বাংলার সব পরিবারে রান্নার কাজ সাধারণত মায়েরাই করে থাকেন। এ পৃথিবীর অমূল্য যা কিছু তার হয়তো একটি, মায়ের হাতে তৈরি খাবার। পরম মমতায় সন্তানদের জন্য রাঁধেন তিনি। যে খাবারের তুলনা চলে অমৃতের সঙ্গে। তাঁর হাতের রান্না শুধু পেট ভরায় না, মনকেও ভরিয়ে তোলে। নিজ নিজ মায়ের হাতের রান্নার কথা জানিয়েছেন বরেণ্য অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদার ও ত্রপা মজুমদার
ফেরদৌসী মজুমদার
আমার জীবনের সর্বসেরা রাঁধুনি আমার মা। তাঁর হাতের রান্না খাবারে ছিল অতুলনীয় এক স্বাদ। আর মায়ের রান্না সব সময়ই আলাদা লাগে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পরম মমতায় মায়ের হাতের তৈরি করা খাবারের তুলনা চলে অমৃতের সঙ্গে। তাঁর হাতের নিখুঁত বাঙালি রান্নায় সব রকম মসলার পাশাপাশি অন্যরকম একটি মসলা রয়েছে। সেটি হলো ভালোবাসা। একজন মা তাঁর সন্তানের জন্য যত আবেগ ও ভালোবাসা নিয়ে খাবার তৈরি করেন তা অন্যরা শত বছর সাধনা করেও পারবে না। একজন মানুষ যতই পরিপূর্ণ হোক না কেন, বারবার ফিরে যেতে চায় সেই শৈশবে, যেখানে মায়ের রান্নার সুবাসে ম-ম করে চারদিক। সবার জীবনেই এমন কিছু সময় আসে যখন শৈশবের, মায়ের কাছে থাকার সেই দিনগুলো ভীষণ মিস করে। রান্না হলো শিল্পের মতো, শিল্পী হতে হলে অবশ্যই তাঁকে পরিশ্রম করতে হবে। মাকে দেখেছি রান্না নিয়ে পরিশ্রম করতে। রান্নাবান্নায় আমি পটু নই। মায়ের হাতের রান্না রপ্ত করতে আমার অনেক সময় লেগেছে। এখন আমি বুঝতে পারছি যে, 'মায়ের হাতের খাবার'- এই কথাটির মানে কী! রসুইঘরটি তিনি খুব গুছিয়ে রাখতেন। যেজন্য অনেকেরই প্রশংসা পেতেন মা। রেস্টুরেন্টের খাবারের স্বাদ আমার জানা। এত জায়গায় এত খাবার খাওয়া সত্ত্বেও মায়ের হাতের সেই বাঙালি রান্নার অতুলনীয় স্বাদ আর কোথাও খুঁজে পেলাম না। আর খুঁজে পেতেও চাই না।
বড় পরিবারে বেড়ে উঠেছি। চৌদ্দ ভাই-বোনের সংসার। আমি ছিলাম এগারো নম্বরে। আমাদের পরিবার ছিল অত্যন্ত রক্ষণশীল। কড়া শাসন আর আধুনিকতার মিশ্রণে ছিল আমাদের পারিবারিক জীবন। বাড়িতে সন্ধ্যায় মেয়েদের তো বটে, ছেলেদেরও সাড়ে ৮টার মধ্যে ঘরে ফিরতে হতো। আমার বাবা ছিলেন আবদুল হালিম চৌধুরী। তিনি লেখাপড়া আর নামাজ ছাড়া কিছুই বুঝতেন না। তাঁর মনটা ছিল নারিকেলের মতন। বাইরে শক্ত আর ভেতরে নরম। মা যদি বাবাকে বলতেন মেয়েগুলো কাজে একটুও সাহায্য করছে না, তখন বাবাই বরং বলতেন- এখানে কাজের দরকার নেই, করলে নিজের সংসারে গিয়ে করবে। যেজন্য বিয়ের আগে রান্না করিনি কখনও। বিয়ের পর রান্না শিখেছি।
যদিও আজ মায়ের হাতের রান্না নিয়েই বলছি। তারপর মা-বাবা সম্পর্কে কিছু কথা এসেই যায়। আমার নাম উম্মে বারী আফিয়া বেগম। জন্ম কুমিল্লার ভুবনঘরে। মা ছিলেন খুবই সরল মানুষ। কোনো কিছু হলেই ঘোমটা টেনে কেবল নীরবে কাঁদতেন। মাকে জমিদার বংশের বললে ভুল হবে না। নানা রায়ত প্রজা ছিলেন। মায়েদের বাড়িকে মিয়ার বাড়ি বলা হতো। তার মুখে গল্প শুনেছি আমার মুক্তমনা নানির কথা। মা স্কুলে না পড়লেও অনেক জ্ঞান রাখতেন, কথায় কথায় শ্নোক বলতেন; ছড়া কাটতেন। বিখ্যাত কবি-লেখকদের উদ্ৃব্দতি দিতেন, বড় বড় কবিতা মুখস্থ বলতেন। আমাদের বাড়ির নাম ছিল 'দারুল আফিয়া'- আফিয়ার বাড়ি। বাড়ির বারান্দা ছিল অনেক লম্বা। দোতলা এই বাড়িতে ছিল এগারোটি ঘর। বাবা থাকতেন নিচের তলার একেবারে পুবের ঘরটায়, যেখানে পরবর্তী সময়ে মা থাকতেন। বাবা ব্যাগে খুব কমই বাজার করতেন। বাসায় বাজার আসত বড় টুকরিতে। মাছ, মাংস, মিষ্টিকুমড়া, লাউসহ নানা সবজি থাকত তাতে। বাবা বাজার নিয়ে আসার পর মাকে দেখতাম তা গুছিয়ে রান্না তুলে দিচ্ছেন। তিনি এত সুন্দর করে গুছিয়ে রান্না শুরু করতেন মুগ্ধ তাকিয়ে থাকতাম। বড় পরিবার বলে অনেক ভাত রান্না করতে হতো। আমার মায়ের হাতের প্রতিটি পদ অসাধারণ সুস্বাদু হতো। কিন্তু তাঁর রান্নার অনেক বাঙালি পদের মধ্যেও আমার সব থেকে প্রিয় পদ হচ্ছে ছোট আলু দিয়ে গরুর মাংসের ঝোল। এ ছাড়া আরও কয়েকটি খাবার প্রথম দিকে রাখব। এর একটি হলো- নারিকেলের দুধ দিয়ে কই মাছ আর কাঁঠালের বিচি দিয়ে গরুর মাংস রান্না। যার কথা মনে হলে এখনও জিভে পানি চলে আসে। মাকে দেখেছি, জ্যৈষ্ঠ মাসে কাঁঠালের বিচিগুলো অনেক যত্ন করে রেখে দিতেন। কাঁঠালের বিচি পুরোনো হলে স্বাদ বাড়ে তখন তা জানতাম না। তিন নম্বরে হচ্ছে নোনা ইলিশের বড়া। এ পদের কথা না বললেই নয়। নোনা ইলিশ মিষ্টিকুমড়ার পাতা দিয়ে পেঁচিয়ে ভাতের মধ্যে দেওয়া হতো। পরে নানা উপকরণ দিয়ে পরিবেশন করতেন।
আমার মা ছিলেন অতিথিপরায়ণ। ফলে বাড়িতে মেহমান থাকত প্রায়ই। মা সবাইকে নিজ হাতে রেঁধে খাওয়াতেন। চারদিকে সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ত। রান্নার প্রধান শর্ত হলো আন্দাজ আর মনোযোগ। এই আন্দাজ আসে অভিজ্ঞতা থেকে। মায়ের হাতের রান্না খাওয়ার জন্য অপেক্ষার প্রহর যেন শেষ হতে চাইত না। এরপর শুরু হতো খাবার পরিবেশনের পালা। আমরা কখনই টেবিলে বসে খেতাম না। চকিতে গোল হয়ে বসে খেতাম। পরিবারের সদস্য বেশি থাকায় কাচের প্লেট ভেঙে যাওয়ার ভয়ে আম্মা সবাইকে টিনের থালায় খাবার দিতেন। থালায় ছিল নানারকম ফুলের নকশা আঁকা। কে কোন থালায় খাবে, তা নিয়েও চলত নানা বায়না। এ বিষয় নিয়ে ভাইবোনদের মধ্যে মারামারি হতো। আম্মা সবাইকে শান্ত করতেন। এসব স্মৃতি মন পড়লে মনের অজান্তে হেসে ফেলি।
আর বাড়িতে ঈদের সময় মা বিশেষ কয়েকটি পদ রান্না করতেন। আর সেগুলোর জন্য ঈদের অনেক দিন আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতেন। সকালে চালের আটার রুটির সঙ্গে থাকত গরুর মাংস। মা মাংসের যে কোনো পদ ভালো রান্না করতেন। তার জাদুময় হাতে কোরবানির গরুর মাংস তাড়াতাড়ি সিদ্ধ হয়ে যেত। খেতে বেশ সুস্বাদু লাগত। তাঁর হাতে সত্যিই জাদু ছিল। গরুর মাংসের সঙ্গে পায়েস করা হতো। দুধ দিয়ে একপ্রকার ঘন পায়েস রাঁধতেন মা, যা খেয়ে তৃপ্তি পেতাম। ঈদের দিনে মায়ের হাতের বিশেষ কোনো খাবার না খেলে মনে হয় ঈদের খাওয়া যেন পূর্ণ হলো না। ছোটবেলায় ঈদের সময় অনেক মজার ঘটনা ঘটেছে, এত ঘটনা বলে শেষ করা যাবে না। তবে আমার মনের মধ্যে গেঁথে আছে আত্মীয়স্বজন সবাইকে ডেকে মায়ের খাওয়োনোর ব্যাপারটি। আমাদের বাড়িতে ঈদের পরদিন রাতে মা সবাইকে দাওয়াত করে খাওয়াতেন। আত্মীয়স্ব্বজনের পাশাপাশি পরিচিতজনরাও বাদ পড়ত না। মা জীবিত থাকা পর্যন্ত এটা চালু ছিল। মা যখন সবার খাবারের আয়োজন করতেন আমি তাঁর পাশে থাকতাম।
এখন ঈদে কত কত খাবার বাসায় তৈরি হয়। ফেলে আসা সেসব ঈদের রান্না, আমার মায়ের হাতের রান্নার অতুলনীয় স্বাদ আর পাই না। মায়ের মতো আমিও এখন অনেক যত্ন নিয়ে নানা পদের রান্নাবান্না করি। তবে আমার মেয়ে ত্রপা তেমন একটা রান্না করতে পারে না। তবে আমার হাতের অনেক খাবারই তাঁর পছন্দের।
ফেরদৌসী মজুমদারের প্রিয় তাঁর মা উম্মে বারী আফিয়া বেগমের তিন রেসিপি
কাঁঠালের বিচি দিয়ে গরুর মাংস
উপকরণ :গরুর মাংস ১ কেজি, কাঁঠালের বিচি ৩০০ গ্রাম, আদা বাটা ২ টেবিল চামচ, রসুন বাটা ১ টেবিল চামচ, পেঁয়াজ বাটা আধা কাপ, পেঁয়াজ কুচি ১ কাপ, হলুদ গুঁড়া ১ চা চামচ, মরিচ গুঁড়া দেড় চা চামচ, জিরা গুঁড়া ১ চা চামচ, গরম মসলা গুঁড়া ১ চা চামচ, ধনে গুঁড়া ১ চা চামচ। তেজপাতা, এলাচ, দারচিনি, লবঙ্গ ২-৩টি করে। লবণ পরিমাণমতো, তেল আধা কাপ, গরম পানি পরিমাণমতো।
যেভাবে তৈরি করবেন :১. কাঁঠালের বিচির ওপরের খোসা ফেলে পানিতে ভিজিয়ে লাল আবরণ পরিস্কার করে নিন।
২. মাংস ধুয়ে পানি ঝরিয়ে নিন।
৩. হাঁড়িতে তেল দিয়ে গোটা গরম মসলা ফোড়ন দিন। মসলার সুগন্ধ বের হলে তাতে পেঁয়াজ কুচি দিন। পেঁয়াজ নরম হলে গরম মসলা ও জিরার গুঁড়া ছাড়া সব মসলা ও আধা কাপ পানি দিয়ে কষিয়ে নিন।
৪. মসলা কষানো হলে মাংস দিয়ে দিন। মাংস কষিয়ে ২ কাপ গরম পানি দিন। মাংস সিদ্ধ হয়ে এলে কাঁঠালের বিচি দিয়ে কষিয়ে ঝোলের জন্য আন্দাজমতো পানি দিন।
৫. ঝোল মাখা মাখা হয়ে এলে গরম মসলার গুঁড়া আর জিরার গুঁড়া দিয়ে নেড়ে নামিয়ে নিন।
ছোট আলু দিয়ে গরুর মাংস
উপকরণ :গরুর মাংস ১ কেজি, ছোট আলু ৪০০ গ্রাম, আধা কাপ তেল, আদা বাটা ৩ টেবিল চামচ, রসুন বাটা ২ টেবিল চামচ, মরিচ গুঁড়া দেড় চা চামচ, হলুদ গুঁড়া ১ চা চামচ, জিরার গুঁড়া ১ চা চামচ, ভাজা দারচিনি গুঁড়া আধা চামচ, ভাজা এলাচ গুঁড়া আধা চামচ, ভাজা জিরার গুঁড়া আধা চামচ, এক চিমটি হলুদ বা জাফরান গুঁড়া, ৫-৬ পিসি কালো মরিচ, তেজপাতা, এলাচ, দারচিনি, লবঙ্গ ৪-৫টি করে। লবণ পরিমাণমতো, তেল আধা কাপ, গরম পানি পরিমাণমতো।
যেভাবে তৈরি করবেন :১ মাংস ছোট ছোট টুকরো করে কেটে ভালোভাবে ধুয়ে ফেলুন।
২ আলু ধুয়ে একটু লবণ মেশান এবং কয়েক মিনিট মেরিনেট করুন। রঙের জন্য এক চিমটি হলুদ বা জাফরান গুঁড়াও মেশাতে পারেন।
৩. একটি ফ্রাইপ্যানে পরিমাণমতো তেল গরম করুন। তাতে আলুর মেরিনেট ঢেলে দিন। আলু বাদামি হওয়া পর্যন্ত নাড়তে থাকুন। এরপর আলুর অতিরিক্ত তেল মুছে ফেলার জন্য ছেঁকে একপাশে রেখে দিন।
৪. এবার প্যানের মধ্যে আরও একটু তেল দিয়ে তা গরম করুন। তেল গরম হলে পেঁয়াজ কুচি দিন। পেয়াজ বাদামি হওয়া পর্যন্ত নাড়ূন। পেঁয়াজ বাদামি হলে রসুন এবং আদা বাটা দিয়ে নাড়তে থাকুন। এবার জিরা, লাল মরিচ, তেজপাতা, লবঙ্গ, ধনেপাতা এবং সামান্য পানি দিন। মেশানো মসলা থেকে তেল না বের হওয়া পর্যন্ত নাড়তে থাকুন। এবার মাংসের টুকরোগুলো দিয়ে কষান।
৫. মাংস কষানো হলে পরিমাণমতো পানি নিয়ে ঢেকে দিন। ১৫ মিনিটের জন্য জ্বাল দিন। আপনি এই পর্যায়ে অতিরিক্ত পানি যোগ করতে পারেন। মাংস সিদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত রান্না করুন। মাংস প্রায় সিদ্ধ হয়ে গেলে আলু ঢেলে দিন। আবার ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দিন। পাঁচ মিনিট রান্না করুন। পানি শুকিয়ে অর্ধেক হয়ে ভাজা এলাচ ও দারচিনি গুঁড়া ছিটিয়ে দিন। আরও ২ মিনিট নাড়ূন এবং চুলার আঁচ বন্ধ করুন এবং ভাজা জিরা গুঁড়া ছিটিয়ে দিন।
নারকেলের দুধ দিয়ে কই মাছ
উপকরণ :কই মাছ (বড়) ৪টি, নারকেলের দুধ ১ কাপ, সরিষার তেল ৩ টেবিল চামচ, পেঁয়াজ বাটা আড়াই টেবিল চামচ রসুন বাটা ১ চা চামচ, সরিষা বাটা আধা চা চামচ, জিরা গুঁড়া আধা চা চামচ, হলুদ গুঁড়া আধা চা চামচ, মরিচ গুঁড়া ১ চা চামচ, পেঁয়াজ কুচি আধা কাপ, লবণ পরিমাণমতো, কাঁচামরিচ ফালি ৫-৬টি, চিনি হাফ চা চামচ।
যেভাবে তৈরি করবেন :১. মাছ পরিস্কার করে ধুয়ে পানি ঝরিয়ে হলুদ, লবণ মাখিয়ে নিতে হবে।
২. একটি প্যানে গরম তেলে হলুদ লবণ মাখানো মাছ ভাজতে হবে। হালকা ভাজবেন, বেশি ভাজলে কই মাছের তেল নষ্ট হয়ে যায়।
৩. মাছ হালকা ভাজা হয়ে গেলে, তা উঠিয়ে রাখুন। এবার ওই তেলে পেঁয়াজ বাদামি রং করে ভেজে সব বাটা ও গুঁড়া মসলা দিয়ে কষিয়ে নিতে হবে।
৪. কষানো হলে গেলে এবার লবণ ও অল্প নারিকেল দুধ দিয়ে মসলা কষাতে থাকুন। এবার মাছ দিয়ে বাকি নারিকেলের দুধ দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।
৫. ঝোল কমে তেলের ওপর এলে কাঁচামরিচ ও চিনি ৫ মিনিট দমে দিয়ে নামাতে হবে।
নোনা ইলিশের পাতুরি
উপকরণ : নোনা ইলিশের লেজ মাথা ছাড়া মাঝের অংশ আধা কেজি, শর্ষের তেল আধা কাপ, লাউপাতা ১০-১২টি, পেঁয়াজ কুচি ১ কাপ, রসুন কুচি ১ কাপের ৩ ভাগের ১ ভাগ, শুকনা মরিচ ৭-৮টি, কাঁচামরিচের কুচি ২ টেবিল চামচ, টালা জিরার গুঁড়া ২ চা-চামচ, ধনেপাতা ১ কাপের ৩ ভাগের ১ ভাগ ও লবণ পরিমাণমতো।
যেভাবে তৈরি করবেন :১. প্রথমে ইলিশ মাছ পরিস্কার করে প্রচুর পানি দিয়ে ধুতে হবে। শুকনা মরিচ পানিতে ভিজিয়ে রেখে দিতে হবে।
২. নোনা ইলিশের টুকরা একটু পানি দিয়ে দুই মিনিটের মতো সিদ্ধ করে নিন। এরপর পানি ঝরাতে হবে। কাঁটা বেছে ফেলে দিন। অন্যদিকে পানিতে ভেজানো মরিচ পানি ঝরিয়ে অর্ধেক রসুন দিয়ে পেস্ট করে নিন।
৩ এবার ফ্রাই প্যানে অর্ধেক শর্ষের তেল দিয়ে গরম করে নিতে হবে। রসুন কুচি ও অর্ধেক পেঁয়াজ কুচি ছেড়ে দিয়ে ভেজে নিন। এরপর কাঁটা ছাড়ানো মাছের কিমা দিয়ে ভালো করে ভেজে নিন। এ পর্যায়ে একে একে মরিচ ও হলুদ গুঁড়া দিয়ে কষিয়ে নিন। প্রয়োজনে একটু পানি দিতে হবে। লবণ দেওয়ার সময় দেখে নেবেন। আগে থেকেই যেহেতু লবণ দেওয়া থাকে, তাই বাড়তি লবণ দিলে চেখে নেবেন।
৪. মরিচ ও মাছের কাঁচা গন্ধ চলে গেলে বাকি পেঁয়াজ, কাঁচামরিচের কুচি, টালা জিরার গুঁড়া দিয়ে আরেকটু নেড়েচেড়ে নামাতে হবে। অন্যদিকে লাউপাতা ভালো করে ধুয়ে একটু লবণ মাখিয়ে ১০ মিনিট রেখে দিতে হবে। পাতা একটু নরম হয়ে এলে হাত দিয়ে চিপে পানি ঝরাতে হবে।
৫. এবার একটা একটা পাতা ট্রেতে রেখে নোনা ইলিশের কিমা চামচে করে দিয়ে মুড়িয়ে নিন। এভাবে সব হয়ে গেলে চুলায় আবার ফ্রাই প্যান বসিয়ে দিন। বাকি তেল গরম করে নিন। পাতার খিলিগুলো মিশ্রণে ডুবিয়ে তেলে দুই পিঠ ভাজতে হবে কাবাবের মতো।
ত্রপা মজুমদার
আমার মা ফেরদৌসী মজুমদারকে সবাই জানেন একজন খ্যাতনামা অভিনেত্রী হিসেবে। কিন্তু তিনি যে ভালো রাঁধেনও তা অনেকেরই অজানা। অভিনয়ই মায়ের জীবন। মঞ্চ, টিভি নাটকে অভিনয় ও শিক্ষকতা নিয়ে তাঁর ব্যস্ততা। এক সময় এসব নিয়ে যেন দম ফেলারই সুযোগ পেতেন না মা। তখন দেখেছি, যত ব্যস্ততা থাকুক না কেন, নিজ হাতে তিনি রান্না করতে পছন্দ করতেন। তাঁর হাতের রান্না করা সব পদের খাবার আমার কাছে যেন অমৃত। আমি রান্নাবান্না একটু এড়িয়ে চলি। মাঝে মাঝে মায়ের রান্না দেখে নিজেরও মন চায় রান্না করতে। কিন্তু নানা ব্যস্ততায় সে সুযোগ কমই মেলে। মায়ের হাতের তৈরি তিনটি খাবারের জন্য মুখিয়ে থাকি। এর মধ্যে নারকেলের দুধ দিয়ে কই মাছ আমার ভীষণ প্রিয়। মা আমাকে এ পদটি প্রায়ই রান্না করে খাওয়ান। শুনেছি, এ রান্নাটি তিনি তাঁর মায়ের কাছে শিখেছেন। মায়ের হাতে তৈরি এ রান্না খেয়ে অনেকেই তাঁর প্রশংসা করেছেন। মার হাতের মুরগির কাবাবও আমার পছন্দের। আরেকটি খাবারের কথা না বললেই নয়; রাঁধুনি মায়ের স্পেশাল গুড়ের পায়েস, যার স্বাদ ভোলার নয়।
ত্রপার কাছে প্রিয় তাঁর মা ফেরদৌসী মজুমদারের রেসিপি
গুড়ের পায়েস
উপকরণ :পোলাওয়ের চাল আধা কাপ [ভেজানো], দুধ দুই লিটার, খেজুরের গুড় ৪০০ গ্রাম, নারিকেল কোরা ১ কাপ, তেজপাতা ২টি, দারচিনি ২ টুকরো, কিশমিশ ২ টেবিল চামচ, বাদাম কুচি ২ টেবিল চামচ, লবণ খুব সামান্য, পানি পরিমাণমতো।
যেভাবে তৈরি করবেন : ১. দুধ ফুটিয়ে দুই লিটার থেকে ঘন করে আধা লিটার করতে হবে।
২. গুড় এক কাপ পানি দিয়ে ফুটিয়ে ছেঁকে নিতে হবে।
৩. চাল ধুয়ে তিন কাপ পানি দিয়ে তাতে তেজপাতা, দারচিনি, লবণ দিয়ে মৃদু আঁচে ভালো করে সিদ্ধ করে নিতে হবে।
৪. চাল সিদ্ধ হয়ে ঘন হলে তাতে গুড়, নারিকেল ও ঘন দুধ দিয়ে নাড়তে হবে।
৫. কিছুক্ষণ জ্বাল দিয়ে ঘন হলে নামিয়ে ঠান্ডা করে বাদাম ও কিশমিশ দিয়ে দিতে হবে।
মুরগির কাবাব
উপকরণ :মুরগির বুকের মাংস বা ৪০০ গ্রাম [কিউব করে কাটা]। টকদই আধা কাপ। গোলমরিচ-গুঁড়া আধা চা-চামচ। গরম মসলা ১ চা-চামচ। লালমরিচের গুঁড়া আধা চা চামচ। কাবাব মসলা ২ চা-চামচ। আদা-রসুন বাটা ২ চা-চামচ। সয়াসস ১ টেবিল-চামচ। টমেটো সস ২ টেবিল-চামচ। সরিষার তেল ৩ টেবিল-চামচ। লবণ স্বাদমতো। আরও লাগবে, কাঠি বা শিক [কাঠি হলে পানিতে আগে ভিজিয়ে রাখুন]। তেল ৪ টেবিল-চামচ। কয়লা এক টুকরা। সরিষার তেল ২ চা-চামচ।
যেভাবে তৈরি করবেন :১. প্রথমে মাংস কেটে ধুয়ে পানি ঝরিয়ে নিন। একে একে মেরিনেশনের সব উপকরণ দিয়ে, মাংস মাখিয়ে কমপক্ষে এক ঘণ্টা রেখে দিন। চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা কিংবা সারারাত রাখতে পারলে আরও ভালো। সারারাত রাখলে নরমাল ফ্রিজে রেখে দেবেন।
২. এখন শিকগুলো মুছে নিয়ে মাংস গেঁথে নিন। মসলাগুলো রেখে দিন, পরে ব্রাশ করে দেবেন কাবাবের ওপরে।
৩. প্যানে তেল গরম করে মাংসের শিকগুলো বিছিয়ে দিন। মাঝারি থেকে একটু বেশি আঁচে গ্রিল করুন। মসলা ব্রাশ করুন।এক পিঠ হয়ে গেলে, উল্টিয়ে আবার মসলা ব্রাশ করে দিন। দুই পিঠ লাল হয়ে এলে চুলা বন্ধ করে দিন।
৪. অন্য প্যানে সরিষার তেল গরম করে নিন।
৫. একটি ফয়েল পেপারে গরম কয়লা [চুলায় গরম করে নিতে হবে] নিয়ে কাবাবের পাশে রাখুন এবং গরম করা তেল কয়লার ওপর ঢেলে সঙ্গে সঙ্গে ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দিন যেন ধোঁয়া বের হয়ে না যায়। এভাবে পাঁচ মিনিট রেখে দিন। ব্যস, হয়ে গেল মুরগির কাবাব।
গ্রন্থনা ::এমদাদুল হক মিলটন

বিষয় : মায়ের হাতের রান্না

মন্তব্য করুন