
ঋতু আর মেঘ দুই বোন। দেখতে অনেকটা একরকম। তবে ঋতুর চুল কোঁকড়ানো এবং প্রচুর। মেঘের চুল লম্বা আর স্ট্রেট। দু'জনের ভাব ও ঝগড়া দুটোই আছে। মা আনোয়ারা আলো মেঘের জন্মের সময় সারা আকাশে যে গভীর ঘন মেঘ জমে ছিল, সে কথা বলেন। বলেন-
তুই যেদিন পৃথিবীতে এলি, খুব মেঘ জমে ছিল আকাশে। আমরা অবশ্য বৃষ্টির আশা করছিলাম। আগস্টের গরম চলছিল খুব।
আর আমার জন্মের সময়?
ঋতু প্রশ্ন করে।
মা একটু ভেবে বলেন-
ঋতুময় প্রকৃতি। বসন্ত ছিল সে সময়। বাগানে রডোড্রেনডন লাল ফুল ফুটে ছিল।
এরপর মা চুপ হয়ে যান। ঋতু খুশি হয়।
বসন্তকালে আমার জন্ম!
খুশি খুশি গলায় ঋতু বলে।
বাবাটা কথা নাই বার্তা নাই দুম করে মারা গেলেন। হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। এক অ্যাটাকেই শেষ হলেন মামুন হাবিব। অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের চেয়ারম্যান। ব্রেইন যার দারুণ শানিত, বিজ্ঞানী এবং নানা পরিকল্পনা। তার একটিকেও বাস্তবায়িত করার আগেই চলে গেলেন। তারপর থেকে একা মা। ওরা তখন ইউনিভার্সিটির পড়া শেষ করে চাকরি করছে। এক বছরের বড় ঋতু একটা ব্যাংকে। বিবিএ করে চাকরি শুরু করেছে। বলে-
এমবিএ পড়ে সময় নষ্ট করতে চাই না।
আর মেঘ ইংরেজিতে এমএ করে ইউনিভার্সিটিতেই এক বছর হলো জয়েন করেছে। লেকচারার।
ঋতু থাকে রাজশাহী আর মেঘ ঢাকাতে। বাবা চলে যাওয়ার পর মায়ের বোধকরি বাঁচার ইচ্ছা চলে গিয়েছিল।
মেঘ বলে-
বাবাটা ছিল মায়ের প্রাণভোমরা। ওই যে সেই গল্পটা, প্রাণভোমরাটা লুকিয়ে ছিল না কোনো এক বাক্সে, না কৌটোয়! তারপর একটু থেমে বলে-
কেন এত তাড়াতাড়ি বাবাটা চলে গেলেন। ইস!
মেঘ ভালোবাসে ক্ল্যাসিক। ঋতু রোমান্টিক। বা একটু হালকা বই। ওরা দু'জনেই বাংলা-ইংরেজি দুই ভাষারই বই পড়ে। ঋতু একটু গোলমতো। খেতে পছন্দ ওর। তাই উঠেপড়ে লেগেছে স্লিম হতে। মেঘ একেবারে স্লিম। ঋতু মেঘের মতো সোনার বোতাম নয় পড়াশোনায়। মেঘ একেবারে ব্র্রাইট আজ বাটন। মা বলেন-
মেঘ বাবার মেধা পেয়েছে।
ঋতু বলে-
আর আমি?
আমার।
মা জবাব দেন।
তুমি তো খুব ভালো ছিলে পড়াশোনায়। বলো না তোমার। তুমি একটুর জন্য ফার্স্টক্লাস মিস করেছিলে।
মা হাসেন।
তাহলে কোনো পূর্বপুরুষের মতো।
ওরা কেউ বিয়ে করেনি। মেঘ সহপাঠীকে ভালোবেসেছিল। সে এখন বাইরে গেছে পিএইচডি করতে। যদি মেঘ সুযোগ পায় যাবে। তবে পড়ানোর চাকরিটা ও বেশ উপভোগ করছে। বলে-
আমার বাইরে যাবার ইচ্ছা নাই।
ঋতু বলে-
আমার ইচ্ছা আছে, তবে সুযোগ নেই।
কেন, ব্যাংকের কর্মকর্তাকে ধরে বাইরে পোস্টিং নে।
নীরার ভাই চলে গেল ভিয়েতনামে। তুইও যেতে পারিস তেমন কোনো দেশে। ওরা দু'জন দু'জনকে নাম ধরে ডাকে। আর তুই তুই করে। সম্পর্কটা বোনের হলেও অনেকটা বন্ধুত্বের।
না রে মাকে ছেড়ে যাব না।
ঋতু বলে।
-তা ঠিক। মা যে এখনও প্রাণপ্রদীপ জ্বালিয়ে রেখেছেন সে তো আমাদের জন্যই। মেঘ থাকে মায়ের কাছে আর ঋতু রাজশাহীতে। প্রায়ই চলে আসে। তারপর দু'জনের নানা খুনসুটি, নানা ঝগড়া। ভাব আর ভালোবাসা।
মেঘ বলে-
ঋতু, তুই কী করে ট্র্যাশগুলো পড়িস রে? ডানিয়েল স্টিল, জাকি কলিন্স যতসব! 'মিলস অ্যান্ড বুনস' সস্তা রোমান্স ভাবতে পারি না। বারবারা কার্টল্যান্ডও পড়তে দেখেছি। রুচি হয় তোর?
ঋতু বলে-
আমাকে ছাত্রছাত্রী ভোলাতে বা বোঝাতে ক্ল্যাসিক পড়তে হবে না। ডিকেন্স, ইবসেন, ব্রন্টি বোনেরা, জর্জ এলিয়ট, জেন অস্টেন-এর ভারী ভারী বই। বই না থান ইট। অনেক আগে ক্ল্যাসিকের ছোটদের সংস্করণে কিছু পড়েছি। আর পড়ার দরকার নেই।
ছোটদের সংস্করণ পড়েছিস। এখন আসল বইটা পড়।
না আমার ওইসব ভারী বই পড়ার দরকার নেই। পঞ্চাশ পাতার 'মবি ডিকই গুড এনাফ'। ছয়শ পাতা পড়ার ইচ্ছা নাই।
টেলিভিশনে মেঘ যা দেখে ঋতু তা দেখে না। কাজেই ওদের দু'জনার ঘরের টেলিভিশনে ভিন্ন প্রোগ্রাম। খেতে বসলেও দেখা যাবে মেঘ যেটা পছন্দ করে, ঋতু তা নয়। ঋতু খানিকটা মাংসাশী। আর মেঘ মাছ আর সবজি। তারপরেও ওদের এইসব মিল-অমিলের ভেতর আসলে গভীর বন্ধুত্ব। ঋতু অনেক সময় এক বছরের বড় বোনের দাবিতে এটা-সেটা বলে। মেঘ কখনও তা শোনে। আবার কখনও শোনেও না। বলে-
কানের কাছ দিয়ে বড় বোন।
কানের কাছ দিয়ে?
পুরো এক বছরের বড়।
তারপর হাসাহাসি। বারো মাস তিনশ পঁয়ষট্টি দিন টাইমস ...।
দু'জনেই হাসতে থাকে।
তুই বিয়ে করবি না ঋতু?
মেঘ প্রশ্ন করে মাঝে মাঝে।
কেন করব না। বিয়ের বয়স কি গেছে?
প্রেমট্রেমও তো করলি না।
মেঘ বলে বন্ধুর মতো।
করে ফেলব একদিন ফট করে। কত লোকজন আমার ব্যাংকে আসে।
বলে ঋতু। তারপর প্রশ্ন করে-
তোর রুবায়েত কোথায় এখন?
ও চলে গেছে মিনিসোটাতে। আরও দুই বছর পর ফিরবে। আমি যাব না। চাই না বেচারি মা একা হয়ে যাক।
যেতে হলে যাবি। আমি চেষ্টাচরিত্র করে ঢাকায় বদলি হয়ে আসব।
আদুরে গলায় মেঘ বলে-
আমি মায়ের ছোট। একেবারে বেড়ালের মতো কিনা। আমাকে ফেলে মা কী করে থাকে বল?
তারপর ওরা দু'জন নিজের ঘরে চলে যায়। বাড়িটা বাবার পরিকল্পনায় তৈরি। চারটে ঘর। মা-বাবার একটা। ওদের দুই বোনের দুটো। আর একটা গেস্টরুম। বাবার পড়াশোনার জন্য একটা বক্স ঘর ছিল। এখন যা নানা হাবিজাবিতে ভর্তি। ওদের খুব ইচ্ছে আছে হাবিজাবি সারিয়ে ঘরটাকে মেঘের পড়ালেখার ঘর করবে। কোনো শ্রাবণ মেঘের দিনে মেঘ কবিতা বা গল্প লেখে। না হলে এমনি নানা মনের কথা। তবে সেটা এখনও হয়নি। মানে মেঘের সুমেরু পর্বতের ঘর। যেখান থেকে মেঘদূতের জন্ম। বাবা পুরো দুই হাজার স্কয়ার ফুটের অ্যাপার্টমেন্ট তার বন্ধুদের সঙ্গে কিনেছিলেন। এখন সেই দশতলার অ্যাপার্টমেন্টটাকে মেঘ ভীষণ ভালোবাসে। এখনও ওর বাইরে যাওয়ার ইচ্ছা নাই। জানালা দিয়ে আকাশ দেখতে দেখতে রুবায়েতের সঙ্গে কথা বলে। সুন্দর সুন্দর বাণী পাঠায়। গান গেয়ে কখনও শোনায়। আর রুবায়েতের কবিতা আবৃত্তি শোনে। ভালোই চলছে ওদের দূরে থাকার সময়।
মেঘ বলে-
দূরে তুমি হৃদয়ে তুমি। নো প্রবলেম।
ছুটি শেষ হয়ে গেলে মেঘ আর মাকে রেখে ঋতু চলে গেল।
বলল-
ঠিকমতো মা যেন ওষুধ খায় সেটা দেখিস মেঘ। মা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে কেঁদে ফেললেন।
-একা একা রাজশাহীতে!
মা রাজশাহী! নর্থ পোল নয়। আর ঢাকা সাউথ মানে সাউথ পোল নয়। আমি এখন আর ছোট নেই। আমার বয়স পঁচিশ। তবে তোমাকে মিস করি খুব। তারপরেও আমি আর হিমি একটা বাড়িতে ভালোই আছি। ও কলেজে পড়ায়। বিয়েটা ভেঙে গেছে ওর। আমার খুব খেয়াল করে। ঠিক একেবারে আপামণির মতো। ও আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসবে মা। আনব?
কেন নয়। যে আমার মেয়ের দেখাশোনা করে সেও আমার মেয়ে।
মা আর কিছু বলেন না। মেয়ে মাকে একটু বুকে জড়িয়ে তারপর চোখ মুছতে মুছতে চলে যায়।
বলে-
যদি পারি আবার ঢাকা চলে আসব মা।
তাই ভালো ঋতু। চলে আয়। তোরা দুই বোন একসঙ্গে থাক। ঝগড়া কর ভালোবাসাবাসি কর, একসঙ্গে।
সেটাই হবে। মেঘ রে চললাম।
মেঘ ছলছল হয়। তারপর বলে-
খুব তাড়াতাড়ি আবার আসিস।
চেষ্টা করব। ঋতু ওর কোঁকড়ানো চুলের পুরুষ্ট দু'দুটো বেণিতে একেবারে দারুণ দেখতে তখন। মেঘের চুল মায়ের মতো। বাবারও তাই। কেবল ঋতু কোঁকড়া চুল পেয়েছে। গোছা গোছা ঘন কালো একপিঠ চুল। দেখার মতো।
এবার এলে আমি তোকে কুমড়োফুলের বড়া আর টুনা মাছের কাটলেট করে খাওয়াব।
মেঘ বলে আদুরে গলায়।
ছোট বোনের আদর পেয়ে ছলছল চোখে হাসে।
ভালোই চলছিল সব। হঠাৎ করে ফোন এলো।
-ঋতু আমাদের মা আর নেই। এক ম্যাসিভ স্ট্রোকে চলে গেছেন।
ডাক্তার বললেন-
এই স্ট্রোকের পর বেঁচে থাকলে একটা অঙ্গ বা ব্রেনটা আর কাজ করত না রে! ফোনের দুই পারে দু'জন কাঁদতে থাকে। তারপর কান্না থামিয়ে মেঘ বলে-
বাবার পাশেই মায়ের কবরটা দিলাম। জানি, আপাতত যে কাজে এখন মালয়েশিয়াতে তুই, সেখান থেকে ফট করে আসতে পারবি না। তাই দেরি করলাম না। হিমঘরে মায়ের একটা মৃতদেহ পড়ে থাকবে, ভাবতে পারি না। মনে মনে এও ভাবে, প্রাণময়ী মায়ের মৃত মুখ দেখে খুবই ভেঙে পড়ার দরকার নেই ঋতু।
তোর ভাবনায় জীবিত মা থাক; মৃত মা নয়।
বলে ঋতু-
আমি তাহলে কাজ শেষ করে দশ দিন পর আসছি। তবে এই সময় আমি তোর কাছে নেই ভাবতে ভালো লাগছে না। একা কেমন লাগছে তোর?
আবুর মা আছে। ছোট খালা এসে চলে গেছেন। রোজদিন খোঁজ করেন। এই বিল্ডিংয়ের চারটে পরিবার সকাল-সন্ধ্যা খোঁজ নেন। আমাকে নিয়ে ভাবিস না আপু। মাঝে মাঝে আদর করে বা ভালোবেসে ঋতুকে ও আপু ডাকে।
যখন মনটা একটু হালকা মনে হয় বাড়িতে মায়ের বাক্সপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে এক তাড়া চিঠি পায় মেঘ। আলমারির মাথার ওপরে যে বিশেষ বাক্সটা মা কাউকে খুলতে দিতেন না চিঠিগুলো সেখানে ছিল। ওদের বিয়ের তিন বছর পর লেখা। বাবা যে তিন মাসের জন্য আফ্রিকা গিয়েছিলেন চিঠিগুলো সেই সময়ে লিখেছিলেন মনে হয়। প্রায় সব চিঠিতেই একই সম্বোধন-
আমার আনু, কেমন আছো তুমি। মা নীল ফিতায় চিঠিগুলো বেঁধে রেখেছেন। একটা চিঠি খামের ভেতরেই রয়ে গেছে। কেন জানি সেই চিঠিটাকে আর চিঠিগুলোর সঙ্গে মিশিয়ে ফেলেননি না। মেঘ কি ভেবে চিঠিটা খাম থেকে বের করে। পড়তেও শুরু করে ভূতা-গ্রস্তের মতো। পড়তে পড়তে জেগে ওঠে।
আমার আনু
তুমি বারবার একটা প্রশ্ন করতে- কেন আমি তোমাকে বিয়ে করেছি। তোমার ভাব হয়েছিল শ্রেয়াস আয়ারের সঙ্গে। যেমন হয় কলেজ-ইউনিভর্সিটিতে। ভারত থেকে বাবা-মায়ের সঙ্গে রাগারাগি করে ছেলেটা এসেছিল বাংলাদেশে। পড়াশোনাও শুরু করেছিল। কিছুদিন পরে ড্রাগে ডুবে যায়। আর একদিন হুট করে মারা গেলে তুমি জানতে পার পাঁচ মাসের সন্তানসম্ভবা। তুমি শুনেছ একটা ভালো পরিবারের ছেলে শ্রেয়াস। এর বেশি তেমন কিছু নয়। তবে সে নিয়ে তোমার মাথাব্যথা ছিল না। তুমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। দারুণ এক সাহসী সিদ্ধান্ত। তুমি বাংলাদেশের প্রথম অবিবাহিত মা হয়ে সিঙ্গেল প্যারেন্ট ফ্যামিলি হয়ে বেঁচে থাকবে। তোমার জীবন তুমি ও তোমার শিশু একা কাটাবে। 'কাউকে আমার দরকার নেই' এমনি কোনো চিন্তা তোমার মাথায়। আমি এলাম তখন। আ হা বুকটায় কী এক যন্ত্রণা অনুভব করলাম তোমার জন্য আনু। কী মিষ্টি দেখতে তুমি। কী ভালো একটি মেয়ে। কী সরল তোমার সবকিছু। কেবল এমএ পাস করেছ। তোমার সিদ্ধান্তে মা-বাবা তোমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চান না। আমি খুব ভালোবেসে ফেললাম তোমাকে। তোমাকে প্রথম কোথায় দেখেছিলাম মনে আছে? তারপর কোথায়? আমার কিন্তু সব মনে আছে। তুমি আমার ভালোবাসা বুঝতে পারলে।
বললে- ঠিক আছে। কাঁদতে কাঁদতে বললে, তুমি মানুষ না ঈশ্বর! আমি উত্তর দিয়েছিলাম-
নেহাতই মানুষ। ঈশ্বর হলে তো ওই আকাশের রাজত্ব থেকে কেবল তোমাকে বরদান করতাম। বুকের ভেতর পেতে চাইতাম না। বিয়ে করে তোমাকে নিয়ে আমি চলে গেলাম সিঙ্গাপুর। কিছুদিন পর ফিরে এলে আর এক মেয়ের মা হলে তুমি। তুমি তো জানো আনু, ঋতু আর মেঘ আমার কাছে সমান। আমি ওদের দু'জনকে একইভাবে ভালোবেসেছি। ঋতু শ্রেয়াস আয়ারের নয়। ঋতুও আমার। মেঘ ও আমার। ওরা দু'জন আমার দুই চোখ।
পড়তে পড়তে রাত বাড়তে থাকে। ঝিম মেরে বসে থাকে মেঘ। ঋতুর বাবা তাহলে ওর বাবা নয়। বিজ্ঞানী মামুন হাবিব নামের বড় হৃদয়ের অনেক মজার বাবা! ঋতুর বাবা শ্রেয়াস আয়ার? সে কেমন করে হয়? হতেই পারে না। সে আবার মায়ের সেই কাঠের বাক্স ভালো করে খুঁজতে থাকে। বাক্সটা থাকত বড় আলমারির মাথার ওপর। কোনোদিন সেটা কেউ খোলেনি। মা বলতেন-
নানা দরকারি কাগজপত্র আছে। ওরা ভাবত, জমি বাড়ির দলিলপত্র। খুঁজতে খুঁজতে ছোট একটা লাল মখমলের ব্যাগে টুং করে একটু শব্দ হয়। লাল ব্যাগের ভেতর রুবি আর ডায়মন্ডের একটি এনগেজমেন্ট রিং। তখনও নতুনের মতো ঝকঝক করছে। আর একটি চিরকুটে শ্রেয়াস আয়ারের বোম্বের বাড়ির ঠিকানা। ওর বাবার নাম। সুশীল আয়ারের একমাত্র সন্তান শ্রেয়াস। যিনি একজন মালটিন্যাশনাল কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা। শ্রেয়াসের মৃত্যুর পর মা এই পরিচয় ও ঠিকানা পেয়েছিল তার এক সহপাঠীর কাছ থেকে। সহপাঠীর এক টুকরো চিরকুটও আছে। আংটি? যেমন করে ডিসিশন নেয় কম বয়সী ছেলেমেয়েরা-
চল, আমরা এনগেজমেন্ট করি তেমন কি কোনো ঘটনা? এটা কি কোনো এনগেজমেন্ট রিং? হবে। কী এসে যায় তাতে? মা কেন এইসব জমিয়ে রেখেছেন? একদিন কি তিনি ঋতুকে বলতেন-
কে তার বাবা?
এবার মেঘ সোজা হয়ে বসে। না। শ্রেয়াস ওর বাবা নয়। ওর বাবা বিজ্ঞানী মামুন হাবিব। ওরা দুই বোন বাবার দুই হাঁটুতে বসে, বাবা কাকে বেশি ভালোবাসে সে নিয়ে ঝগড়া করছে! এই দৃশ্যটা এত বেশি উজ্জ্বল, এর বেশি স্পষ্ট আর কিছু ও ভাববে না। যিনি সমুদ্র হৃদয়ে, ভালোবাসায়, এমন একজন, যাকে জানা হলে ভালোবাসার সঠিক অর্থ করতে পারে অনেকে। ঋতুর বাবা আর ওর বাবা একজন। অন্য কেউ নয়। হতেই পারে না।
সে কখন যেন সেই আংটি আর কাগজ দশতলা থেকে জানালা দিয়ে লেকের পানিতে ফেলে দেয় নিজেও বুঝতে পারে না। লেকের অথৈ পানিতে হারিয়ে যায় একটি আংটি আর একটি ঠিকানা।
তারপর? ঋতু এলে কেঁদেকেটে একটু স্বাভাবিক হলে দেখায় বাবার চিঠি।
একা ঘরে। ঋতু প্রথমবারের মতো বুঝতে পারে তার গভীর ঘন কোঁকড়ানো চুলের উত্তরাধিকার। কোথা থেকে পেয়েছে সে। আর কিছু? না। মনে হয় না আর কিছু। তবে মা হয়তো বলবেন পিঠের লাল পদ্মটা! জন্মসূত্রে ঋতু পেয়েছিল সেটাও উত্তরাধিকার। মা কি এই কারণে এক টুকরো ঠিকানা জমিয়ে রেখেছিলেন? কে বলবে কেন? মা কি ভেবেছিলেন মালটিন্যাশনাল কোম্পানির একটিমাত্র উত্তরাধিকারী কে? এ প্রশ্ন যদি কখনও ওঠে? তখন। এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য মা নেই। জীবনের সেই বিশাল ভালোবাসার পাশে ঘুমিয়ে আছেন। এবং এই হলো মায়ের সবচাইতে পছন্দের জায়গা। সারাজীবন ধরে যা তিনি প্রতিদিন জেনেছেন।
আপু।
দরজায় আঘাত করে মেঘ।
ঋতু মেঝের কার্পেটে শুয়ে আছে একটা বালিশ টেনে। ওর বাবাকে মনে পড়ছে। শ্রেয়াসকে নয়। বাবাকে। কখনও বাবা চুপচাপ কাজের ফাঁকে মেঘের কান আর চোখ বাঁচিয়ে ঋতুর গালে টুক করে চুমু খেয়ে বলছেন-
তোকে বেশি ভালোবাসি ঋতু। খবরদার মেঘ যেন জানতে না পারে!
মেঘ এসে পাশে বসে। তারপর বালিশ টেনে সেও শুয়ে পড়ে। একটু আদর করে আপুকে। তারপর বলে-
ঋতু, কী এত ভাবছিস রে? তুই আর আমি মায়ের ওইটুকুন পেটের ভেতর ৯ মাস করে ছিলাম। তুই যখন বেরিয়ে এলি আমি সেখানে ঢুকে গেলাম। বলেই হাসে। আ হা! কেমন করে আমাদের জায়গা হয়েছিল অতটুকুন পেটে? আমদের দু'জনের পরিচয়ে এই কি অনেক নয়? আর কোনো কিছু জানার দরকার নেই। তুই আর আমি সহোদরা।
একটি ঠিকানা আর একটি আংটি আমি ফেলে দিয়েছি। রাগ করিস নি তো?
ঋতু কাঁদছে। বলে-
না। বাবা; আমাদের বাবাকে আমার খুব মনে পড়ছে।
আমারও।
মেঘ বলে।
আমার সব সময় মনে হতো, বাবা তোকে বেশি ভালোবাসে। খুব ঈর্ষা করতাম তোকে। মনে আছে, একবার তোর চুল টেনে ছিঁড়ে ...।
বলেই সে হাসতে হাসতে কাঁদে। ঋতুও।
দুই সহোদরা হৃদয়ের শব্দের ভেতর পাশাপাশি শুয়ে কী ভাবছে কে জানে!
তুই যেদিন পৃথিবীতে এলি, খুব মেঘ জমে ছিল আকাশে। আমরা অবশ্য বৃষ্টির আশা করছিলাম। আগস্টের গরম চলছিল খুব।
আর আমার জন্মের সময়?
ঋতু প্রশ্ন করে।
মা একটু ভেবে বলেন-
ঋতুময় প্রকৃতি। বসন্ত ছিল সে সময়। বাগানে রডোড্রেনডন লাল ফুল ফুটে ছিল।
এরপর মা চুপ হয়ে যান। ঋতু খুশি হয়।
বসন্তকালে আমার জন্ম!
খুশি খুশি গলায় ঋতু বলে।
বাবাটা কথা নাই বার্তা নাই দুম করে মারা গেলেন। হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। এক অ্যাটাকেই শেষ হলেন মামুন হাবিব। অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের চেয়ারম্যান। ব্রেইন যার দারুণ শানিত, বিজ্ঞানী এবং নানা পরিকল্পনা। তার একটিকেও বাস্তবায়িত করার আগেই চলে গেলেন। তারপর থেকে একা মা। ওরা তখন ইউনিভার্সিটির পড়া শেষ করে চাকরি করছে। এক বছরের বড় ঋতু একটা ব্যাংকে। বিবিএ করে চাকরি শুরু করেছে। বলে-
এমবিএ পড়ে সময় নষ্ট করতে চাই না।
আর মেঘ ইংরেজিতে এমএ করে ইউনিভার্সিটিতেই এক বছর হলো জয়েন করেছে। লেকচারার।
ঋতু থাকে রাজশাহী আর মেঘ ঢাকাতে। বাবা চলে যাওয়ার পর মায়ের বোধকরি বাঁচার ইচ্ছা চলে গিয়েছিল।
মেঘ বলে-
বাবাটা ছিল মায়ের প্রাণভোমরা। ওই যে সেই গল্পটা, প্রাণভোমরাটা লুকিয়ে ছিল না কোনো এক বাক্সে, না কৌটোয়! তারপর একটু থেমে বলে-
কেন এত তাড়াতাড়ি বাবাটা চলে গেলেন। ইস!
মেঘ ভালোবাসে ক্ল্যাসিক। ঋতু রোমান্টিক। বা একটু হালকা বই। ওরা দু'জনেই বাংলা-ইংরেজি দুই ভাষারই বই পড়ে। ঋতু একটু গোলমতো। খেতে পছন্দ ওর। তাই উঠেপড়ে লেগেছে স্লিম হতে। মেঘ একেবারে স্লিম। ঋতু মেঘের মতো সোনার বোতাম নয় পড়াশোনায়। মেঘ একেবারে ব্র্রাইট আজ বাটন। মা বলেন-
মেঘ বাবার মেধা পেয়েছে।
ঋতু বলে-
আর আমি?
আমার।
মা জবাব দেন।
তুমি তো খুব ভালো ছিলে পড়াশোনায়। বলো না তোমার। তুমি একটুর জন্য ফার্স্টক্লাস মিস করেছিলে।
মা হাসেন।
তাহলে কোনো পূর্বপুরুষের মতো।
ওরা কেউ বিয়ে করেনি। মেঘ সহপাঠীকে ভালোবেসেছিল। সে এখন বাইরে গেছে পিএইচডি করতে। যদি মেঘ সুযোগ পায় যাবে। তবে পড়ানোর চাকরিটা ও বেশ উপভোগ করছে। বলে-
আমার বাইরে যাবার ইচ্ছা নাই।
ঋতু বলে-
আমার ইচ্ছা আছে, তবে সুযোগ নেই।
কেন, ব্যাংকের কর্মকর্তাকে ধরে বাইরে পোস্টিং নে।
নীরার ভাই চলে গেল ভিয়েতনামে। তুইও যেতে পারিস তেমন কোনো দেশে। ওরা দু'জন দু'জনকে নাম ধরে ডাকে। আর তুই তুই করে। সম্পর্কটা বোনের হলেও অনেকটা বন্ধুত্বের।
না রে মাকে ছেড়ে যাব না।
ঋতু বলে।
-তা ঠিক। মা যে এখনও প্রাণপ্রদীপ জ্বালিয়ে রেখেছেন সে তো আমাদের জন্যই। মেঘ থাকে মায়ের কাছে আর ঋতু রাজশাহীতে। প্রায়ই চলে আসে। তারপর দু'জনের নানা খুনসুটি, নানা ঝগড়া। ভাব আর ভালোবাসা।
মেঘ বলে-
ঋতু, তুই কী করে ট্র্যাশগুলো পড়িস রে? ডানিয়েল স্টিল, জাকি কলিন্স যতসব! 'মিলস অ্যান্ড বুনস' সস্তা রোমান্স ভাবতে পারি না। বারবারা কার্টল্যান্ডও পড়তে দেখেছি। রুচি হয় তোর?
ঋতু বলে-
আমাকে ছাত্রছাত্রী ভোলাতে বা বোঝাতে ক্ল্যাসিক পড়তে হবে না। ডিকেন্স, ইবসেন, ব্রন্টি বোনেরা, জর্জ এলিয়ট, জেন অস্টেন-এর ভারী ভারী বই। বই না থান ইট। অনেক আগে ক্ল্যাসিকের ছোটদের সংস্করণে কিছু পড়েছি। আর পড়ার দরকার নেই।
ছোটদের সংস্করণ পড়েছিস। এখন আসল বইটা পড়।
না আমার ওইসব ভারী বই পড়ার দরকার নেই। পঞ্চাশ পাতার 'মবি ডিকই গুড এনাফ'। ছয়শ পাতা পড়ার ইচ্ছা নাই।
টেলিভিশনে মেঘ যা দেখে ঋতু তা দেখে না। কাজেই ওদের দু'জনার ঘরের টেলিভিশনে ভিন্ন প্রোগ্রাম। খেতে বসলেও দেখা যাবে মেঘ যেটা পছন্দ করে, ঋতু তা নয়। ঋতু খানিকটা মাংসাশী। আর মেঘ মাছ আর সবজি। তারপরেও ওদের এইসব মিল-অমিলের ভেতর আসলে গভীর বন্ধুত্ব। ঋতু অনেক সময় এক বছরের বড় বোনের দাবিতে এটা-সেটা বলে। মেঘ কখনও তা শোনে। আবার কখনও শোনেও না। বলে-
কানের কাছ দিয়ে বড় বোন।
কানের কাছ দিয়ে?
পুরো এক বছরের বড়।
তারপর হাসাহাসি। বারো মাস তিনশ পঁয়ষট্টি দিন টাইমস ...।
দু'জনেই হাসতে থাকে।
তুই বিয়ে করবি না ঋতু?
মেঘ প্রশ্ন করে মাঝে মাঝে।
কেন করব না। বিয়ের বয়স কি গেছে?
প্রেমট্রেমও তো করলি না।
মেঘ বলে বন্ধুর মতো।
করে ফেলব একদিন ফট করে। কত লোকজন আমার ব্যাংকে আসে।
বলে ঋতু। তারপর প্রশ্ন করে-
তোর রুবায়েত কোথায় এখন?
ও চলে গেছে মিনিসোটাতে। আরও দুই বছর পর ফিরবে। আমি যাব না। চাই না বেচারি মা একা হয়ে যাক।
যেতে হলে যাবি। আমি চেষ্টাচরিত্র করে ঢাকায় বদলি হয়ে আসব।
আদুরে গলায় মেঘ বলে-
আমি মায়ের ছোট। একেবারে বেড়ালের মতো কিনা। আমাকে ফেলে মা কী করে থাকে বল?
তারপর ওরা দু'জন নিজের ঘরে চলে যায়। বাড়িটা বাবার পরিকল্পনায় তৈরি। চারটে ঘর। মা-বাবার একটা। ওদের দুই বোনের দুটো। আর একটা গেস্টরুম। বাবার পড়াশোনার জন্য একটা বক্স ঘর ছিল। এখন যা নানা হাবিজাবিতে ভর্তি। ওদের খুব ইচ্ছে আছে হাবিজাবি সারিয়ে ঘরটাকে মেঘের পড়ালেখার ঘর করবে। কোনো শ্রাবণ মেঘের দিনে মেঘ কবিতা বা গল্প লেখে। না হলে এমনি নানা মনের কথা। তবে সেটা এখনও হয়নি। মানে মেঘের সুমেরু পর্বতের ঘর। যেখান থেকে মেঘদূতের জন্ম। বাবা পুরো দুই হাজার স্কয়ার ফুটের অ্যাপার্টমেন্ট তার বন্ধুদের সঙ্গে কিনেছিলেন। এখন সেই দশতলার অ্যাপার্টমেন্টটাকে মেঘ ভীষণ ভালোবাসে। এখনও ওর বাইরে যাওয়ার ইচ্ছা নাই। জানালা দিয়ে আকাশ দেখতে দেখতে রুবায়েতের সঙ্গে কথা বলে। সুন্দর সুন্দর বাণী পাঠায়। গান গেয়ে কখনও শোনায়। আর রুবায়েতের কবিতা আবৃত্তি শোনে। ভালোই চলছে ওদের দূরে থাকার সময়।
মেঘ বলে-
দূরে তুমি হৃদয়ে তুমি। নো প্রবলেম।
ছুটি শেষ হয়ে গেলে মেঘ আর মাকে রেখে ঋতু চলে গেল।
বলল-
ঠিকমতো মা যেন ওষুধ খায় সেটা দেখিস মেঘ। মা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে কেঁদে ফেললেন।
-একা একা রাজশাহীতে!
মা রাজশাহী! নর্থ পোল নয়। আর ঢাকা সাউথ মানে সাউথ পোল নয়। আমি এখন আর ছোট নেই। আমার বয়স পঁচিশ। তবে তোমাকে মিস করি খুব। তারপরেও আমি আর হিমি একটা বাড়িতে ভালোই আছি। ও কলেজে পড়ায়। বিয়েটা ভেঙে গেছে ওর। আমার খুব খেয়াল করে। ঠিক একেবারে আপামণির মতো। ও আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসবে মা। আনব?
কেন নয়। যে আমার মেয়ের দেখাশোনা করে সেও আমার মেয়ে।
মা আর কিছু বলেন না। মেয়ে মাকে একটু বুকে জড়িয়ে তারপর চোখ মুছতে মুছতে চলে যায়।
বলে-
যদি পারি আবার ঢাকা চলে আসব মা।
তাই ভালো ঋতু। চলে আয়। তোরা দুই বোন একসঙ্গে থাক। ঝগড়া কর ভালোবাসাবাসি কর, একসঙ্গে।
সেটাই হবে। মেঘ রে চললাম।
মেঘ ছলছল হয়। তারপর বলে-
খুব তাড়াতাড়ি আবার আসিস।
চেষ্টা করব। ঋতু ওর কোঁকড়ানো চুলের পুরুষ্ট দু'দুটো বেণিতে একেবারে দারুণ দেখতে তখন। মেঘের চুল মায়ের মতো। বাবারও তাই। কেবল ঋতু কোঁকড়া চুল পেয়েছে। গোছা গোছা ঘন কালো একপিঠ চুল। দেখার মতো।
এবার এলে আমি তোকে কুমড়োফুলের বড়া আর টুনা মাছের কাটলেট করে খাওয়াব।
মেঘ বলে আদুরে গলায়।
ছোট বোনের আদর পেয়ে ছলছল চোখে হাসে।
ভালোই চলছিল সব। হঠাৎ করে ফোন এলো।
-ঋতু আমাদের মা আর নেই। এক ম্যাসিভ স্ট্রোকে চলে গেছেন।
ডাক্তার বললেন-
এই স্ট্রোকের পর বেঁচে থাকলে একটা অঙ্গ বা ব্রেনটা আর কাজ করত না রে! ফোনের দুই পারে দু'জন কাঁদতে থাকে। তারপর কান্না থামিয়ে মেঘ বলে-
বাবার পাশেই মায়ের কবরটা দিলাম। জানি, আপাতত যে কাজে এখন মালয়েশিয়াতে তুই, সেখান থেকে ফট করে আসতে পারবি না। তাই দেরি করলাম না। হিমঘরে মায়ের একটা মৃতদেহ পড়ে থাকবে, ভাবতে পারি না। মনে মনে এও ভাবে, প্রাণময়ী মায়ের মৃত মুখ দেখে খুবই ভেঙে পড়ার দরকার নেই ঋতু।
তোর ভাবনায় জীবিত মা থাক; মৃত মা নয়।
বলে ঋতু-
আমি তাহলে কাজ শেষ করে দশ দিন পর আসছি। তবে এই সময় আমি তোর কাছে নেই ভাবতে ভালো লাগছে না। একা কেমন লাগছে তোর?
আবুর মা আছে। ছোট খালা এসে চলে গেছেন। রোজদিন খোঁজ করেন। এই বিল্ডিংয়ের চারটে পরিবার সকাল-সন্ধ্যা খোঁজ নেন। আমাকে নিয়ে ভাবিস না আপু। মাঝে মাঝে আদর করে বা ভালোবেসে ঋতুকে ও আপু ডাকে।
যখন মনটা একটু হালকা মনে হয় বাড়িতে মায়ের বাক্সপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে এক তাড়া চিঠি পায় মেঘ। আলমারির মাথার ওপরে যে বিশেষ বাক্সটা মা কাউকে খুলতে দিতেন না চিঠিগুলো সেখানে ছিল। ওদের বিয়ের তিন বছর পর লেখা। বাবা যে তিন মাসের জন্য আফ্রিকা গিয়েছিলেন চিঠিগুলো সেই সময়ে লিখেছিলেন মনে হয়। প্রায় সব চিঠিতেই একই সম্বোধন-
আমার আনু, কেমন আছো তুমি। মা নীল ফিতায় চিঠিগুলো বেঁধে রেখেছেন। একটা চিঠি খামের ভেতরেই রয়ে গেছে। কেন জানি সেই চিঠিটাকে আর চিঠিগুলোর সঙ্গে মিশিয়ে ফেলেননি না। মেঘ কি ভেবে চিঠিটা খাম থেকে বের করে। পড়তেও শুরু করে ভূতা-গ্রস্তের মতো। পড়তে পড়তে জেগে ওঠে।
আমার আনু
তুমি বারবার একটা প্রশ্ন করতে- কেন আমি তোমাকে বিয়ে করেছি। তোমার ভাব হয়েছিল শ্রেয়াস আয়ারের সঙ্গে। যেমন হয় কলেজ-ইউনিভর্সিটিতে। ভারত থেকে বাবা-মায়ের সঙ্গে রাগারাগি করে ছেলেটা এসেছিল বাংলাদেশে। পড়াশোনাও শুরু করেছিল। কিছুদিন পরে ড্রাগে ডুবে যায়। আর একদিন হুট করে মারা গেলে তুমি জানতে পার পাঁচ মাসের সন্তানসম্ভবা। তুমি শুনেছ একটা ভালো পরিবারের ছেলে শ্রেয়াস। এর বেশি তেমন কিছু নয়। তবে সে নিয়ে তোমার মাথাব্যথা ছিল না। তুমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। দারুণ এক সাহসী সিদ্ধান্ত। তুমি বাংলাদেশের প্রথম অবিবাহিত মা হয়ে সিঙ্গেল প্যারেন্ট ফ্যামিলি হয়ে বেঁচে থাকবে। তোমার জীবন তুমি ও তোমার শিশু একা কাটাবে। 'কাউকে আমার দরকার নেই' এমনি কোনো চিন্তা তোমার মাথায়। আমি এলাম তখন। আ হা বুকটায় কী এক যন্ত্রণা অনুভব করলাম তোমার জন্য আনু। কী মিষ্টি দেখতে তুমি। কী ভালো একটি মেয়ে। কী সরল তোমার সবকিছু। কেবল এমএ পাস করেছ। তোমার সিদ্ধান্তে মা-বাবা তোমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চান না। আমি খুব ভালোবেসে ফেললাম তোমাকে। তোমাকে প্রথম কোথায় দেখেছিলাম মনে আছে? তারপর কোথায়? আমার কিন্তু সব মনে আছে। তুমি আমার ভালোবাসা বুঝতে পারলে।
বললে- ঠিক আছে। কাঁদতে কাঁদতে বললে, তুমি মানুষ না ঈশ্বর! আমি উত্তর দিয়েছিলাম-
নেহাতই মানুষ। ঈশ্বর হলে তো ওই আকাশের রাজত্ব থেকে কেবল তোমাকে বরদান করতাম। বুকের ভেতর পেতে চাইতাম না। বিয়ে করে তোমাকে নিয়ে আমি চলে গেলাম সিঙ্গাপুর। কিছুদিন পর ফিরে এলে আর এক মেয়ের মা হলে তুমি। তুমি তো জানো আনু, ঋতু আর মেঘ আমার কাছে সমান। আমি ওদের দু'জনকে একইভাবে ভালোবেসেছি। ঋতু শ্রেয়াস আয়ারের নয়। ঋতুও আমার। মেঘ ও আমার। ওরা দু'জন আমার দুই চোখ।
পড়তে পড়তে রাত বাড়তে থাকে। ঝিম মেরে বসে থাকে মেঘ। ঋতুর বাবা তাহলে ওর বাবা নয়। বিজ্ঞানী মামুন হাবিব নামের বড় হৃদয়ের অনেক মজার বাবা! ঋতুর বাবা শ্রেয়াস আয়ার? সে কেমন করে হয়? হতেই পারে না। সে আবার মায়ের সেই কাঠের বাক্স ভালো করে খুঁজতে থাকে। বাক্সটা থাকত বড় আলমারির মাথার ওপর। কোনোদিন সেটা কেউ খোলেনি। মা বলতেন-
নানা দরকারি কাগজপত্র আছে। ওরা ভাবত, জমি বাড়ির দলিলপত্র। খুঁজতে খুঁজতে ছোট একটা লাল মখমলের ব্যাগে টুং করে একটু শব্দ হয়। লাল ব্যাগের ভেতর রুবি আর ডায়মন্ডের একটি এনগেজমেন্ট রিং। তখনও নতুনের মতো ঝকঝক করছে। আর একটি চিরকুটে শ্রেয়াস আয়ারের বোম্বের বাড়ির ঠিকানা। ওর বাবার নাম। সুশীল আয়ারের একমাত্র সন্তান শ্রেয়াস। যিনি একজন মালটিন্যাশনাল কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা। শ্রেয়াসের মৃত্যুর পর মা এই পরিচয় ও ঠিকানা পেয়েছিল তার এক সহপাঠীর কাছ থেকে। সহপাঠীর এক টুকরো চিরকুটও আছে। আংটি? যেমন করে ডিসিশন নেয় কম বয়সী ছেলেমেয়েরা-
চল, আমরা এনগেজমেন্ট করি তেমন কি কোনো ঘটনা? এটা কি কোনো এনগেজমেন্ট রিং? হবে। কী এসে যায় তাতে? মা কেন এইসব জমিয়ে রেখেছেন? একদিন কি তিনি ঋতুকে বলতেন-
কে তার বাবা?
এবার মেঘ সোজা হয়ে বসে। না। শ্রেয়াস ওর বাবা নয়। ওর বাবা বিজ্ঞানী মামুন হাবিব। ওরা দুই বোন বাবার দুই হাঁটুতে বসে, বাবা কাকে বেশি ভালোবাসে সে নিয়ে ঝগড়া করছে! এই দৃশ্যটা এত বেশি উজ্জ্বল, এর বেশি স্পষ্ট আর কিছু ও ভাববে না। যিনি সমুদ্র হৃদয়ে, ভালোবাসায়, এমন একজন, যাকে জানা হলে ভালোবাসার সঠিক অর্থ করতে পারে অনেকে। ঋতুর বাবা আর ওর বাবা একজন। অন্য কেউ নয়। হতেই পারে না।
সে কখন যেন সেই আংটি আর কাগজ দশতলা থেকে জানালা দিয়ে লেকের পানিতে ফেলে দেয় নিজেও বুঝতে পারে না। লেকের অথৈ পানিতে হারিয়ে যায় একটি আংটি আর একটি ঠিকানা।
তারপর? ঋতু এলে কেঁদেকেটে একটু স্বাভাবিক হলে দেখায় বাবার চিঠি।
একা ঘরে। ঋতু প্রথমবারের মতো বুঝতে পারে তার গভীর ঘন কোঁকড়ানো চুলের উত্তরাধিকার। কোথা থেকে পেয়েছে সে। আর কিছু? না। মনে হয় না আর কিছু। তবে মা হয়তো বলবেন পিঠের লাল পদ্মটা! জন্মসূত্রে ঋতু পেয়েছিল সেটাও উত্তরাধিকার। মা কি এই কারণে এক টুকরো ঠিকানা জমিয়ে রেখেছিলেন? কে বলবে কেন? মা কি ভেবেছিলেন মালটিন্যাশনাল কোম্পানির একটিমাত্র উত্তরাধিকারী কে? এ প্রশ্ন যদি কখনও ওঠে? তখন। এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য মা নেই। জীবনের সেই বিশাল ভালোবাসার পাশে ঘুমিয়ে আছেন। এবং এই হলো মায়ের সবচাইতে পছন্দের জায়গা। সারাজীবন ধরে যা তিনি প্রতিদিন জেনেছেন।
আপু।
দরজায় আঘাত করে মেঘ।
ঋতু মেঝের কার্পেটে শুয়ে আছে একটা বালিশ টেনে। ওর বাবাকে মনে পড়ছে। শ্রেয়াসকে নয়। বাবাকে। কখনও বাবা চুপচাপ কাজের ফাঁকে মেঘের কান আর চোখ বাঁচিয়ে ঋতুর গালে টুক করে চুমু খেয়ে বলছেন-
তোকে বেশি ভালোবাসি ঋতু। খবরদার মেঘ যেন জানতে না পারে!
মেঘ এসে পাশে বসে। তারপর বালিশ টেনে সেও শুয়ে পড়ে। একটু আদর করে আপুকে। তারপর বলে-
ঋতু, কী এত ভাবছিস রে? তুই আর আমি মায়ের ওইটুকুন পেটের ভেতর ৯ মাস করে ছিলাম। তুই যখন বেরিয়ে এলি আমি সেখানে ঢুকে গেলাম। বলেই হাসে। আ হা! কেমন করে আমাদের জায়গা হয়েছিল অতটুকুন পেটে? আমদের দু'জনের পরিচয়ে এই কি অনেক নয়? আর কোনো কিছু জানার দরকার নেই। তুই আর আমি সহোদরা।
একটি ঠিকানা আর একটি আংটি আমি ফেলে দিয়েছি। রাগ করিস নি তো?
ঋতু কাঁদছে। বলে-
না। বাবা; আমাদের বাবাকে আমার খুব মনে পড়ছে।
আমারও।
মেঘ বলে।
আমার সব সময় মনে হতো, বাবা তোকে বেশি ভালোবাসে। খুব ঈর্ষা করতাম তোকে। মনে আছে, একবার তোর চুল টেনে ছিঁড়ে ...।
বলেই সে হাসতে হাসতে কাঁদে। ঋতুও।
দুই সহোদরা হৃদয়ের শব্দের ভেতর পাশাপাশি শুয়ে কী ভাবছে কে জানে!
মন্তব্য করুন