
জলমগ্ন বাঙলাদেশ : নাকি এক ল্যাগবেগে তরল ড্রাগন
হিমালয় থেকে নেমে গিলেছে শস্যের মাঠ, বন-উপবন;
নিঝুম দ্বীপের মতো ভাসমান শুধু কিছু ক্লিন্ন লোকালয়
তাকেও জুজুর মতো লেলিহান জিহ্বা নেড়ে সে দেখায় ভয়,
তবুও জীবনছন্দে মুখরিত ব্যস্ত জনপদ
উজিয়ে সকল বাধা, পায়ে-পায়ে সমূহ বিপদ
যে-যার কর্তব্যে যায়; অজানা আতঙ্কে কাঁপে দুরুদুরু জননীর প্রাণ
কোমরে ঘুঙুর বেঁধে ছেড়ে দিয়ে হাঁটি-হাঁটি কোলের সন্তান।
শব্দ শুনে বুঝে নেয় নানা কাজে ব্যস্ত প্রিয়জন
কতদূর হেঁটে গেল দুষ্টুমতি তাদের খোকন!
'ডুবে যেতে-যেতে' শিরোনামের আমার এই কবিতাটির প্রথম স্তবক উদ্ধৃত করে শুরু করলাম। কারণ নদীমাতৃক বাংলাদেশের যে চিত্র এখানে পাই তাতে সহজেই অনুমেয় বাংলাদেশের অধিকাংশ 'খোকন'কে সাঁতার শেখাতে হয় না। গুরুজনদের চোখ ফাঁকি দিয়ে নদীতীরবর্তী জনপদের খোকনরা নিজে নিজেই জলখেলা খেলতে খেলতে কখন যে সাঁতার শিখে যায়, নিজেও জানতে পারে না। আমাকে আমার শৈশবে সাঁতার শিখিয়েছেন আড়িয়াল খাঁ- না, তিনি খাঁ-বাড়ির কোনো ব্যক্তি নন- নদী আড়িয়াল খাঁ। বাংলাদেশে এই একই নামের জলাধার আছে দুটি। কিশোরগঞ্জ ও নরসিংদী জেলাজুড়ে প্রবাহিত এই নামের জলধারা স্ত্রীলিঙ্গের-নদী আর অন্য যেটি ফরিদপুর, মাদারীপুর এবং বরিশাল জেলায় প্রবহমান তা পুংলিঙ্গের-নদ। আমার শৈশবে বর্ষাকাল এলে অজস্র শাখা-প্রশাখা বেয়ে-বেয়ে কিশোরগঞ্জের আড়িয়াল খাঁ নিজেই ল্যাগবেগিয়ে চলে আসতেন প্রায় আমাদের বাড়ির আঙিনায়; তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রবল আকর্ষণে চুপি চুপি ডাকতেন আমাকে, আমার মতোই দুরন্ত কিছু সঙ্গী ও সঙ্গিনীকে; স্রোতস্বিনী আড়িয়াল খাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে কখন কীভাবে যে দুঃসাহসী এক সুদক্ষ সাঁতারুই হয়ে গেলাম তা আজ আর মনে নেই। ধরে ধরে কেউ যদি আমাকে সাঁতার শেখাতেন তবে আজও তার নাম মনে পড়ত। এমন কারও নাম মনে নেই। শুধু মনে আছে শৈশবের জলখেলার কিছু স্মৃতি; কিছু ঘটনা-দুর্ঘটনার চিত্র এই মুহূর্তে জীবন্ত হয়ে উঠছে মস্তিস্কের কোষে কোষে।
আড়িয়াল খাঁ নদী-প্লাবিত কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার চর আলগী গ্রামে আমার পৈতৃক নিবাস। সেখানে এবং এর আগে পার্শ্ববর্তী নানার বাড়িতে কেটেছে আমার বাল্যকাল; আমি যখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি আমার বড় ভাই সিরাজউদ্দিন আহমেদ তখন ভৈরব হাজী আসমত কলেজের ছাত্র। থাকতেন কলেজের হোস্টেলে। বর্ষাকালে ছুটিছাটায় বাড়ি এলে তার শখ ছিল কলাগাছের ভেলায় চড়ে বড়শিতে তেলাপোকার টোপ গেঁথে সিলন মাছ ধরা (নদীর সঙ্গে সেই লালচে-মুখের মাছটিও আজ বিলুপ্তপ্রায়)। বড়শিতে সিলন মাছ ধরার জন্য অন্যরা টোপ হিসেবে কী ব্যবহার করতেন বা করে থাকেন জানি না। তবে আমার বড় ভাই টোপ হিসেবে ব্যবহার করতেন তেলাপোকা। বড়শি দিয়ে সিলন মাছ ধরা আর অন্য মাছ ধরার মধ্যে পার্থক্য আছে বিস্তর। সিলন মাছ ধরার বড়শিতে ফাতনা লাগাতে হয় না কারণ বড়শি ও সুতা সবটাই থাকে পানির ওপর। টোপ হিসেবে যে তেলাপোকা ব্যবহার করা হয় তা-ও পানিতে ডোবে না। ফলে পানিতে ছিপ ফেলে ফাতনার দিকে চেয়ে থাকার উপায় নেই, প্রয়োজনও নেই। সিলন মাছ বদ্ধ পানিতে থাকে না; প্রবল স্রোতের পানিতে তার চলাফেরা। অতএব, বড়শিতে তেলাপোকা গেঁথে পানির ওপর ঘন ঘন ছিপ ওঠানামা করে সিলন মাছকে প্রলুপ্ত করতেন আমার বড় ভাই। অনেক সময় লাফ দিয়ে পানির ওপরে উঠেও টোপসহ বড়শি গিলে ফেলতে দেখেছি আমি। সম্ভবত তেলাপোকার গন্ধে দারুণ আকৃষ্ট হতো আমাদের শিকার। এই মাছ ধরতে যাওয়ার আগে তেলাপোকা ধরার দায়িত্বটা প্রায়শ পড়ত আমার ঘাড়েই। বাড়ি বাড়ি ঘুরে একটা বাঁশের চোঙায় তেলাপোকা এনে বড় ভাইয়ের সঙ্গে জলখেলা আর মাছ ধরতে যেতাম। মা-বাবা আমাদের দুই ভাইকে বাধা দিতেন না কারণ আমরা ডোলাভর্তি মাছ নিয়েই ফিরতাম, খালি হাতে কোনোদিন বাড়ি ফিরিনি। এ ছাড়া মাছ ধরতে গিয়ে পানিতে ডুবে যাব সে ভয়ও তাদের ছিল না কারণ আমরা দু'জনই ছিলাম দক্ষ সাঁতারু। তবে, একদিনের দুর্ঘটনার কথা মনে পড়লে আজও গা শিউরে ওঠে।
আজ যারা কটিয়াদী অঞ্চলে মৃতপ্রায় আড়িয়াল খাঁ নদীকে দেখেন মুখ থুবড়ে পড়ে আছে তাদের পক্ষে বোঝা মুশকিল যৌবনে কতটা প্রমত্ত ছিল এই নদী। টোকনয়ন বাজারের কাছে স্রোতস্বিনী বানার নদীর সঙ্গে মিলিত হয়ে তেজোদ্দীপ্ত আড়িয়াল খাঁ প্রবল বেগে ধাবিত হতো বেলাব-রায়পুরা হয়ে মেঘনার সাথে মিলিত হওয়ার বাসনায়। সে-কালের বানার নদীতে কাচকি মাছ আর আড়িয়াল খাঁ নদে সিলন মাছের অস্তিত্বই সাক্ষ্য দেয় কতটা গতিশীল ছিল সেই জলপ্রবাহ। কারণ কাচকি মাছ আকারে ছোট হলেও স্রোতের উজানে চলা তার স্বভাব; সিলন মাছের স্বভাবও অনেকটা কাচকির মতোই। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে (১৯৬৬-৬৮ সালে) ঢাকা কলেজের ছাত্র হিসেবে আমি প্রায়ই ঘুরতে যেতাম নিউ মার্কেট এলাকায়। মাছবাজারের পাশ দিয়ে যেতে যেতে প্রায়ই শুনতে পেতাম বিক্রেতাদের হাঁক- 'নিয়া যান স্যার, বানার নদীর কাচকি মাছ ...।' বলতে গেলে বানার নদীর স্রোতধারা টোকের কাছে এসে আড়িয়াল খাঁর সঙ্গে মিলিত হয়ে তাকে বেগবান করে তুলেছিল বেশি। সেই প্রমত্ত আড়িয়াল খাঁর স্র্রোতের মুখে একদিন প্রায় ডুবতে বসেছিলাম আমরা দুই ভাই।
আমরা ছিলাম সেদিন নানার বাড়িতে। কলাগাছের একটা ভেলায় চড়ে বড়শি আর তেলাপোকার চোঙা নিয়ে সিলন মাছ ধরতে গেছি বাড়ির কাছেই। কলার ভেলা স্রোতের তোড়ে যেন ভেসে না যায় তাকে বেঁধে রাখা হয়েছিল বানের জলে অর্ধ-নিমগ্ন একটা গাছের সঙ্গে। চোঙা থেকে একটা তেলাপোকা নিয়ে আমার বড় ভাই বড়শিতে গেঁথে তাকে নাচিয়ে চলেছেন পানির ওপর। কয়েক মিনিটের মধ্যেই বেশ বড় আকারের একটা সিলন মাছ ধরা পড়ল তার বড়শিতে। মনের আনন্দে ছিপে টান দিতে গিয়ে এতটাই বেঁকে গিয়েছিল তার শরীর যে তাল সামলাতে না পেরে কলাগাছের ভেলাটাই দিলেন উল্টে। আমরা দুই ভাই তখন একসঙ্গে পানিতে পড়ে গেছি। আমি কোনোক্রমে উল্টে যাওয়া কলাগাছের ভেলায় ধরে পানিতে ভাসছি; ভেলা যথারীতি দড়ি দিয়ে বাঁধা আছে গাছের সঙ্গে। তাই স্রোত আমাকে টেনে নিতে পারছে না কিন্তু আমার বড় ভাই ছিটকে পড়েছেন ভেলা থেকে দূরে; হাতের বড়শি ছেড়ে দিয়ে স্রোতের অনুকূলে পুবদিকে ভাটিতে ভেসে যাওয়া ছাড়া তার আর উপায় ছিল না। আমি ভেলা ছেড়ে সাঁতার কেটে দ্রুতই বাড়ি চলে গেলাম এবং বড় ভাই যে পুবদিকে ভেসে যাচ্ছেন তা সকলকে উদ্বেগের সঙ্গে জানালাম। আমার মা ও নানা-নানি হা-হুতাশ করতে করতে পানির কিনার ধরে দৌড়ে গিয়ে চিৎকার করে ভাসমান ও বহমান আমার বড় ভাইকে নানা উপদেশ দিচ্ছেন- কী করে পারে আসবেন কিন্তু তিনি পারের দিকে আসার চেষ্টা করেও স্রোতের তোড়ে তা পারছেন না। একসময় দেখা গেল- আমাদের দিকে আসতে না পারলেও অন্য পারের দিকে ধীরে ধীরে যেতে পারছেন তিনি। দূরে হলেও, সারা শরীর নিমজ্জিত হলেও, মাথাভর্তি চুলের জন্য তিনি ছিলেন আমাদের দৃষ্টিসীমায়। শেষ রক্ষা হলো। ওপারে ওঠার পর নৌকায় করে বাড়ি ফিরলেন তিনি।
এই ঘটনার পর থেকে আমার মা ও নানা-নানি নদীতে আমাদের জলখেলা ও মাছ ধরতে যাওয়াকে ভালো চোখে দেখতেন না। এর পর আমাদের জলে যাওয়ার কথা শুনলেই অজানা এক আতঙ্ক কাজ করত তাদের মনের মধ্যে।
কয়েক বছর পরের কথা। আমি তখন ভর্তি হয়েছি কটিয়াদী হাই স্কুলে। কখনও সাইকেলে চড়ে, কখনও হেঁটে সাড়ে-তিন মাইল দূরের স্কুলে যেতে-আসতে হয়। একদিন মেঘলা দিনে ঝোড়ো হাওয়া বইছে। থেকে থেকে বৃষ্টিও পড়ছে। স্কুুলশেষে মুগদিয়া বাজারে পৌঁছে দেখি গুদারা (খেয়া নৌকা) বন্ধ। খিদেয় পেট চুঁচুঁঁ করছে। দ্রুত বাড়ি ফিরতে হবে, কিন্তু উপায় নেই। পরিচিত কোনো নৌকাও চোখে পড়ছে না। অগত্যা মনের কোণে এক দুঃসাহস আমাকে তাড়া দিচ্ছে সাঁতার কেটে সেই জলপথ পাড়ি দেওয়ার! সাঁতরাতে হবে প্রায় সিকি মাইল। আমার জন্য তেমন কোনো কঠিন কাজ নয় কিন্তু দিনের মতিগতি ভালো নয়। ঢেউ বইছে উল্টাপাল্টা। মাঝনদীতে গিয়ে ঝড়ের গতি বেড়ে গেলে বিপদ হতে পারে। অন্য এক চিন্তা মাথায় কাজ করছে: হাতের বইপত্র কোথায় রেখে যাব! মুগদিয়া বাজারে তখন তিনটি মাত্র স্থায়ী দোকান ছিল। বাকিগুলো ছাপরা ঘর- কেবল হাটের দিনে দোকানিরা পসরা নিয়ে এগুলোর নিচে বসেন। সবই সেদিন ফাঁকা ছিল। দিনের অবস্থা আসলেই খারাপ। আশেপাশে লোকজন নেই। সঙ্গে বই আছে দুইটা, খাতাও দুইটা। সেকালে গ্রামের ছেলেমেয়েদের স্কুলব্যাগের বালাই ছিল না। নিত্যদিনের পাঠ্যবই ও খাতা নিয়ে যেতাম হাতে করে, কখনওবা বগলদাবা করে; যেদিন সাইকেলে যেতাম সেদিন ক্যারিয়ারে করে। আজ এই ঝঞ্ঝাকবলিত জলপথ পাড়ি দিতে হলে বইখাতা ফেলে দিতে হবে কিংবা এক হাতে বইখাতা উঁচিয়ে ধরে আরেক হাতে সাঁতার কাটতে হবে। পেটের জ্বালায় অস্থির হয়ে, বইখাতার মায়ায় জড়িয়ে, আমি শেষের পথটাই বেছে নিলাম; মানে বাম হাতে বইখাতা উঁচিয়ে ধরে ডান হাতে সাঁতার কেটে নদী পাড়ি দেব! সাঁতারু হিসেবে সে-দক্ষতা আমার ছিল।
আমি যেখানে বসেছিলাম (মুগদিয়া বাজারে) আমাদের বাড়ি সেখান থেকে সরাসরি ওপারে। মুগদিয়া থেকে রওনা দিলে স্রোতের তোড়ে ভেসে যেতে হবে আমাদের ঘাট থেকে অনেক পুবদিকে। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম একটু পশ্চিমদিকে এগিয়ে গিয়ে সাঁতার শুরু করব যেন স্রোতের তোড় এবং সাঁতারে আমার নিজস্ব শক্তি মিলে সঠিক গন্তব্যে আমাকে পৌঁছে দেয়। আমি তাই করলাম। বুরুদিয়া ঘাট অবধি পশ্চিমে এগিয়ে গিয়ে সাঁতার শুরু করলাম। আড়িয়াল খাঁ তার যে জলটুকু আমাদের এ-অঞ্চলে পাঠিয়েছে তার জন্য সেদিন তাকে বেশ গালি দিয়েছিলাম কারণ পারে বসে নদীর অবস্থা যা দেখেছিলাম মাঝনদীতে এসে দেখলাম পানির মতিগতি তার চেয়ে অনেক খারাপ। এর ওপর সাঁতরে চলেছি মাত্র এক হাতে আর দুই পায়ের সহায়তায়। বাম হাতে উঁচিয়ে রেখেছি বইখাতা। যখন মনে হলো আর পারছি না তখন কেবল ভেসে থাকলাম বেশ কিছুক্ষণ। আমাদের বাড়ির ঘাট এখনও নাগালের মধ্যে আছে। পশ্চিমদিকে বেশ কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে পানিতে নামার সুফল পেতে শুরু করেছি। চিৎকার করে খাবার চাইতে চাইতে বাড়ি পৌঁছার পর আমার ভেজা কাপড় দেখে মা যেন বুঝতে পারলেন আমি সাঁতার কেটে বাড়ি এসেছি। কারণ ঝোড়ো হাওয়া বইলেও বৃষ্টি থেমে ছিল কয়েক ঘণ্টা আগেই। আমার কাপড় ভেজা থাকার কথা নয়। এ বিষয়ে বারবার আমাকে প্রশ্ন করছিলেন তিনি। আমি চেপে গেলাম, বললাম নৌকায় এসেছি; বৃষ্টির সময় আগে ভিজেছিলাম বলে বাড়ি আসার আগে গোসল করে এসেছি। মায়ের বকাঝকা খাওয়া থেকে বাঁচার জন্য সেদিন এই ছলচাতুরীর আশ্রয় নিতে হয়েছিল আমাকে। অবশ্য সত্য কথাটি বলেছিলাম অনেকদিন পরে। তখন আর বকাঝকা খেতে হয়নি; যা শুনতে হয়েছিল তাকে বলা যায় আদরমিশ্রিত 'সাবধান বাণী'।
কিশোরগঞ্জের ছেলে হয়ে আমার শৈশবের জলখেলার কথা যদি কেবল আড়িয়াল খাঁর জলেই সীমাবদ্ধ রাখি তবে তা হবে অর্ধসত্যের প্রকাশ। কিশোরগঞ্জের লোকজন, ছেলেবুড়ো নির্বিশেষে তাদের জলখেলার বেশিরভাগ খেলেন পুকুর-দিঘিতে। বিশেষত হিন্দু-অধ্যুষিত এলাকায়, দ্বিধাহীন চিত্তে মেয়েরাও পুরুষদের সঙ্গে পুকুরে জলকেলি করতে ভালোবাসে; গঙ্গার জলে পুণ্যস্নানের অভিজ্ঞতা তাদের সে সাহস জুগিয়েছে, আর এই অভ্যাস গঠনে সহায়তা করেছে। পুকুরে-দিঘিতে সেইসব জলখেলার সঙ্গী হয়েছি আমিও বহুকাল। আজও সেই স্মৃতি রক্তেরল্প্রেব্দ বহন করে চলেছি; প্রায়শ ঝলকে ওঠে আমার কবিতায়, অবচেতনায় :
ভেজা-কিশোরীর শরীরের ঘ্রাণে সম্ব্বিতে ফিরে দেখি
চৈত্রের মতো গদ্যরমণী চোখ ঠারে তার মেকি ...
কিংবা
আমার ভেতরে লুকোচুরি খেলে অজবাঙলার সুপুরিবাগান,
তার ফাঁকে-ফাঁকে পলাশডাঙার মানিকের ছোটবোন;
জগমোহনের পুকুরের ঘাটে নিবিড় স্নানের শেষে
কী এক কথার লজ্জার ভারে
নতমুখী সেই লাল হয়ে-যাওয়া দীপালি ও মনোরমা-
তোমাকে দেখেই আরো মনে হলো :
আমার শোণিতে সেইটুকু পাপ চিরদিন থাক জমা!
কৈশোরে অর্জিত জলখেলার সেই দক্ষতা লাগাতে চেয়েছিলাম দেশোদ্ধারের কাজে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আমি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে আমার এক বছরের সিনিয়র আমার পাশের গ্রামের আলাউদ্দিন আহমেদ (পরবর্তীকালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সাংসদ ও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা) আগরতলায় গিয়ে নাম লেখাই নৌ-কমান্ডো হিসেবে প্রশিক্ষণের জন্য। এর পেছনে কাজ করেছে শৈশবের জলখেলায় সুদক্ষ সাঁতারু হিসেবে আমাদের গড়ে ওঠার অভিজ্ঞতা। দু'জন একসঙ্গে পলাশীর নৌ-কমান্ডো প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে কিছুদিন পায়ে ফিন লাগিয়ে 'ফ্রগম্যান' সেজে ভাগীরথীর জলে সাঁতার কেটেছি। কিন্তু ডুবসাঁতারে অদক্ষতা সিগারেটখোর আমাদের কয়েকজনকে ডুবিয়েছিল। নির্ধারিত এক মিনিটের ডুবসাঁতারে ব্যর্থ হওয়ার পর আমাদের কয়েকজনকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বিহারের চাকুলিয়া স্পেশাল ক্যাম্পে স্থল-কমান্ডো হিসেবে প্রশিক্ষণের জন্য। সেখানে পূর্ণাঙ্গ প্রশিক্ষণের পর ৩ নম্বর সেক্টরের অধীনে আমি কিশোরগঞ্জ এলাকায় যুদ্ধ করি। ধুলদিয়া রেলসেতু অপারেশনে আমার সাফল্যে বিশাল এক বাহিনীর কমান্ড আমার হাতে আসে। স্বাধীনতার পর একপর্যায়ে সমগ্র্র কিশোরগঞ্জ মহকুমা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের চিফ কমান্ড্যান্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। আমাদের চেয়ারম্যান ছিলেন অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ, যিনি বর্তমানে বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি। সরকারি নির্দেশে মহকুমা ক্যাম্পগুলো বন্ধ হয়ে গেলে আমি তাঁর কাছেই আমার দাপ্তরিক দায়িত্ব হস্তান্তর করেছিলাম। একটি প্রত্যয়নপত্রে তিনি লিখেছেন : কিশোরগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধে আমার ভূমিকা ছিল একজন সাব-সেক্টর কমান্ডারের সমতুল্য। পলাশীর নৌ-কমান্ডো প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে ডুবসাঁতারে ব্যর্থ না হলে আমার সেই সাফল্য অর্জিত হতো না। সাঁতারে দক্ষ বলেই নাম লিখিয়েছিলাম নৌ-কমান্ডো হবার বাসনায়, ডুবসাঁতারে ব্যর্থতা আমাকে দিয়েছিল স্থল-কমান্ডো হিসেবে পূর্ণাঙ্গ প্রশিক্ষণের সুযোগ আর দান করেছিল বিশাল এক বাহিনীর অধিনায়ক হওয়ার গৌরব। অতএব, আমার যৌবনের জলখেলায় সেই আংশিক ব্যর্থতাই ছিল প্রকারান্তরে মুক্তিযুদ্ধে আমার সাফল্যের সোপান।
হিমালয় থেকে নেমে গিলেছে শস্যের মাঠ, বন-উপবন;
নিঝুম দ্বীপের মতো ভাসমান শুধু কিছু ক্লিন্ন লোকালয়
তাকেও জুজুর মতো লেলিহান জিহ্বা নেড়ে সে দেখায় ভয়,
তবুও জীবনছন্দে মুখরিত ব্যস্ত জনপদ
উজিয়ে সকল বাধা, পায়ে-পায়ে সমূহ বিপদ
যে-যার কর্তব্যে যায়; অজানা আতঙ্কে কাঁপে দুরুদুরু জননীর প্রাণ
কোমরে ঘুঙুর বেঁধে ছেড়ে দিয়ে হাঁটি-হাঁটি কোলের সন্তান।
শব্দ শুনে বুঝে নেয় নানা কাজে ব্যস্ত প্রিয়জন
কতদূর হেঁটে গেল দুষ্টুমতি তাদের খোকন!
'ডুবে যেতে-যেতে' শিরোনামের আমার এই কবিতাটির প্রথম স্তবক উদ্ধৃত করে শুরু করলাম। কারণ নদীমাতৃক বাংলাদেশের যে চিত্র এখানে পাই তাতে সহজেই অনুমেয় বাংলাদেশের অধিকাংশ 'খোকন'কে সাঁতার শেখাতে হয় না। গুরুজনদের চোখ ফাঁকি দিয়ে নদীতীরবর্তী জনপদের খোকনরা নিজে নিজেই জলখেলা খেলতে খেলতে কখন যে সাঁতার শিখে যায়, নিজেও জানতে পারে না। আমাকে আমার শৈশবে সাঁতার শিখিয়েছেন আড়িয়াল খাঁ- না, তিনি খাঁ-বাড়ির কোনো ব্যক্তি নন- নদী আড়িয়াল খাঁ। বাংলাদেশে এই একই নামের জলাধার আছে দুটি। কিশোরগঞ্জ ও নরসিংদী জেলাজুড়ে প্রবাহিত এই নামের জলধারা স্ত্রীলিঙ্গের-নদী আর অন্য যেটি ফরিদপুর, মাদারীপুর এবং বরিশাল জেলায় প্রবহমান তা পুংলিঙ্গের-নদ। আমার শৈশবে বর্ষাকাল এলে অজস্র শাখা-প্রশাখা বেয়ে-বেয়ে কিশোরগঞ্জের আড়িয়াল খাঁ নিজেই ল্যাগবেগিয়ে চলে আসতেন প্রায় আমাদের বাড়ির আঙিনায়; তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রবল আকর্ষণে চুপি চুপি ডাকতেন আমাকে, আমার মতোই দুরন্ত কিছু সঙ্গী ও সঙ্গিনীকে; স্রোতস্বিনী আড়িয়াল খাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে কখন কীভাবে যে দুঃসাহসী এক সুদক্ষ সাঁতারুই হয়ে গেলাম তা আজ আর মনে নেই। ধরে ধরে কেউ যদি আমাকে সাঁতার শেখাতেন তবে আজও তার নাম মনে পড়ত। এমন কারও নাম মনে নেই। শুধু মনে আছে শৈশবের জলখেলার কিছু স্মৃতি; কিছু ঘটনা-দুর্ঘটনার চিত্র এই মুহূর্তে জীবন্ত হয়ে উঠছে মস্তিস্কের কোষে কোষে।
আড়িয়াল খাঁ নদী-প্লাবিত কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলার চর আলগী গ্রামে আমার পৈতৃক নিবাস। সেখানে এবং এর আগে পার্শ্ববর্তী নানার বাড়িতে কেটেছে আমার বাল্যকাল; আমি যখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি আমার বড় ভাই সিরাজউদ্দিন আহমেদ তখন ভৈরব হাজী আসমত কলেজের ছাত্র। থাকতেন কলেজের হোস্টেলে। বর্ষাকালে ছুটিছাটায় বাড়ি এলে তার শখ ছিল কলাগাছের ভেলায় চড়ে বড়শিতে তেলাপোকার টোপ গেঁথে সিলন মাছ ধরা (নদীর সঙ্গে সেই লালচে-মুখের মাছটিও আজ বিলুপ্তপ্রায়)। বড়শিতে সিলন মাছ ধরার জন্য অন্যরা টোপ হিসেবে কী ব্যবহার করতেন বা করে থাকেন জানি না। তবে আমার বড় ভাই টোপ হিসেবে ব্যবহার করতেন তেলাপোকা। বড়শি দিয়ে সিলন মাছ ধরা আর অন্য মাছ ধরার মধ্যে পার্থক্য আছে বিস্তর। সিলন মাছ ধরার বড়শিতে ফাতনা লাগাতে হয় না কারণ বড়শি ও সুতা সবটাই থাকে পানির ওপর। টোপ হিসেবে যে তেলাপোকা ব্যবহার করা হয় তা-ও পানিতে ডোবে না। ফলে পানিতে ছিপ ফেলে ফাতনার দিকে চেয়ে থাকার উপায় নেই, প্রয়োজনও নেই। সিলন মাছ বদ্ধ পানিতে থাকে না; প্রবল স্রোতের পানিতে তার চলাফেরা। অতএব, বড়শিতে তেলাপোকা গেঁথে পানির ওপর ঘন ঘন ছিপ ওঠানামা করে সিলন মাছকে প্রলুপ্ত করতেন আমার বড় ভাই। অনেক সময় লাফ দিয়ে পানির ওপরে উঠেও টোপসহ বড়শি গিলে ফেলতে দেখেছি আমি। সম্ভবত তেলাপোকার গন্ধে দারুণ আকৃষ্ট হতো আমাদের শিকার। এই মাছ ধরতে যাওয়ার আগে তেলাপোকা ধরার দায়িত্বটা প্রায়শ পড়ত আমার ঘাড়েই। বাড়ি বাড়ি ঘুরে একটা বাঁশের চোঙায় তেলাপোকা এনে বড় ভাইয়ের সঙ্গে জলখেলা আর মাছ ধরতে যেতাম। মা-বাবা আমাদের দুই ভাইকে বাধা দিতেন না কারণ আমরা ডোলাভর্তি মাছ নিয়েই ফিরতাম, খালি হাতে কোনোদিন বাড়ি ফিরিনি। এ ছাড়া মাছ ধরতে গিয়ে পানিতে ডুবে যাব সে ভয়ও তাদের ছিল না কারণ আমরা দু'জনই ছিলাম দক্ষ সাঁতারু। তবে, একদিনের দুর্ঘটনার কথা মনে পড়লে আজও গা শিউরে ওঠে।
আজ যারা কটিয়াদী অঞ্চলে মৃতপ্রায় আড়িয়াল খাঁ নদীকে দেখেন মুখ থুবড়ে পড়ে আছে তাদের পক্ষে বোঝা মুশকিল যৌবনে কতটা প্রমত্ত ছিল এই নদী। টোকনয়ন বাজারের কাছে স্রোতস্বিনী বানার নদীর সঙ্গে মিলিত হয়ে তেজোদ্দীপ্ত আড়িয়াল খাঁ প্রবল বেগে ধাবিত হতো বেলাব-রায়পুরা হয়ে মেঘনার সাথে মিলিত হওয়ার বাসনায়। সে-কালের বানার নদীতে কাচকি মাছ আর আড়িয়াল খাঁ নদে সিলন মাছের অস্তিত্বই সাক্ষ্য দেয় কতটা গতিশীল ছিল সেই জলপ্রবাহ। কারণ কাচকি মাছ আকারে ছোট হলেও স্রোতের উজানে চলা তার স্বভাব; সিলন মাছের স্বভাবও অনেকটা কাচকির মতোই। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে (১৯৬৬-৬৮ সালে) ঢাকা কলেজের ছাত্র হিসেবে আমি প্রায়ই ঘুরতে যেতাম নিউ মার্কেট এলাকায়। মাছবাজারের পাশ দিয়ে যেতে যেতে প্রায়ই শুনতে পেতাম বিক্রেতাদের হাঁক- 'নিয়া যান স্যার, বানার নদীর কাচকি মাছ ...।' বলতে গেলে বানার নদীর স্রোতধারা টোকের কাছে এসে আড়িয়াল খাঁর সঙ্গে মিলিত হয়ে তাকে বেগবান করে তুলেছিল বেশি। সেই প্রমত্ত আড়িয়াল খাঁর স্র্রোতের মুখে একদিন প্রায় ডুবতে বসেছিলাম আমরা দুই ভাই।
আমরা ছিলাম সেদিন নানার বাড়িতে। কলাগাছের একটা ভেলায় চড়ে বড়শি আর তেলাপোকার চোঙা নিয়ে সিলন মাছ ধরতে গেছি বাড়ির কাছেই। কলার ভেলা স্রোতের তোড়ে যেন ভেসে না যায় তাকে বেঁধে রাখা হয়েছিল বানের জলে অর্ধ-নিমগ্ন একটা গাছের সঙ্গে। চোঙা থেকে একটা তেলাপোকা নিয়ে আমার বড় ভাই বড়শিতে গেঁথে তাকে নাচিয়ে চলেছেন পানির ওপর। কয়েক মিনিটের মধ্যেই বেশ বড় আকারের একটা সিলন মাছ ধরা পড়ল তার বড়শিতে। মনের আনন্দে ছিপে টান দিতে গিয়ে এতটাই বেঁকে গিয়েছিল তার শরীর যে তাল সামলাতে না পেরে কলাগাছের ভেলাটাই দিলেন উল্টে। আমরা দুই ভাই তখন একসঙ্গে পানিতে পড়ে গেছি। আমি কোনোক্রমে উল্টে যাওয়া কলাগাছের ভেলায় ধরে পানিতে ভাসছি; ভেলা যথারীতি দড়ি দিয়ে বাঁধা আছে গাছের সঙ্গে। তাই স্রোত আমাকে টেনে নিতে পারছে না কিন্তু আমার বড় ভাই ছিটকে পড়েছেন ভেলা থেকে দূরে; হাতের বড়শি ছেড়ে দিয়ে স্রোতের অনুকূলে পুবদিকে ভাটিতে ভেসে যাওয়া ছাড়া তার আর উপায় ছিল না। আমি ভেলা ছেড়ে সাঁতার কেটে দ্রুতই বাড়ি চলে গেলাম এবং বড় ভাই যে পুবদিকে ভেসে যাচ্ছেন তা সকলকে উদ্বেগের সঙ্গে জানালাম। আমার মা ও নানা-নানি হা-হুতাশ করতে করতে পানির কিনার ধরে দৌড়ে গিয়ে চিৎকার করে ভাসমান ও বহমান আমার বড় ভাইকে নানা উপদেশ দিচ্ছেন- কী করে পারে আসবেন কিন্তু তিনি পারের দিকে আসার চেষ্টা করেও স্রোতের তোড়ে তা পারছেন না। একসময় দেখা গেল- আমাদের দিকে আসতে না পারলেও অন্য পারের দিকে ধীরে ধীরে যেতে পারছেন তিনি। দূরে হলেও, সারা শরীর নিমজ্জিত হলেও, মাথাভর্তি চুলের জন্য তিনি ছিলেন আমাদের দৃষ্টিসীমায়। শেষ রক্ষা হলো। ওপারে ওঠার পর নৌকায় করে বাড়ি ফিরলেন তিনি।
এই ঘটনার পর থেকে আমার মা ও নানা-নানি নদীতে আমাদের জলখেলা ও মাছ ধরতে যাওয়াকে ভালো চোখে দেখতেন না। এর পর আমাদের জলে যাওয়ার কথা শুনলেই অজানা এক আতঙ্ক কাজ করত তাদের মনের মধ্যে।
কয়েক বছর পরের কথা। আমি তখন ভর্তি হয়েছি কটিয়াদী হাই স্কুলে। কখনও সাইকেলে চড়ে, কখনও হেঁটে সাড়ে-তিন মাইল দূরের স্কুলে যেতে-আসতে হয়। একদিন মেঘলা দিনে ঝোড়ো হাওয়া বইছে। থেকে থেকে বৃষ্টিও পড়ছে। স্কুুলশেষে মুগদিয়া বাজারে পৌঁছে দেখি গুদারা (খেয়া নৌকা) বন্ধ। খিদেয় পেট চুঁচুঁঁ করছে। দ্রুত বাড়ি ফিরতে হবে, কিন্তু উপায় নেই। পরিচিত কোনো নৌকাও চোখে পড়ছে না। অগত্যা মনের কোণে এক দুঃসাহস আমাকে তাড়া দিচ্ছে সাঁতার কেটে সেই জলপথ পাড়ি দেওয়ার! সাঁতরাতে হবে প্রায় সিকি মাইল। আমার জন্য তেমন কোনো কঠিন কাজ নয় কিন্তু দিনের মতিগতি ভালো নয়। ঢেউ বইছে উল্টাপাল্টা। মাঝনদীতে গিয়ে ঝড়ের গতি বেড়ে গেলে বিপদ হতে পারে। অন্য এক চিন্তা মাথায় কাজ করছে: হাতের বইপত্র কোথায় রেখে যাব! মুগদিয়া বাজারে তখন তিনটি মাত্র স্থায়ী দোকান ছিল। বাকিগুলো ছাপরা ঘর- কেবল হাটের দিনে দোকানিরা পসরা নিয়ে এগুলোর নিচে বসেন। সবই সেদিন ফাঁকা ছিল। দিনের অবস্থা আসলেই খারাপ। আশেপাশে লোকজন নেই। সঙ্গে বই আছে দুইটা, খাতাও দুইটা। সেকালে গ্রামের ছেলেমেয়েদের স্কুলব্যাগের বালাই ছিল না। নিত্যদিনের পাঠ্যবই ও খাতা নিয়ে যেতাম হাতে করে, কখনওবা বগলদাবা করে; যেদিন সাইকেলে যেতাম সেদিন ক্যারিয়ারে করে। আজ এই ঝঞ্ঝাকবলিত জলপথ পাড়ি দিতে হলে বইখাতা ফেলে দিতে হবে কিংবা এক হাতে বইখাতা উঁচিয়ে ধরে আরেক হাতে সাঁতার কাটতে হবে। পেটের জ্বালায় অস্থির হয়ে, বইখাতার মায়ায় জড়িয়ে, আমি শেষের পথটাই বেছে নিলাম; মানে বাম হাতে বইখাতা উঁচিয়ে ধরে ডান হাতে সাঁতার কেটে নদী পাড়ি দেব! সাঁতারু হিসেবে সে-দক্ষতা আমার ছিল।
আমি যেখানে বসেছিলাম (মুগদিয়া বাজারে) আমাদের বাড়ি সেখান থেকে সরাসরি ওপারে। মুগদিয়া থেকে রওনা দিলে স্রোতের তোড়ে ভেসে যেতে হবে আমাদের ঘাট থেকে অনেক পুবদিকে। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম একটু পশ্চিমদিকে এগিয়ে গিয়ে সাঁতার শুরু করব যেন স্রোতের তোড় এবং সাঁতারে আমার নিজস্ব শক্তি মিলে সঠিক গন্তব্যে আমাকে পৌঁছে দেয়। আমি তাই করলাম। বুরুদিয়া ঘাট অবধি পশ্চিমে এগিয়ে গিয়ে সাঁতার শুরু করলাম। আড়িয়াল খাঁ তার যে জলটুকু আমাদের এ-অঞ্চলে পাঠিয়েছে তার জন্য সেদিন তাকে বেশ গালি দিয়েছিলাম কারণ পারে বসে নদীর অবস্থা যা দেখেছিলাম মাঝনদীতে এসে দেখলাম পানির মতিগতি তার চেয়ে অনেক খারাপ। এর ওপর সাঁতরে চলেছি মাত্র এক হাতে আর দুই পায়ের সহায়তায়। বাম হাতে উঁচিয়ে রেখেছি বইখাতা। যখন মনে হলো আর পারছি না তখন কেবল ভেসে থাকলাম বেশ কিছুক্ষণ। আমাদের বাড়ির ঘাট এখনও নাগালের মধ্যে আছে। পশ্চিমদিকে বেশ কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে পানিতে নামার সুফল পেতে শুরু করেছি। চিৎকার করে খাবার চাইতে চাইতে বাড়ি পৌঁছার পর আমার ভেজা কাপড় দেখে মা যেন বুঝতে পারলেন আমি সাঁতার কেটে বাড়ি এসেছি। কারণ ঝোড়ো হাওয়া বইলেও বৃষ্টি থেমে ছিল কয়েক ঘণ্টা আগেই। আমার কাপড় ভেজা থাকার কথা নয়। এ বিষয়ে বারবার আমাকে প্রশ্ন করছিলেন তিনি। আমি চেপে গেলাম, বললাম নৌকায় এসেছি; বৃষ্টির সময় আগে ভিজেছিলাম বলে বাড়ি আসার আগে গোসল করে এসেছি। মায়ের বকাঝকা খাওয়া থেকে বাঁচার জন্য সেদিন এই ছলচাতুরীর আশ্রয় নিতে হয়েছিল আমাকে। অবশ্য সত্য কথাটি বলেছিলাম অনেকদিন পরে। তখন আর বকাঝকা খেতে হয়নি; যা শুনতে হয়েছিল তাকে বলা যায় আদরমিশ্রিত 'সাবধান বাণী'।
কিশোরগঞ্জের ছেলে হয়ে আমার শৈশবের জলখেলার কথা যদি কেবল আড়িয়াল খাঁর জলেই সীমাবদ্ধ রাখি তবে তা হবে অর্ধসত্যের প্রকাশ। কিশোরগঞ্জের লোকজন, ছেলেবুড়ো নির্বিশেষে তাদের জলখেলার বেশিরভাগ খেলেন পুকুর-দিঘিতে। বিশেষত হিন্দু-অধ্যুষিত এলাকায়, দ্বিধাহীন চিত্তে মেয়েরাও পুরুষদের সঙ্গে পুকুরে জলকেলি করতে ভালোবাসে; গঙ্গার জলে পুণ্যস্নানের অভিজ্ঞতা তাদের সে সাহস জুগিয়েছে, আর এই অভ্যাস গঠনে সহায়তা করেছে। পুকুরে-দিঘিতে সেইসব জলখেলার সঙ্গী হয়েছি আমিও বহুকাল। আজও সেই স্মৃতি রক্তেরল্প্রেব্দ বহন করে চলেছি; প্রায়শ ঝলকে ওঠে আমার কবিতায়, অবচেতনায় :
ভেজা-কিশোরীর শরীরের ঘ্রাণে সম্ব্বিতে ফিরে দেখি
চৈত্রের মতো গদ্যরমণী চোখ ঠারে তার মেকি ...
কিংবা
আমার ভেতরে লুকোচুরি খেলে অজবাঙলার সুপুরিবাগান,
তার ফাঁকে-ফাঁকে পলাশডাঙার মানিকের ছোটবোন;
জগমোহনের পুকুরের ঘাটে নিবিড় স্নানের শেষে
কী এক কথার লজ্জার ভারে
নতমুখী সেই লাল হয়ে-যাওয়া দীপালি ও মনোরমা-
তোমাকে দেখেই আরো মনে হলো :
আমার শোণিতে সেইটুকু পাপ চিরদিন থাক জমা!
কৈশোরে অর্জিত জলখেলার সেই দক্ষতা লাগাতে চেয়েছিলাম দেশোদ্ধারের কাজে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আমি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে আমার এক বছরের সিনিয়র আমার পাশের গ্রামের আলাউদ্দিন আহমেদ (পরবর্তীকালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সাংসদ ও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা) আগরতলায় গিয়ে নাম লেখাই নৌ-কমান্ডো হিসেবে প্রশিক্ষণের জন্য। এর পেছনে কাজ করেছে শৈশবের জলখেলায় সুদক্ষ সাঁতারু হিসেবে আমাদের গড়ে ওঠার অভিজ্ঞতা। দু'জন একসঙ্গে পলাশীর নৌ-কমান্ডো প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে কিছুদিন পায়ে ফিন লাগিয়ে 'ফ্রগম্যান' সেজে ভাগীরথীর জলে সাঁতার কেটেছি। কিন্তু ডুবসাঁতারে অদক্ষতা সিগারেটখোর আমাদের কয়েকজনকে ডুবিয়েছিল। নির্ধারিত এক মিনিটের ডুবসাঁতারে ব্যর্থ হওয়ার পর আমাদের কয়েকজনকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বিহারের চাকুলিয়া স্পেশাল ক্যাম্পে স্থল-কমান্ডো হিসেবে প্রশিক্ষণের জন্য। সেখানে পূর্ণাঙ্গ প্রশিক্ষণের পর ৩ নম্বর সেক্টরের অধীনে আমি কিশোরগঞ্জ এলাকায় যুদ্ধ করি। ধুলদিয়া রেলসেতু অপারেশনে আমার সাফল্যে বিশাল এক বাহিনীর কমান্ড আমার হাতে আসে। স্বাধীনতার পর একপর্যায়ে সমগ্র্র কিশোরগঞ্জ মহকুমা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের চিফ কমান্ড্যান্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। আমাদের চেয়ারম্যান ছিলেন অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ, যিনি বর্তমানে বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি। সরকারি নির্দেশে মহকুমা ক্যাম্পগুলো বন্ধ হয়ে গেলে আমি তাঁর কাছেই আমার দাপ্তরিক দায়িত্ব হস্তান্তর করেছিলাম। একটি প্রত্যয়নপত্রে তিনি লিখেছেন : কিশোরগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধে আমার ভূমিকা ছিল একজন সাব-সেক্টর কমান্ডারের সমতুল্য। পলাশীর নৌ-কমান্ডো প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে ডুবসাঁতারে ব্যর্থ না হলে আমার সেই সাফল্য অর্জিত হতো না। সাঁতারে দক্ষ বলেই নাম লিখিয়েছিলাম নৌ-কমান্ডো হবার বাসনায়, ডুবসাঁতারে ব্যর্থতা আমাকে দিয়েছিল স্থল-কমান্ডো হিসেবে পূর্ণাঙ্গ প্রশিক্ষণের সুযোগ আর দান করেছিল বিশাল এক বাহিনীর অধিনায়ক হওয়ার গৌরব। অতএব, আমার যৌবনের জলখেলায় সেই আংশিক ব্যর্থতাই ছিল প্রকারান্তরে মুক্তিযুদ্ধে আমার সাফল্যের সোপান।
বিষয় : প্রচ্ছদ আবিদ আনোয়ার
মন্তব্য করুন