সকাল ১০টায় সুইডিশ রাষ্ট্রদূত Johan Frisell-এর ই-মেইল পেলাম। সময়টি ছিল ২০১৬ সালের মে মাসের ১০ তারিখ। উনি লিখেছেন ’Dear Aireen, your Visa is now ready. I apologize for the delay’-স্বস্তির একগুচ্ছ সুবাতাস আমায় ভরিয়ে তুলল। ঐদিন রাত তিনটা এয়ারপোর্টের উদ্দেশে রওনা হতে হবে। আমার গন্তব্য স্লোভেনিয়ার রাজধানী লিউবিয়ানা। সেখানে ৪৮তম পেন ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্সে অফিসিয়াল ডেলিগেট হিসেবে যোগদান করব। পেন ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন স্লোভানিয়া পেনের সেক্রেটারি জেনারেল তানিয়া তুমা। ৮১তম পেন ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেসে কানাডার কুইবেক অ্যাসেমব্লি হাউসে নেটওয়ার্কিং সেশনে আমাদের পরিচয় গভীর হয়। ইস্তাম্বুল হয়ে স্লোভেনিয়ার ফ্লাইটে আরোহণ করলাম। আমার পাশে বসা স্লোভেনিয়ার এক চৌকস নারী বই পড়ছিলেন। আমিই নীরবতা চূর্ণ করে উনার সঙ্গে কথা বললাম। আমার পরিচয় জানার পর উনি আগ্রহী হয়ে উঠলেন পেন ইন্টারনাশনাল প্রেডিসেন্ট জেনিফার ক্লিমেন্ট সম্পর্কে। কারণ পেন ইন্টারন্যাশনালের ইতিহাসে জেনিফারই প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট।
৩০ সেকেন্ডের মধ্যে ইমিগ্রেশন পার হয়েই দেখতে পেলাম একজন স্লোভেনিয়ান আমার নাম লেখা প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। ছোট্ট এবং মনোরম এয়ারপোর্ট থেকে বের হলাম সন্ধ্যা ৮টায়। স্লোভেনিয়ায় তখনও বিকেল। সূর্যের আলো প্রকৃতির সঙ্গে আলাপচারিতায় মেতে আছে। এই প্রথম ইউরোপের ভূমিতে আগমন ঘটল। শেষ বিকেলের আলো ঈষৎ বরফাচ্ছাদিত ছোট ছোট টিলার ওপরে পড়ে হীরকের দ্যুতি ছড়িয়েছে। ড্রাইভার জানাল- গত রাত থেকেই বরফ পড়া শুরু হয়েছে। চলার পথ যথেষ্ট ফাঁকা এবং জনমানব স্বল্পতার কারণে কখনও কখনও রাজধানী মনে হয়নি। লতাগুল্ম আর সবুজের সমারোহে পরণকথার ছোঁয়া অনুভব করছিলাম। ব্লেড আইল্যান্ড ঘেঁষা হোটেল পার্ক, ব্লেডে পৌঁছলাম সন্ধ্যায়। ফ্রন্ট ডেস্কের কাজ শেষ করে রুমে লাগেজ রেখে ডাইনিংয়ে এলাম। তখন আগত অতিথিদের ডিনার শেষের পথে। স্লোভেনিয়া পেনের প্রেসিডেন্ট এভাল্ড ফ্লিসার নিজেই এসে পরিচিত হলেন। জাপান পেনের জয়েন্ট সেক্রেটারি জেনারেল ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসে আমার সঙ্গে কথা বলছিলেন ডিনারের সময়। জাপানিদের ভদ্রতা প্রশ্নাতীত। ১৩ তারিখ সকালে Writers for Peace-কমিটি আয়োজিত Round Table-কনফারেন্সে আমাকে একটি পেপার প্রেজেন্ট করতে হবে। বিষয় : We are all migrants-terrorism everywhere. ১৯৮৪ সালে পূর্ব-পশ্চিম ঠান্ডা লড়াইয়ের সময় writers for peace-কমিটি গঠিত হয় এবং স্লোভানিয়ায় প্রতি বছর কনফারেন্সটি অনুষ্ঠিত হয়। কনফারেন্সে অধিকাংশ ডেলিগেট ইউরোপ থেকে অংশগ্রহণ করেছেন। বাংলাদেশ থেকে আমিই প্রথম অংশগ্রহণ করলাম। হলের প্রবেশদ্বারে পেন ইন্টারন্যাশনালের নির্বাহী পরিচালক কার্লেস টোনারের সঙ্গে দেখা হলো। পেন ইন্টারন্যাশনাল প্রেসিডেন্ট জেনিফার ক্লিমেন্ট হল রুমে ঢুকতেই আমরা আলিঙ্গনাবদ্ধ হলাম। উনি হাসতে হাসতে বললেন, 'তোমার ভীষণ সাহস, তুমি বাংলাদেশের মতো জায়গায় বসবাস করে চারমন্থিদের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়ে যাচ্ছ।' writers for peace-কমিটির তিনটি সেশনের মধ্যে এটি শেষ সেশন। সেশনে সময়ের স্বল্পতার কারণে বক্তব্য সংক্ষেপ করার কথা বলা হয়েছিল। তবে আমি বাংলাদেশের পরিস্থিতি পুরোটাই জানিয়েছিলাম যেন অন্যান্য পেন সেন্টার বাংলাদেশের লেখক, ব্লগার, প্রকাশক এবং মুক্তচিন্তকদের সার্বিক সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে পারে।
কনফারেন্স শেষে ফ্রন্ট ডেস্ক থেকে একজন ভদ্রমহিলা আমাকে জানাল- পেন ইন্টারন্যাশনাল প্রেসিডেন্ট জেনিফার ক্লিমেন্টের জন্য ব্লেড লেকে একটি স্পেশাল ভ্রমণসূচি রয়েছে। জেনিফার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন- আমি যেন উনার ভ্রমণসঙ্গী হই। লেকে যথেষ্ট ঠান্ডা। আমাকে রুম থেকে গরম কাপড় আনতে হবে। জেনিফার নিজেও আমার সঙ্গে কথা বললেন। আমার ফ্লাইটে বিভ্রাট ঘটেছে। ১১ তারিখে প্লেনে ত্রুটি দেখা দেওয়ায় ফ্লাইট বাতিল হয়েছে। আমি ১২ তারিখ ভোরে আমার গন্তব্যে রওনা হতে পেরেছি। নানা মানসিক অস্থিরতা এবং ক্লান্তি সঙ্গে করে আমি কনফারেন্সে যোগ দিয়েছি। আমি যদি সুস্থির বোধ করি তবে যেন উনর সঙ্গে ব্লেড লেকে ভ্রমণে অংশ নিই। আমি অনুগামী হলে উনার খুব ভালো লাগবে। বিষয়টি আকস্মিক। পুরোটাই অপ্রত্যাশিত এবং অনেকটা বহু আকাঙ্ক্ষিত লটারি জেতার মতো। তাবৎ ডেলিগেটসের ভেতর থেকে উনি আমাকে সঙ্গী হিসেবে পছন্দ করেছেন এটি নিশ্চয় আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি ও অর্জনের একটি এবং নিরন্তর সুখস্মৃতি হিসেবেই আমি আমার শ্বাস-প্রশ্বাসের গহিনে লালন করব। পেপার উপস্থাপন করেছি প্যান্ট আর হাফস্লিপ ফতুয়া পরে। ভাগ্যিস শাড়ি পরার সময় মেলেনি। একজন প্রফেশনাল ট্যুর গাইড এবং বড় একটি গাড়ি অপেক্ষা করেছিল জেনিফারের জন্য। হোটেল লবির সামনে থেকেই আমরা গাড়িতে উঠলাম। হোটেল থেকে বেরিয়ে হাতের ডানে ১ মিনিট হাঁটলেই ব্লেড লেক কিন্তু জেনিফারের জন্য ট্যুরটি যেভাবে সাজানো হয়েছিল তাতে বেশ খানিকটা সময় ড্রাইভ করে ট্যুর গাইড গন্তব্যে পৌঁছালেন। শান বাঁধানে বিশাল ঘাট। ঘাটের অদূরেই মার্শাল টিটোর বাড়ি। ব্লেড লেকটি উত্তর-পশ্চিম স্লোভেনিয়ার উচ্চ কার্নিওলান অঞ্চলের জুলিয়ান আল্পসের একটি হ্রদ। হ্রদটি লম্বায় প্রায় সাত হাজার ফুট, চওড়ায় সাড়ে চার হাজার ফুট এবং এর পানির গভীরতা ৯৭ ফুট। হ্রদটির বামে রয়েছে চার্চ এবং ডানে ক্যাসেল। চার্চ এবং ক্যাসেল দেখলে মনে হবে- এ দুটিই বিশাল জলরাশির মাঝে ভেসে আছে। পুরো লেক বেষ্টন করে যে রাস্তা, তা পায়ে হেঁটে প্রদক্ষিণ করতে ঘণ্টা দুয়ে সময় লাগে।
মূলত টিটোর বাড়ির আঙিনার সামনে থেকেই আমরা নৌকায় উঠলাম। পুরো আঙিনাজুড়ে নানা জাতের এবং আকৃতির ফুলের গাছ। হলুদ ফুলই কেন যেন সেখানে প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। গুল্মজাতীয় গাছ রূপকথাময় শৈশবের আকুলতা জাগাল মনে। নৌকা এবং নৌকার মাঝি দুই-ই আমাদের নদীমাতৃক দেশের নৌকা এবং মাঝির মধ্যে একটা অন্তরাল সৃষ্টি করল। ট্র্যাডিশনাল এই নৌকাকে স্লোভেনিয়ায় Pletna বলা হয়। নৌকাটি দেখার মতো এবং বসার স্থানটিও ভীষণ পরিপাটি ও পরিচ্ছন্ন। সেই সঙ্গে নৌকার মাঝিও মার্জিত পোশাক পরা আধুনিক মানুষ। আমাদের গন্তব্য চার্চের দিকে। লেকের চারিদিকের গাছপালা যেন লেকটিকে আলগোছে জড়িয়ে রেখেছে। স্বচ্ছ জলরাশির ওপরে খণ্ড খণ্ড মেঘের চলাফেরা এবং অপরূপ আবহে মগ্ন করে রেখেছে। নির্মল এবং হিমেল বাতাসে সূর্যের আলোর ছটা জীবনানন্দের কবিতার পঙ্‌ক্তি মনে জাগিয়ে দিয়েছে :'এ-বাতাস কি পরম সূর্যকরোজ্জ্বল'; হাঁসেদের চলা, রঙিন গাছেদের পানিতে হেলে পড়া, পদ্ম জাতীয় জলজ উদ্ভিদের উপস্থিতি- এসবই ব্লেড লেককে ভিন্ন মাত্রা এনে দিয়েছে। প্রকৃতির ইত্যাকার পুলক আমাদের মনও উন্মাতাল করেছিল। আমি আর জেনিফার গল্পের ফোয়ারায় মেতে উঠেছিলাম। আমরা পাশাপাশি বসে প্রজাতির মতো নির্ভার হয়ে কথা বলছিলাম। ট্যুর গাইড আমাদের উল্টো দিকে বসে। আমরা ১৫ শতকের একটি চার্চে যাবো। চার্চে ওঠার সিঁড়ি অনেক উঁচু এবং বিস্তৃত। ৫০০ বছর পূর্বের ঐতিহ্য এবং আবহ সমুন্নত রাখতেই হয়তো সিঁড়িগুলো সংস্কার করা হয়নি। এই সিঁড়িকে কেন্দ্র করে স্লোভেনিয়াদের মধ্যে একটি উপকথা প্রচলিত রয়েছে। কোনো স্বামী তার স্ত্রীকে একটি বিশেষ কাঠামোয় তৈরি কাঠের বড় টুকরোর ওপরে বসিয়ে নিজে কাঁধে করে এই চার্চের সবগুলো সিঁড়ি টপকাতে পারলে- সেই দম্পতির সংসার সুখের হবে আর যদি স্বামীর কাঁধ থেকে স্ত্রী পড়ে যান তবে তাদের দাম্পত্য সুখের হবে না। এসবই ট্যুর গাইড বলেছিল। এই বিষয়ে অঙ্কিত পোট্রেটের রেপ্লিকা ওখানে দোকানে বিক্রি হয়। এই হাতে তৈরি পোট্রেট আমিও সংগ্রহ করলাম। চার্চটির চারপাশ ঘিরে প্রচুর বৃক্ষ এবং পত্র-পল্লবের সমাহার। চার্চের আঙিনায় ট্যুরিস্টদের বিশ্রাম নেবার স্থান রয়েছে। চার্চের মনোরম প্রকৃতি আমাদের নৈসর্গিক আনন্দ এবং শান্তি প্রদান করেছে। এই চার্চের সঙ্গে ছোট এবং অনিন্দ্য সুন্দর একটি জাদুঘর রয়েছে। স্লোভেনিয়ানদের অতীত ইতিহাস সেখানে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। ঐতিহাসিক চরিত্রেরা এই জাদুঘরে টেপা পুতুরের ভেতর দিয়ে পুনরুজ্জীবিত হয়েছেন নানা রং, রেখা এবং আকৃতির লাবণ্যে। জেনিফার এবং আমি চার্চে গেলাম এবং একসঙ্গে ঘণ্টা বাজালাম। ট্যুর গাইড আমাদের ওয়ালনাট সমৃদ্ধ কেক খাইয়ে আপ্যায়ন করলেন।
ফেরার পথে আমরা মার্শাল জোসিপ ব্রজ টিটোর বাড়ি পরিদর্শন করলাম। তিনি যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। আয়তাকার বাড়ির নিচতলার দেয়াল এবং ছাদজুড়ে চিত্রিত হয়েছে মার্শাল টিটোর বীরত্ব গাথা আর উপরের তলাসমূহে রয়েছে টিটো এবং তার পরিবারের ব্যবহূত আসবাবপত্র, পোশাক, তৈজসপত্র এবং অন্যান্য দ্রব্যাদি।
হোটেলে ফিরে ঝটপট লাঞ্চ সেরে আমরা পুরোনো শহর দেখতে রওনা হলাম। এখানেও জেনিফার আমার সঙ্গেই বসলেন। সন্ধ্যার প্রোগ্রামের পূর্বেই আমরা লিউবিয়ানা ফিরে আসবো। গন্তব্যে পৌঁছাবার পূর্বে পুরোনো শহর আমরা বাসে করে ঘুরলাম। আমি বিস্ময়বোধ নিয়ে সবকিছু অবলোকন করছি। রাস্তা, বাড়ি, গাছপালা, বাতাস, রোদ- সবকিছুর ভেতর ইউরোপকে খুঁজে পেতে চাইছি। পথে একটি কপিশপে নেমে আমরা কফি এবং কেক খেলাম। ইতিমধ্যে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হলো। আবার তা থেমেও গেল। বিকেল ৬টায় আমরা ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরিতে এলাম। করিডোর থেকে লাইব্রেরি দেখতে পেলাম।
রিডারদের আসনের অংশটি ছোট কাচের দেয়াল দিয়ে ঘেরা। বসার স্থানটি বেশ উঁচু এবং মাথার ওপরে লাইট জ্বলছে। শুধু পাঠকের মাথা দেখা যাচ্ছে। আমরা সেখানে নীরবতা অবলম্বন করলাম। লাইব্রেরির নিচতলায় স্লোভেন পেনের ৯০ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে। নব্বই বছর পূর্বের চিঠিপত্র এবং নানা অফিসিয়াল কাগজপত্র প্রদর্শনীর জন্য রাখা হয়েছে। প্রদর্শনীটি উদ্বোধন করতে সংস্কৃতিমন্ত্রী এসেছিলেন। তবে উনাকে ঘিরে আপাত আড়ম্বর এবং চাটুকারিতা ছিল না। বিকেল ৬-৩০টায় পেন ইন্টারন্যাশনাল প্রেসিডেন্ট জেনিফার ক্লিমেন্টের সঙ্গে ছিল লিটারারি ইভনিং। মডারেটর ছিলেন তানিয়া তুমা। জেনিফারের লেখা উপন্যাসের নির্বাচিত অংশ একজন তরুণী পড়ে শোনালেন। শেষে তানিয়া তুমা জেনিফারের সাম্প্রতিক লেখা নিয়ে কথা বলেছিলেন। জেনিফার ক্লিমেন্ট মূলত ঔপন্যাসিক। তার লেখা উপন্যাসের মধ্যে উল্লেখযোগ্য : ‘The Posion That Fascinates,’ ‘PRAYERS for the STOLEN’ ‘GON LOVE’, ‘Widow Basquiat’. সন্ধ্যা ৭-৩০ মিনিটে লিউবিয়ানার মেয়রের দেয়া নৈশভোজে আমরা যোগ দিলাম। নৈশভোজে ফরাসি লেখক দম্পতির সঙ্গে নানা বিষয়ে গল্প জমলো। খাবার পরিবেশিত হয়েছে বিচিত্র ধারায়। ছোট ছোট প্লাস্টিকের বাটিতে নানা রকমের খাবার। চিকেন, নানা জাতের শিম বীজ এবং ডাল, ফল, টমেটো, আলু এবং ডিম ছোট ছোট টুকরো করে বাটিতে সাজানো যা দেখলেই মন ভরে যায়। ছোট চামচ দিয়ে আমরা সেসব উপভোগ করলাম। সঙ্গে আপেল, কমলা এবং আনারসের জুস। এভাবে পরিবেশিত খাবার কানাডার কুইবেকে জাহাজে বসে খেয়েছিলাম। ওই দিন হোটেলে ফিরে তানিয়া তুমার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হলো। অন্যরাও ছিলেন হোটেল লবিতে। ইরাকি একজন ব্লগার এসাইলামে স্লোভেনিয়ায় আছেন- তার সঙ্গে কথা হলো। জেনিফার কারলেস এবং অনেকে ১৪ তারিখ সকালে লন্ডন যাবেন। ওখানে হেডকোয়ার্টারে বোর্ড মিটিং রয়েছে। ১৪ মে সকালে লিউবিয়ানা শহরে দেখতে দেখতে রওনা হলাম। প্রোগ্রাম ভলান্টিয়ার স্লোভেনিয়ার মেয়ে ক্রিস্টিনা বসেছিল আমার পাশে। ওর পিতা কবি। ক্রিস্টিনার মা নেই, পিতাই ওদের তিন ভাইবোনকে বড় করেছেন। ক্রিস্টিনাকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে তিন ছেলের জননী। আজ সকলেই খুব আনন্দ করছে। এই পথে আমরা গতকালও গেছি- কাজেই সব চেনা। পথে একটি বড় কফিশপে যাত্রাবিরতি হলো। এই প্রথম ব্রেড খেলাম রোজমেরি পাতা এবং লবণ সহযোগে। সেখানে গান এবং স্বরচিত কবিতা পাঠের আয়োজন ছিল। দুপুরের আগে আমরা একটি পুরোনো চার্চে গেলাম। অনেকটা পথ অত্যাধুনিক বাসে দেশটির প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে চলেছি। একজন ট্যুর গাইড আমাদের সঙ্গে আছেন। স্বাভাবিকভাবেই তার মুখ দিয়ে খই ফুটছে। উনার কথা থেকে একটি চমকপ্রদ তথ্য পেলাম। আমি জানি আলফ্রেড নোবেল বিয়ে করেননি এবং তিনি তার ব্যক্তিগত সেক্রেটারি বার্থাকে ভালোবেসে ছিলেন। যদিও বার্থার অন্যের সঙ্গে প্রণয় থাকার কারণে সম্পর্কটি বিয়ের পথে যাত্রা করেনি। ট্যুর গাইডের বক্তব্য অনুসারে নোবেল এক নারীকে বিয়ে করেছিলেন এবং তিনি কোনো একটি হোটেলে রাত্রি যাপনের সময় নিজের নামের সঙ্গে আলফ্রেড নোবেলের নামটি যুক্ত করেছিলেন। পৌঁছে গেলাম চার্চে। চার্চটি বেশ উঁচুতে। প্রাচীনতা এবং ঐতিহ্য অটুট রেখেই এটি ট্যুরিস্টদের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। চার্চের একটি পাশ থেকে পুরোনো শহরটি পুরোটা দেখা যায়। একটি বিয়ের প্রস্তুতি চলছিল। ফেরার পথে ফিটফিটে সাদা পেশাক পরিহিত কনেকে দেখতে পেলাম। এখন গ্রামীণ পথ ধরে আমরা শহরের দিকে যাচ্ছি। অচেনা গাছপালা, নব নব পাতা এবং ফুলের সঙ্গে নিত্যই পরিচয় ঘটেছে। উত্তুঙ্গ বাতাস। সহনীয় শীত, উজ্জ্বল রোদ এবং পরিবেশে বিদ্যমান স্নিগ্ধতা ছিল উপভোগ করার মতো। দুপুরের খাবারের আমন্ত্রণ পেয়েছি আমার ক্যানকোভা শহরের মেয়রের কাছ থেকে। একটি ঝকঝকে এবং আধুনিক হোটেলে লাঞ্চের জন্য যাত্রাবিরতি হলো। তিন দিকে কাচ দিয়ে ঘেরা প্রশস্ত একটি কক্ষে লম্বা টেবিলের চারপাশে আমরা আসন গ্রহণ করলাম। এই কক্ষের সঙ্গে রয়েছে গাছপালা পরিবেষ্টিত একটি লন। এক কথায়, চমৎকার একটি নান্দনিক পরিবেশ। নানা সাইজের এবং ভিন্ন স্বাদের ব্রেড টেবিলে রাখা ছিল। অনিন্দ্য সুন্দর ওভাল শেপের বড় প্লেটে পাতা এবং ফুল সহযোগে খাবার পরিবেশিত হলো। প্লেট এবং ডেকোরেশন উভয়ই খাবারে ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছিল। লাঞ্চ শেষ করে আমরা গেলাম স্লোভেনিয়ার সর্ববৃহৎ মধ্যযুগীয় ক্যাসেলে। সেখানে একটি চমৎকার জাদুঘর রয়েছে। জাদুঘরের সামনে বিশাল এক ফোয়ারা। জাদুঘরের এই অংশটি রোমান সভ্যতার স্বাক্ষর বহন করছে। রোমানদের স্থাপত্যশৈলীর নানা নিদর্শন এখানে রয়েছে। বিশেষ করে বাড়ি নির্মাণের। অত্যন্ত সযত্নে পুরু কাচের ভেতরে সেসব নিদর্শন সংরক্ষিত রয়েছে। স্লোভেনিয়া রোমান সাম্রাজ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং প্রচীনকালের ঊসড়হধ শহরটিও লিউবিয়ানায় অবস্থিত। অদূরেই অন্য একটি জাদুঘর। বিশাল স্থানজুড়ে অবস্থিত এলাকাটিতে সবুজের সমারোহ এবং জলের প্রবাহ বিদ্যমান। আমরা বিকেলে সেখানে বসে আড্ডা দিলাম। জাদুঘরের প্রাচীন রোমন সাম্রাজ্যের নানা নিদর্শন দেখার পাশাপাশি আম্রকলিন নামক একজন নারীর জীবনযুদ্ধের নানা চিত্র দেখতে পেলাম। আম্রকলিনের মা দেখতে খুব সুন্দরী ছিলেন আর আম্রকলিন দেখতে অসুন্দর বলে তার মা তাকে (আম্রকলিন) খুব অপমান ও অনাদর করত। আম্রকলিন মায়ের চোখে সম্মান পাবার জন্য নিজেকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি অনেক দেশ ভ্রমণ করেছেন। বাংলাদেশেও এসেছিলেন। উনি রমনা পার্কে বসে আছেন এমন একটি ছবি দেখলাম। তার বৈবাহিক জীবনও সুখের হয়নি।
১৫ মে ব্রেকফাস্টের পরে সকলেরই ফিরতি যাত্রা। স্লোভেনিয়ার আশপাশের দেশ থেকে যারা এসেছেন তারা ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে এসেছেন। ডাইনিংয়ে বিদায়ী আড্ডা ভালোই জমে উঠল। বড় হোটেলের বুফে আসলেই এনজয় করার মতো। স্লোভেনিয়ার মধু পৃথিবী বিখ্যাত। মধু, জ্যাম, নানা স্বাদের ব্রেড সবই খুবই লোভনীয়। ব্লুবেরি এই প্রথম খেলাম।
সকলে হোটেল ছেড়ে যাবার পর স্বাভাবিকভাবেই মনটা উদাস হলো। একা একাই বেরিয়ে পড়লাম। লেকের ধার ঘেঁষে হাঁটছি। একটি অংশে নানা প্রজাতির এবং ভিন্ন ভিন্ন রঙের  Forget me-not ফুলের দেখা পেলাম। এই ফুলের নাম শুনেছি ভাষাবিজ্ঞানে এমএ পড়ার সময় ক্লাসে শিক্ষক যখন Infix/ মধ্যসর্গ পড়িয়েছিলেন। অভিভূত হয়ে দেখেই চলেছি এই পুষ্পকন্যাদের। ব্লেড লেক এবং অসংখ্য Forget me-not ফুলের মাচার মাঝে ঝকঝকে একটি পথে আমি দাঁড়িয়ে আছি অদ্ভুত এক অনুভূতি নিয়ে।
অফ হোয়াইটের সঙ্গে নীল অথবা বেগুনি রঙের সংমিশ্রণে ফোটা ফুলেদের রূপের বর্ণনা দেওয়া সহজ নয়।
ফিরে এলাম হোটেল পার্কে। রুমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখার মতো অনেক কিছুই ছিল। সামনের গাছপালা এবং নিচে রাস্তার দিকে তাকালে মনে হয় আমি একটি গ্রামে আছি। বাম দিকের পথটি আমি শেষ বিকেলে খুব আগ্রহ নিয়ে দেখছিলাম। পথটি সরু এবং সেটি পাহাড়ি পথ বলে মনে হয়। পাশাপাশি সেটি নির্জনও। সেই নির্জন পথে বসে থেকে শুরু করে সব ধরনের যানবাহন চলছে। একমুখী পথ বলেই মনে হলো। ওখানে দাঁড়িয়ে একজন খুব সাধারণ স্লোভেনিয়ানের সঙ্গে কথা হলো। উনি বাংলাদেশ সম্পর্কে আগ্রহ প্রকাশ করলেন।
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। উদর জানান দিচ্ছে তার কিছু জ্বালানি প্রয়োজন। ব্লেড লেক থেকে ৫০ গজ এগিয়ে বাম দিকে একটি রেস্টুরেন্ট রয়েছে এমন নির্দেশনা দেখতে পেলাম। এখানে গ্রিল খাবার পরিবেশন করা হয়। রেস্টুরেন্টে পৌঁছে খাবার অর্ডার করলাম। বড় এক টুকরো চিকেনের সঙ্গে কিছু সবজি গ্রিল করে আমাকে পরিবেশন করল। অনেক বড় সাইজের রুটি কেটে টুকরিতে করে দিল। টেবিলে লবণ রাখা আছে। হোয়াইট সস মূল খাবারের সঙ্গেই পরিবেশন করেছে। ১২ ইউরো খরচ হলো।
সকালে ফ্লাইট তাই রুমে যাবার আগেই রিসেপশনে কথা বললাম। ইনচার্জকে জানালাম আমি ৭টায় হোটেল থেকে চেক আউট করব। কাজেই পরের দিনের ব্রেকফাস্ট তারা সকাল ৬-৩০টায় সার্ভ করতে পারে কিনা? সঙ্গে যেন ব্লুবেরি থাকে। উনি হেসে জানালেন- পরের দিনের মেন্যুতে ব্লবেরি থাকার কথা নয়, তবে আমার জন্য দুটো বিষয়ই নিশ্চিত করা হবে। সকাল ৬-৩০টায় ব্রেকফাস্ট সম্পন্ন করে ৭টায় হোটেল লবিতে এসে দেখতে পেলাম ড্রাইভার এসে গেছে আমাকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেবার জন্য। ছোট এবং অপরূপ সুন্দর একটি দেশকে বিদায় জানিয়ে লাল-সবুজ পতাকার উদ্দেশে যাত্রা করলাম।