'জনপ্রিয়' কবিদের একটি দুর্ভাগ্য এই যে, তাঁদের শ্রেষ্ঠ রচনাগুলো আলোচিত হয় কম, 'জনপ্রিয়' কবিতাগুলোই ঘুরেফিরে আলোচনায় আসে বেশি। সব দেশেই শিল্পোত্তীর্ণ আধুনিক কবিতার পাঠক নিতান্তই কম। কারণ, এগুলোতে যেসব অলংকার ব্যবহূত হয়, তা সবার কাছে সহজবোধ্য নয়।
শামসুর রাহমান যত বেশি বহির্মুখী হয়ে সমাজচিন্তা ও রাজনীতিকে তাঁর কবিতার উপজীব্য করেছেন, তত বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। অথচ প্রবেশলগ্নে তিনি জীবনানন্দ-বুদ্ধদেব বসুদের আধুনিকতায় জারিত হয়ে সমাজভাবনাকে কবিতা থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করেছেন এবং অনেক কবিতায় সেই অন্তর্মুখীনতা বিষয়ে আত্মঘোষণাও ছিল তাঁর : (১) আমার খামার নেই/ নেই কোনো শস্যকণা/ আছে শুধু একটি আকাশ; (২) শুধু দু'টুকরো শুকনো রুটির নিরিবিলি ভোজ/ অথবা প্রখর ধু-ধু পিপাসার আঁজলা-ভরানো পানীয়ের খোঁজ/ শান্ত সোনালি আলপনাময় অপরাহেপ্তর কাছে এসে রোজ/ চাইনি তো আমি .../ শান্ত রূপালি স্বর্গ-শিশিরে স্নান করি আমি। কিন্তু না, 'স্বর্গ-শিশিরে স্নান' করার বাসনায় নক্ষত্রযাত্রী শামসুর রাহমান তাঁর অতিলৌকিক ফিটনে স্বপ্টেম্নর ঘোড়া জুড়তে-না-জুড়তেই তাঁকে টেনে ধরেছিল স্বদেশের মাটি ও মানুষ। সামাজিক অঙ্গীকারের কবিতায় কবির একটা প্রচ্ছন্ন অভীপ্সা থাকে 'আমজনতা'কে আকৃষ্ট করার; তাই, জটিল শিল্প-উপাদানের ব্যবহার প্রায়শ এড়িয়ে যান। কিন্তু মানসম্পন্ন কবিতায় জটিল অলংকারের ব্যবহার অনিবার্য, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। আমার প্রিয় কবিতার তালিকায় শামসুর রাহমান-এর অনেক কবিতাই রয়েছে। প্রতীকী চিত্রকল্পকে আমি কবিতার শ্রেষ্ঠ শিল্প-উপাদান মনে করি বিধায় এ-লেখার জন্য আমি বেছে নিয়েছি তাঁর 'জনৈক সহিসের ছেলে বলছে' শিরোনামের কবিতাটি। শামসুর রাহমান-এর 'বিধ্বস্ত নীলিমা' কাব্যগ্রন্থের অনেক উল্লেখযোগ্য কবিতার অন্যতম এটি।
আলোচ্য কবিতায় প্রতীকী চিত্রকল্প নির্মাণে কবি খণ্ডচিত্রকে যেমন ব্যবহার করেছেন, তেমনি সমগ্র কবিতাকেই একটি সুবিশাল প্রতীকী চিত্রকল্প করে তুলেছেন। এ-কবিতায় আমরা দেখছি এক সহিসের ছেলে তার মৃত্যুপথযাত্রী অসহায় বাবার অবস্থার বর্ণনা দিচ্ছে। তার অসুস্থ বাবা এতটাই নিথর শয্যাশায়ী যেন তিনি বহুদিন ধরে 'আঠা দিয়ে সাঁটা বিছানায়'। বর্তমান তার কাছে মৃত; যৌবনে যেমন তার প্রিয় ঘোড়াটির পিঠে হাত বুলিয়ে দিতেন, তেমনি এখন তিনি অতীতের বিস্তীর্ণ শরীরকে 'ঘোড়ার উজ্জ্বল পিঠ ভেবে' তাতে হাত বুলিয়ে সময় কাটান। পৃথিবী থেকে বিদায়ের মুহূর্তে এই স্মৃতিকাতরতায় মূলত সব মানুষই আক্রান্ত হয়। এ-কবিতায় বর্ণিত ব্যক্তি 'সহিস' বিধায় তার স্মৃতিকাতরতার বিষয়গুলো ছেলের জবানিতে ঘোড়ার অনুষঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে। সমগ্রতার বিবেচনায় এই সহিস মানুষের প্রতীক, মানুষের প্রতিনিধি, আর ঘোড়া জীবনের প্রতীক। জীবন নামের বেয়াড়া ঘোড়াকে বাগে আনতে মানুষের আমরণ সংগ্রামকে প্রতীকায়িত করেছে এই কবিতা। অন্য বিবেচনায় প্রতীক ছাড়াও এখানে আরও একটি শিল্প-উপাদান লুকিয়ে আছে: সেটি সহিসের ঘোড়া সামলানোর সাথে সকল মানুষের জীবন সামলানোর সমান্তরাল রূপক।

খণ্ডচিত্রেও অসাধারণ কয়েকটি প্রতীকের ব্যবহার আমাকে চমকিত করেছে। বর্ণিত সহিস মাঝে মাঝে অদ্ভুত একটি স্বপ্টম্ন দেখেন :

"কে এক কৃষ্ণাঙ্গ ঘোড়া উড়িয়ে কেশর
পেরিয়ে সুদূর আগুন রঙের মাঠ তাঁকে নিতে আসে।"

এই দৃশ্যকল্পে 'আগুন রঙের মাঠ' পেরিয়ে-আসা এক কালো ঘোড়াকে আমরা দেখতে পাই। পটভূমিতে আগুন-রঙের মাঠ ঘোড়ার কালো রংকে আরও বেশি ফুটিয়ে তুলেছে। উদ্ধৃত অংশের শেষ পঙ্‌ক্তি 'তাকে নিতে আসে' উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট হয়ে ওঠে এই কালো ঘোড়া মৃত্যুর প্রতীক। প্রতিতুলনামূলক অলংকারে যখন উপমেয় অনুপস্থিত থাকে এবং উপমান থেকেই উপমেয়কে বুঝে নিতে হয় তখনই জন্ম নেয় প্রতীক নামের কাব্যালংকার। এখানেও ঘটেছে তা-ই। উপমেয় 'মৃত্যু' শব্দটির উল্লেখ নেই কিন্তু উপমান 'কালো ঘোড়া' দিয়েই 'মৃত্যু'কে বুঝে নিতে হয়। প্রতীকী চিত্রকল্পের ব্যবহার কবিতাকে দৃশ্যাতিরেক মর্যাদা দান করে; করেছে এখানেও।

"ঘোড়ার নালের মতো চাঁদ/ঝুলে আছে আকাশের বিশাল কপাটে", "তাঁকে কেন যেন/দুর্বোধ্য গ্রন্থের মতো মনে হয়", ''দিনগুলি হিস্টিরিয়া রোগী", "কখনও মুমূর্ষু পিতা ঘোড়ার উজ্জ্বল পিঠ ভেবে/সস্নেহে বুলোন হাত অতীতের বিস্তৃত শরীরে", "আলোময় মেঘের মতোই একটি শরীর/আমার শরীরে মেশে", "আমাকে নিয়ত/একটু একটু করে স্বপ্টম্ন গিলে ফেলে"- এমন অনেক অভাবনীয় উপমা-উৎপ্রেক্ষা-রূপক ও সমাসোক্তি মিলে 'জনৈক সহিসের ছেলে বলছে' কবিতাটিকে অনবদ্য করে তুলেছে। শিল্পিত কবিতার পাঠক বৃদ্ধি পেলে শামসুর রাহমান নতুন মাত্রায় মূল্যায়িত হবেন।