
উদাল
উদ্ভিদের বিচিত্র ও বর্ণাঢ্য রূপ প্রকৃতির অনিন্দ্য উপহার। বৈচিত্র্য আছে বলেই পৃথিবী এমন বর্ণিল, প্রাণময়। কিন্তু জলবায়ু, ভূমি ব্যবস্থাপনা ও নানান প্রাকৃতিক কারণে একেক অঞ্চলের উদ্ভিদের ধরন একেক রকম। বৃষ্টিবহুল বনাঞ্চল, উষ্ণমণ্ডল ও শীতপ্রধান অঞ্চলের মধ্যে এ পার্থক্য বেশি লক্ষণীয়। নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুর কারণে আমাদের উদ্ভিদবৈচিত্র্যেও মিশ্রভাব লক্ষ করা যায়। তবে উষ্ণমণ্ডলের অনেক উদ্ভিদই আমাদের দেশে আবাদিত। লন্ডনের কিউ উদ্যানের কর্মী রবার্ট লুইস প্রাউডলক ঢাকায় রমনাকেন্দ্রিক নিসর্গ শোভা তৈরির সময় পৃথিবীর নানান প্রান্ত থেকে অনেক ধরনের গাছপালা এনে জড়ো করেছিলেন। তার কিছু কিছু এখনও বেঁচে আছে। ভৌগোলিক সীমানা ডিঙিয়েও প্রতিবেশী দেশের অনেক গাছপালা আমাদের প্রকৃতিতে থিতু হয়েছে। কিছু এসেছে বৃক্ষপ্রেমী ও মিশনারির মাধ্যমে। দীর্ঘ সময়ের বিবর্তনে এগুলো আমাদের প্রকৃতির সঙ্গে এমনভাবে মিশেছে যে, এখন অনেকেই সেগুলোকে বিদেশি হিসেবে ভাবতে চান না। আমাদের নিজস্ব উদ্ভিদসম্ভারও কম সমৃদ্ধ নয়। বিজ্ঞানীদের মতে, পৃথিবীতে ফুলের রকমফের আড়াই লাখেরও বেশি। আর ভারত উপমহাদেশের পুষ্পতরুর খতিয়ান হিসেবে পরিচিত যোশেফ ড্যাল্টন হুকারের লেখা ৭ খণ্ডের Flora of British India গ্রন্থে উল্লিখিত সংখ্যাটি প্রায় ১৪ হাজার ৫শ। Flora of Bangladesh পুস্তিকামালার সম্পাদক ড. সালার খানের সাম্প্রতিক হিসাবে আমাদের দেশে এ সংখ্যাটি ৫ হাজারের মতো। অবশ্য বিজ্ঞানীরা এসব হিসাবে সুন্দর-অসুন্দর বিচার করেননি। এতে আছে শূন্য মাঠে ফোটা তুচ্ছ ফুল, আগাছা; যার কোনো দাম নেই, বনশ্রী কখনও যাদের মর্যাদা দেয়নি।
অন্তত হাজার বছর ধরে যেসব ফুল আমাদের প্রকৃতিকে বর্ণাঢ্য করে রেখেছে, তাদের খুব সহজেই নিজেদের বলে ধরে নিতে পারি। সেই তালিকাও অনেক দীর্ঘ। এখানে স্বর্ণচাঁপার কথা বলা যেতে পারে। প্রাচীন মৈমনসিংহ গীতিকায় তার প্রশস্তি আছে- 'চাইরকোনা পুস্কুনির পারে চাম্পা নাগেশ্বর/ ডাল ভাঙ্গ পুষ্প তুল কে তুমি নাগর।' এই সূত্রে আমরা নাগেশ্বরের সন্ধানও পাচ্ছি। পূর্ব-শ্রীহট্টের (সিলেট) লোকগীতিতে আছে 'নাচেন ভালা সুন্দরী লো/ বাঁধেন ভালা চুল,/ যেন হেলিয়া দুলিয়া পড়ে নাগকেশরের ফুল।' কনকচাঁপা আমাদের বনের ফুল। মৈমনসিংহ গীতিকায় তার উপস্থিতি কোনো এক রূপসী নারীর উপমায় মোহনীয়- 'হাঁট্যা না যাইতে কন্যার পায়ে পড়ে চুল/ মুখেতে ফুট্টা উঠে কনক চাম্পার ফুল।'
আমাদের বন-পাহাড়ে দৃষ্টির অগোচরে এমন অনেক রূপসী ফুল রং রূপ আর সুবাস ছড়াচ্ছে। হয়তো এসব ফুলের নাম আমাদের জানা আছে বা নেই। কখনো দেখেছি বা দেখিনি। কিন্তু এসব বনকুসুমের প্রতি ভালোবাসার কোনো কমতি নেই। আমাদের বন-পাহাড়ের এমন কিছু মনোমুগ্ধকর ফুল নিয়েই এই আয়োজন।
কনকচাঁপা
কনকচাঁপা আমাদের অতি পুরোনো ও দুষ্প্রাপ্য ফুল। দুর্লভ হওয়ার কারণে ফুলটি আমাদের কাছে নামে যতটা পরিচিত; অবয়বে ঠিক ততটা নয়। রূপের মাধুর্য আর সুবাসের কারণে এই ফুল আমাদের অতি প্রিয়। ঢাকায় আছে মাত্র হাতেগোনা কয়েকটি। বলধা গার্ডেন, শিশু একাডেমির বাগান ও রমনা পার্কে বসন্তে এদের দুর্লভ প্রস্টম্ফুটন চোখে পড়ে। বলধা গার্ডেনের গাছটির কন্যা শিশু একাডেমির গাছটি। চারা এনে লাগিয়েছিলেন কথাসাহিত্যিক ও নিসর্গী বিপ্রদাশ বড়ূয়া। রমনা পার্কে এ গাছটির চারা নিয়ে লাগিয়েছেন অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা। এভাবেই আমাদের চারপাশে কিছু কনকচাঁপা ছড়িয়ে পড়েছে। তবে এরা সংখ্যায় খুব বেশি নয়। অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা 'শ্যামলী নিসর্গ' গ্রন্থে এক সময়ের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের ফটকের কাছাকাছি যে গাছটির সন্ধান দিয়েছেন; বর্তমানে তা আর নেই। সোনালু বা সোনাইলের ফুল হলুদ রঙের, কিন্তু গন্ধহীন। পেল্টোফরামের রং অবিকল কনকচাঁপার মতো, কিন্তু গন্ধ অত্যুগ্র। কনকচাঁপা অবশ্য এসব ত্রুটিমুক্ত। বর্ণে, গন্ধে সে অনুপম, অনন্য, অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
কনকচাঁপা ছোটখাটো ধরনের গাছ। এর কাণ্ড মসৃণ ও বাকল ধূসর রঙের। মাথার দিকে ডালপালা কিছুটা ছড়ানো ধরনের। শীতের শেষে সব পাতা ঝরে পড়ে। আবার বসন্তের একটু ছোঁয়া পেলেই যেন প্রাণ ফিরে আসে। তখন তামাটে রঙের কচি পাতাগুলো হাওয়ায় দোল খায়। তার পরপরই হলুদ সোনালি রঙের সুগন্ধি ফুলগুলো ফুটতে শুরু করে। পরাগ রেণুর প্রলোভনে ছুটে আসে ভ্রমরার দল। এদের মঞ্জরি ছোট হলেও সংখ্যায় অজস্র। হলুদ পরাগচক্রে বহু কেশরের সমাহার। কিন্তু দিন কয়েক যেতে না যেতেই নিঃশেষ হয়ে আসে ফুল। গাছতলায় তখন শুধুই ঝরা ফুলের রোদন।
নাগেশ্বর
নাগেশ্বর এ অঞ্চলের অনেক পুরোনো ফুল। হিমালয়ের পূর্বাঞ্চল থেকে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ পর্যন্ত বাংলাদেশ, ভারতের অনেক স্থানেই নাগেশ্বর সহজলভ্য। তবে আমাদের দেশে সিলেটের পাহাড়ি এলাকায় তুলনামূলক একটু বেশিই দেখা যায়। পূর্ব-শ্রীহট্টের লোকগীতিতে নাগেশ্বরকে নিয়ে কয়েকটি পঙ্ক্তি আছে।
দৃঢ়তা, গঠনসৌষ্ঠব, দীর্ঘ জীবন, ফুল ও পাতার সৌন্দর্য এ গাছের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। নাগেশ্বর দীর্ঘাকৃতির বৃক্ষ। কাণ্ড গোল, সরল, মসৃণ ও ধূসর রঙের। এ গাছটি দেখতে অনেকটা পিরামিড আকৃতির। সারাবছর নতুন নতুন পাতা গজানো এ গাছের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। নতুন পাতার রং উজ্জ্বল তামাটে। পাতা সরু ও মসৃণ, আগা তীক্ষষ্ট। পাতার বিন্যাস এতই ঘনবদ্ধ যে, এ গাছ সব সময় ছায়া-সুনিবিড়। নাগেশ্বর ফোটার প্রধান মৌসুম বসন্ত। তবে বছরের অন্যান্য সময়েও ফুল থাকে। পাপড়ির রং দুধ-সাদা। মাঝখানে আছে এক থোকা সোনালি রঙের পরাগ কেশর। সব মিলিয়ে এই ফুল বর্ণ-গন্ধে অনন্য। গৃহসজ্জা ও পূজার উপকরণেও এ ফুল কাজে লাগে। ইদানীং ঢাকার বিভিন্ন পার্ক ও পথপাশে বেশ কিছু নাগেশ্বর চোখে পড়ে।
দুলিচাঁপা
২০০৭ সালের ১৪ জুলাই অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা দুলিচাঁপার একটি চারা রোপণ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের বাগানে। উৎসবমুখর পরিবেশে চারাটি রোপণ করার মুহূর্তে অনেকের সঙ্গে আমিও উপস্থিত ছিলাম। দ্বিজেন শর্মা মৌলভীবাজার জেলার পাথারিয়া পাহাড় থেকে দুলিচাঁপার দুটি চারা সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন ঢাকায়। আরেকটি রোপণ করা হয় রমনা পার্কে।
মাত্র ৪ বছরের ব্যবধানে বিশ্ববিদ্যালয়ের গাছটিতে প্রথম ফুল ফোটে ২০১০ সালের গ্রীষ্ফ্মে। বছর দুয়েক পরে রমনা পার্কের গাছটিতেও ফুল ফুটেছে। খবরটি নিঃসন্দেহে আনন্দদায়ক। শেষ পর্যন্ত আমাদের বুনো ম্যাগনোলিয়ার অভিষেক ঘটল নগর উদ্যানে। প্রাকৃতিক আবাসেও আরও কয়েকটি গাছ দেখার সুযোগ হয়েছে। দুলিচাঁপাই আমাদের একমাত্র নিজস্ব ম্যাগনোলিয়া। তবে আমাদের দেশে বহুল পরিচিত ম্যাগনোলিয়া হচ্ছে উদয়পদ্ম বা হিমচাঁপা, যা হিমালয় অঞ্চলের আদি ফুল।
চারা কিংবা কলমের মাধ্যমে এই গাছটি আমাদের চারপাশে ব্যাপক পরিমাণে রোপণ করা প্রয়োজন। এমনকি দুলিচাঁপার একটি অ্যাভিনিউ তৈরি করা যেতে পারে।
অশোক
প্রায় ২০ ছর আগে বোটানিক্যাল গার্ডেনে প্রথম অশোক ফুল দেখে অবাকই হয়েছিলাম। গাছের কাণ্ড ফুঁড়ে বেরিয়েছে থোকা থোকা ফুল। এর আগে কাণ্ড ফুঁড়ে শুধু ডুমুর বা কাঁঠাল দেখার অভিজ্ঞতা ছিল। অবাক হওয়ার আরও কারণ ফুলের বর্ণবৈভব। কমলা আর লালে মেশানো ফুলগুলো গা-জুড়ে ঝলমল করছিল। বোটানিক্যাল গার্ডেনের প্রধান সড়ক এবং পশ্চিম-উত্তর প্রান্তে একটি সুদর্শন অশোকবীথি আছে। কিন্তু গাছটি আমাদের চারপাশের অন্যান্য গাছের মতো ততটা সহজলভ্য নয়। আমাদের লোকালয় কিংবা যত্রতত্র কোনো সুদৃশ্য অশোকবীথিও পাওয়া যাবে না। সে অর্থে ফুলটি কিছুটা দুর্লভ। তবে বিভিন্ন পার্ক ও উদ্যানে অনায়াসে দেখা মিলবে। ঢাকায় রমনা পার্কে আছে নান্দনিক অশোককুঞ্জ। ধানমন্ডি এলাকায়ও একটি বিবর্ণ অশোকবীথি চোখে পড়ে। কোনো এক সময় হয়তো পরিকল্পিতভাবেই লাগানো হয়েছিল গাছগুলো। পরে সেগুলো নগরায়ণের বলি হয়।
অশোক এ অঞ্চলের নিজস্ব বৃক্ষ। মূলত ফুলের জন্যই গাছটি বিখ্যাত। এদের প্রস্টম্ফুটনকালও অতি দীর্ঘ। অশোক সত্যিকার অর্থেই দুঃখহারী। রোগ নিরাময়ে ভেষজ গুণ, শীতল ছায়া, মধুরিম সুবাস, পুষ্প-প্রাচুর্য ইত্যাদির জন্যই এমন নাম।
কইনার
ফুলটির সঙ্গে পরিচয় প্রায় ১৬ বছর আগে; মিরপুর জাতীয় উদ্ভিদ-উদ্যানে। মনে পড়ে, প্রথম দেখায় কিছুটা দ্বিধায় পড়েছিলাম সেদিন। পাতা ও গাছের গড়ন অনেকটা গন্ধরাজের মতো হলেও ফুল ঠিক তেমনটা নয়। আবার গন্ধরাজের তুলনায় গাছটি বেশ বড়। তাহলে গাছটির সঠিক পরিচয় কী হতে পারে? নানা কিছু ভাবতে ভাবতে ছবি তুলে বাসায় ফিরি। পরে বই দেখে নিশ্চিত হই- এ গাছের নাম কইনার। কয়েক বছর পর রাঙামাটির পাহাড়ে প্রাকৃতিক আবাসেই দুটি গাছ দেখি। ঢাকায় তেজগাঁও শিল্প এলাকায় বেগুনবাড়ি সড়কে প্রায় এক দশক থেকে একটি গাছ দেখছি। সম্প্রতি দুটো গাছ দেখেছি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ-উদ্যানে।
কইনার আমাদের পাহাড়ি ফুল বলেই নগর-উদ্যানে অনেকটা দুর্লভ। আমাদের তিন পার্বত্য জেলায় এরা খুব সহজেই জন্মে ও বেড়ে ওঠে। সেখানকার পাহাড়ি ঢাল এবং বনের প্রান্তে বেশি দেখা যায়। বসন্তের প্রায় শেষদিকে গাছজুড়ে অসংখ্য ফুল ফুটতে শুরু করে। এই ফুলের প্রস্টম্ফুটন প্রক্রিয়া ততটা নিবিড় না হলেও ফুলের মধুগন্ধই প্রধান আকর্ষণ। স্থানীয়ভাবে এ গাছ অনেক নামে পরিচিত। যেমন- বনকমল, বাতা, বেলা, কনিয়ারি, কইনর, কোনিয়ারা, রাঙখাই ইত্যাদি।
পালাম
পালাম মূলত পাহাড়ের গাছ। সিলেটের অনুচ্চ টিলায় বেশ কিছু গাছ দেখেছি। ঢাকায় আছে হাতেগোনা কয়েকটি। শিশু একাডেমি এবং রমনা নার্সারির গাছ দুটো বেশ কয়েক বছর আগে রোপণ করেন অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা। চারা সংগ্রহ করেন মৌলভীবাজার জেলার পাথারিয়া পাহাড় থেকে। সেই গাছ দুটোতে কয়েক বছর থেকে ফুল ফুটছে।
পালাম বা পালান মাঝারি আকারের পত্রমোচী গাছ, ফুলের গন্ধ বিকর্ষী, মাছি দ্বারাই পরাগায়িত। সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রাকৃতিকভাবেই জন্মে। তবে বর্তমানে আবাসস্থল ধ্বংসের কারণে সংখ্যায় অনেক কমেছে।
পারুল
কয়েক বছরের টানা অনুসন্ধান শেষে অবশেষে ২০১৯ সালের ২২ এপ্রিল আমরা নিশ্চিত হই গাজীপুরে সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেসের স্কুল লাগোয়া মাঠের ধারে পাঁচটি গাছই প্রকৃত পারুলের গাছ। সংরক্ষিত এলাকা বলেই সম্ভবত বেঁচে আছে গাছগুলো। ফুল কুড়িয়ে শুঁকে দেখি, বেশ সুগন্ধি। ফুলের গড়ন, রং, গন্ধ- সবকিছু পারুলের সঙ্গে বেশ সাদৃশ্যপূর্ণ। অজস্র ছবিও তুলি।
ঢাকায় ফিরে ছবি দেখাই অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মাকে। পরের সপ্তাহে সেখান থেকে নমুনা সংগ্রহ করেও দেখাই তাকে। একটি নমুনা পাঠানো হয় বাংলাদেশ ন্যাশনাল হার্বেরিয়ামের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সরদার নাসির উদ্দিনের কাছে। সবকিছু দেখে তারা নিশ্চিত করেন- এটাই পারুল। পারুল মাঝারি আকৃতির পত্রমোচী গাছ। পত্র যৌগিক, প্রতিমুখ, প্রায় ৬০ সেমি লম্বা, কচি কাণ্ড ও পাতা রোমশ। ফুল ফোটে ডালের আগায়। ফুল সবৃন্তক ও উভলিঙ্গ। বৃতি প্রায় ১ সেমি লম্বা, ৩ থেকে ৫ খণ্ডযুক্ত ও রোমশ। পাপড়ি গাঢ় বেগুনি থেকে গোলাপি, সুগন্ধি। মঞ্জরিদণ্ড দীর্ঘ, রোমশ ও বহুপৌষ্পিক। ফুল ১ থেকে দেড় ইঞ্চি লম্বা, ঘণ্টাকার, পাপড়ির ঠোঁট রোমশ নয়। গলা রোমশ, বাঁকা, তামাটে রঙের এবং চোঙ্গাকৃতির। এপ্রিলের প্রথমভাগে কচি পাতার সঙ্গে দুএকটি করে ফুল ফুটতে শুরু করে। ফুল শেষ হলে আসে ফল। কাঠ আসবাবপত্র তৈরিতে কাজে লাগে।
স্বর্ণচাঁপা
ফুলটির প্রতি আমাদের কিঞ্চিৎ পক্ষপাত আছে। কারণ চাঁপা ফুল বলে কথা। সেই প্রাচীনকাল থেকেই জনপ্রিয়তার শীর্ষে তার অবস্থান। চাঁপা ফুলকে আঞ্চলিক ভাষায় চাম্পা ফুল বলা হয়। প্রাচীন লোককথায়ও চাম্পা নামটি এসেছে বারবার।
জানামতে, ঢাকার শাহবাগে গণগ্রন্থাগারের প্রবেশপথের বাম পাশে কয়েকটি সুউচ্চ গাছ চোখে পড়ে। জাতীয় জাদুঘরের ভাস্কর নভেরা হল লাগোয়া পুকুরপাড়ে আছে বেশ কয়েকটি। এ ছাড়া নীলক্ষেত পুলিশ ফাঁড়ি, হলিক্রস স্কুল, সড়ক ভবন, জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, রমনা পার্ক, শিশু একাডেমি এবং সিলেট ও চট্টগ্রামের পাহাড়ে দেখা যায়। 'শ্যামলী নিসর্গ' গ্রন্থে অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা স্মৃতিচারণ করেছেন- 'ঢাকার সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজে আমরা একসার চাঁপাগাছ লাগাই।...আজও মনে পড়ে, জুন মাসের এক সকালে কলেজে গিয়ে দেখলাম সবকটি চাঁপাগাছ ফুলে ফুলে ভরে গেছে, মধুগন্ধ ছড়িয়ে আছে সারা কলেজে, দুতলার বারান্দায়, তিনতলার ক্লাশঘরে এবং প্রবল ঢেউয়ের মতো।'
স্বর্ণচাঁপা মূলত পাহাড়ি বৃক্ষ। আমাদের দেশে সাদা রঙের ফুল চোখে পড়ে না। ফুলের বর্ণগত বিচিত্রতায় বিভ্রান্ত হওয়ার কোনো কারণ নেই। পরিপূর্ণ প্রস্ম্ফুটিত চাঁপা তীব্র সুগন্ধি। গ্রীষ্ফ্মের প্রথমভাগ থেকে বর্ষা-শরৎ অবধি ফুল থাকে। ফুল শেষ হলে গুচ্ছবদ্ধ ফল ধরে। দেখতে অনেকটা আঙুরের মতো। কাঠ দারুমূল্যযুক্ত।
উদাল
আমাদের শহুরে উদ্যানে উদাল খুব বেশি নেই, মাত্র হাতেগোনা কয়েকটি। সে কারণেই উদালের সঙ্গে আমাদের খুব একটা চেনা-জানা নেই। তা ছাড়া এদের প্রিয় আবাস পাহাড়ি এলাকা। গাছ লম্বায় ২০ মিটার বা তার চেয়েও উঁচু হতে পারে। শীতে সব পাতা ঝরিয়ে একেবারে উদোম হয়ে পড়ে। কাণ্ডের রং সাদাটে। পাতা একটু বড় ও খাঁজ কাটা।
এরা মাঝারি আকৃতির পত্রমোচী গাছ। কচি ডাল, পাতার বোঁটা ও মঞ্জরি রোমশ। পাতা ডালপালার আগায় গুচ্ছবদ্ধ থাকে, ২৪ থেকে ৪০ সেমি চওড়া, প্রতিটিতে ৫/৭টি বড় লতি থাকে, নিচটা বেশ রোমশ। মাঘ মাসের শেষভাগে শীতের তীব্রতা একটু কমে এলেই উদালের ফুল ফোটার প্রস্তুতি শুরু হয়। বসন্তের শুরুতে অজস্র থোকা থোকা ফুলে গাছ ভরে ওঠে। ঝুলন্ত মঞ্জরিতে লম্বা ডাঁটায় হালকাভাবে গুচ্ছবদ্ধ কমলা-হলুদ রঙের ফুলগুলো ফোটে। পত্রহীন ডালপালায় এমন পুষ্পপ্রাচুর্য খুব সহজেই নজর কাড়ে। হলুদ রঙের ছোট ছোট ফুল প্রায় দেড় সেন্টিমিটার চওড়া। ফুলের ভেতরটা বেগুনি রঙের। ফুল ঝরে পড়তে না পড়তেই ডালের আগায় ফল আসতে শুরু করে। কিছুটা রোমশ গায়ের এই ফলগুলোর পাকা রং গাঢ়-লাল।
ছবি :লেখক
মন্তব্য করুন