীয় প্রথম অন্তরায়:
জাগো নাগিনীরা (৬)/ জাগো নাগিনীরা (৬)/জাগো কালবোশে (৬)/- খীরা (২)[মধ্যখণ্ডিত 'কালবোশেখীরা']
শিশু হত্যার (৬)/ বিক্ষোভে আজ (৬)/ কাঁপুক বসুন (৬)/-ধরা (২) [মধ্যখণ্ডিত 'বসুন্ধরা'] এবং পরে দেশের ভাগ্য (৬)/ ওরা করে বিক (৬)/ রয় (২) [মধ্যখণ্ডিত 'বিক্রয়']।
শহীদদের আত্মত্যাগের মহিমা প্রকাশ করতে গিয়ে যে শোকের আবহ তৈরির প্রয়োজন ছিল তাতে ধীর লয়ের ৬ মাত্রার মাত্রাবৃত্তীয় চালের বিকল্প ছিল না। আমাদের অধিকাংশ গানে ব্যবহূত স্বরবৃত্তীয় লঘু চাল এই গানে ব্যবহূত হলে এই শোকের আবহ তৈরি করা আলতাফ মাহমুদের মতো দক্ষ সুরকারের পক্ষেও সম্ভব হতো না। আধেয় নিজেই নির্ধারণ করে দেয় আধার- এই সত্যের প্রকাশ ঘটেছে এই গানটিতেও।
শুরুটা (অস্থায়ী) অলঙ্কারহীন সরল উক্তিসর্বস্ব, প্রথম অন্তরাও তাই কিন্তু "সেদিনও এমনি (৬)/ নীল গগনের (৬)/বসনে শীতের (৬)/ শেষে (২)/ রাত-জাগা চাঁদ (৬)/ চুমো খেয়েছিল (৬)/ হেসে (২)/ পথে-পথে ফোটে (৬)/ রজনীগন্ধা (৬)/ অলকানন্দা (৬)/ যেনো (২)/ এমন সময় (৬)/ ঝড় এলো এক (৬)/ ঝড় এলো খ্যাপা (৬)/ বুনো'' (২) অংশে এসে আমরা দেখি সমাসোক্তি ও উৎপ্রেক্ষার মতো অলঙ্কারসমৃদ্ধ প্রকাশভঙ্গি। বাঙালির মানসলোকে যতদিন 'একুশের চেতনা' জাগ্রত থাকবে, ততদিন এই গানের মৃত্যু নেই। অন্তত এই একটি গানের কল্যাণেই অমরত্ব লাভ করবেন এর রচয়িতা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী আর সুরকার আলতাফ মাহমুদ।
লেখক
কবি
মন্তব্য করুন