- ঈদ আনন্দ
- শৈশবের আঁকিবুঁকি
শৈশবের আঁকিবুঁকি
![সেলিনা হোসেন [জন্ম :১৪ জুন, ১৯৪৭]](https://samakal.com/uploads/2022/07/online/photos/Untitled-61-samakal-62c71d4c9b797.jpg)
সেলিনা হোসেন [জন্ম :১৪ জুন, ১৯৪৭]
মানুষ, প্রকৃতি এবং পরিবার- এই আমার অবলম্বন। সেই ছোটবেলা থেকে এরাই আমাকে বেড়ে ওঠার সাহস জুগিয়ে আসছে। এখনও দিয়ে যাচ্ছে স্বপ্নের পথে হেঁটে চলার উস্কানি। এরাই আমাকে খাদ থেকে টেনে এনে লেখালেখির বিস্তীর্ণ আর দিগন্তছোঁয়া হাইওয়েতে তুলে দিয়েছে। তাদের নিয়ে কত স্মৃতি! এই স্মৃতিমেদুরতা অনন্তকাল বয়ে বেড়ালেও ক্লান্তি ভর করবে না মস্তিস্কে। সময়-অসময়ে আজও পেছনে ফিরে তাকাই। স্মৃতিমেদুরতায় ভুগি। খুব মনে পড়ে বাবার কর্মস্থল বগুড়ার কথা। মনে পড়ে আমাদের গণ্ডগ্রামের কথা। নদীপাড়ের ছোট্ট একটা গ্রাম। যেই গ্রামের অবাধ স্বাধীনতা ও উন্মুক্ত প্রকৃতি আজও আয় আয় ডাকে। গ্রামের মাঠ-ঘাট-প্রান্তর, নদী আর গাছ বাওয়া। উঁচু গাছে চড়ে বাবাকে দেখে বকা খাওয়ার ভয়ে লাফ দিয়ে পালিয়ে যাওয়া, ভাইবোন এবং অন্যান্য ছেলেমেয়ের সঙ্গে হল্লা করতে করতে স্কুলে যাওয়াই ছিল আমার রুটিন। আমাদের পাশেই রেশম চাষ হতো। বিশাল তুঁতের বাগান। বাবা ছিলেন সেই রেশম বাগানের বড় কর্তা। রেশমপল্লির ভেতরেই থাকতেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ছিল ডাকবাংলো, রেশম-কীট পোষার ঘর। এই তুঁতের বাগান পার হয়ে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের পাকা সড়ক ধরে পুলিশ লাইনের ভেতর দিয়ে স্কুলে যেতাম। স্কুল থেকে ফেরার পথে টিলায় উঠে পুলিশের বন্দুকের গুলি থেকে বেরিয়ে আসা সিসা কুড়িয়ে হানিফের দোকানে নিয়ে যেতাম। হানিফ মিয়া তা রেখে মুড়িমুড়কি দিতেন। কখনও ছোট ছোট রঙিন লজেন্স দিতেন। মনের আনন্দে তা চিবুতে চিবুতে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের পাকা সড়ক ধরে বাড়ি ফেরার পথ ধরতাম। বাড়ির কাছাকাছি এসে কে আগে ঘরে পৌঁছাবে তা নিয়েও ভাইবোনদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হতো। স্কুল থেকে ফিরেই বইখাতা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পেট পুরে খেয়ে ছুট দিতাম মাঠে। মাঠজুড়ে পড়ে থাকত রাজ্যের খেলা। গোল্লাছুট, দাঁড়িয়াবান্ধা, ছি-বুড়ি ছাড়াও নিজেরা রাজ্যের খেলা বানিয়ে বানিয়ে খেলতাম। সন্ধ্যা নামলেই ঘরে ফিরে হারিকেনের আলোকে আপন পাঠে মন দিতাম। যখন যা-ই করতাম তাতে বাবার চোখরাঙানি তেমন না থাকলেও বাবা ছিলেন পড়াশোনার দিক থেকে কঠোর। বড্ড রাগী ছিলেন। তাই বাবাকে ভাইবোনরা ভয় পেতাম। তবে বাবা পুরোই বদলে যান চার-পাঁচ বছর বয়সী ছোট বোন লাকির মৃত্যুর পর। লাকির নেফ্রাইটিস অসুখ হয়েছিল। সে সময়ে ভালো চিকিৎসা না থাকায় লাকির নানারকম চিকিৎসা চলতে লাগল। এক কবিরাজ লাকিকে রাতে ধানের ওপর বসে থাকা শিশির খাওয়াতে বললেন। ছোট বোনকে সুস্থ করে তুলতে ধানক্ষেতে গিয়ে শিশির ঝরিয়ে বাটি ভরে নিয়ে আসতাম। দিনের পর দিন। কিন্তু বাঁচানো গেল না তাকে। কন্যা হারানোর পর বাবা একেবারে বদলে যান। সেদিন থেকে তিনি আর তাঁর কোনো ছেলেমেয়ের গায়ে হাত তোলেননি। বাবার অবাধ স্বাধীনতা ছিল সন্তানদের জন্য। শুধু বাবা নয়, আমার মাও ছিলেন অসাধারণ গুণের অধিকারী। বাবার মতো করে মাও চাইতেন- মেয়েরা লেখাপড়া শিখবে। বড় হবে।
সেই ছোটবেলায় টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে স্থানীয় পত্রিকায় লেখা পাঠাতাম। লেখা ছাপা হলে মা দুই টাকা হাতে দিয়ে বলতেন-
'থাক, টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে আর খাম কিনতে হবে না, এই নাও খামের টাকা।'
শুধু মায়ের কাছ থেকেই নয়, যখন যেখানে গিয়েছি সেখানেই এই সহযোগিতাটা পেয়েছি। এটাই আমার এক জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া। আর মানুষ এবং প্রকৃতি তো আছেই। এই তিন সখাই আমাকে লেখালেখির কিউপিড হয়ে ভালোবাসা বিলিয়ে যাচ্ছে। যে ভালোবাসা পুঁজি করে বাকিটা পথ হেঁটে যেতে চাই লেখালেখির উন্মুক্ত হাইওয়েতে!
তবে আমি লেখক হওয়ার জন্য এত-এত লেখাপড়া করে লিখতে শুরু করেছি- বিষয়টা তেমন না। বরং বলতে পারি আমার একটা অসাধারণ শৈশব-কৈশোর কেটেছে করতোয়া নদীর পাড়ে। চাকরি সূত্রে আমরা তখন বগুড়ায় থাকতাম। সেখানে অসাধারণ প্রকৃতির সান্নিধ্য পেয়েছি; নদী, মাঠ, গাছ, আম পাড়া, জাম পাড়া ইত্যাদি। আমরা মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কগুলো দেখেছি। তাদের অনেক কথা, ঘটনা, নীতি, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অনেক স্মৃতি আমার মধ্যে সঞ্চিত ছিল। সেই স্মৃতি থেকেই এক সময় লেখার তাড়না অনুভব করতে শুরু করলাম। শুরু করলাম লেখা।
অসংখ্য কবিতা লিখে লিখে ডায়েরিটা বিছানার নিচে লুকিয়ে রাখতাম। কাউকে দেখাতাম না। পরে ১৯৬৫ সালে আমি যখন রাজশাহী মহিলা কলেজে ইন্টারমিডিয়েট দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি তখন বিভাগীয় কমিশনার পুরো বিভাগের সব কলেজের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে একটা গল্প লেখা প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিলেন। সেখানে আমি অংশ নিই এবং আমার লেখা গল্পটা প্রথম হয়। এরপর যখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম তখন থেকে আমি পুরো মাত্রায় লেখক হয়ে উঠলাম এবং লিখতে গিয়ে দেখলাম আমার যে শৈশব-কৈশোরের স্মৃতির সঞ্চয়; কবিতাতে তার যথাযথ প্রকাশ ঘটাতে পারব না। আমার গদ্য দরকার। ক্যানভাসটা একটু বড় দরকার। তাই কবিতা থেকে গল্প লেখা শুরু করি। পরবর্তী সময়ে পরিসর আরও বড় করে উপন্যাসে চলে যাই।
আমার ছোটবেলার নদী করতোয়া। আমার তরুণ বয়সের নদী পদ্মা। রাজশাহীতে। শৈশব কেটেছিল বগুড়ায়। করতোয়ার যে বিশালতা দেখেছি, সেই করতোয়া এখন এতটুকু! দীর্ঘদিন পর মহাস্থানগড়ের সামনে গিয়ে যখন দাঁড়ালাম, আমার চোখে পানি এসে গেছে। এই করতোয়া তো আমার শৈশবের করতোয়া না!
আমার ছোটবেলায় করতোয়া নদীর খেয়াঘাটে বাড়ূয়া মাঝিকে যেভাবে দেখেছি; আমরা যে বলতাম-
কাকু, আমাদের পার করে দেন তো।
তখন তিনি বড়দের বাদ দিয়ে আমাদের পার করে দিতেন। তখন বড়রা তাঁকে বকাবকি করত-
হ্যাঁ, ওরা তোকে পয়সা দেবে না। তবু ওদেরকেই আগে পার করবি।
তখন কাকু বলতেন-
ওরা তো আমার ভবিষ্যৎ। ওদের জন্য তো করবই। ওদেরকে আমি গাছ চেনাব, ফুল চেনাব, মাটি চেনাব।
তখন তো এসব ভাবিনি, এখন দেখি তিনি তো একজন শিক্ষকের মতো কাজ করেছেন। তিনি তো মহান একজন শিক্ষক। একবার তাঁদের বাড়িতে আগুন লাগলে আমরা গিয়ে দেখি, তাঁর ছোটখাটো বউটি আগুন লাগা ঘরের এক কোণ থেকে চালের একটা বস্তা টেনে বের করছেন। আমরা যে নারীশক্তির কথা বলি, নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলি, এটাই সেটা। তিনি সাহস করে আগুনের মধ্য থেকে চালের বস্তাটা নিয়ে চলে এসেছেন।
শৈশবের কত কিছুই ছিল অন্যরকম! একেক ঋতুতে একেক রকম আনন্দ। সেই সময়ের বর্ষা ছিল মধুর বর্ষা। টানা কয়েক দিনের মুষলধারে বৃষ্টিতে পুকুর, খাল-বিল, নদী ভরে যেত। উঠোনে চলে আসত বর্ষার জল। আমরা আষাঢ়ের বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে খেলতাম, জমে থাকা নতুন পানিতে দৌড়াদৌড়ি করেছি। বৃষ্টির সময় বড় মানকচুর পাতা মাথায় দিয়ে চলাফেলার যে শৈশব, তা এতটা ভিন্ন আমেজের যে ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। অনুভবে তীক্ষষ্ট হয়ে আছে সেই বর্ষা। এখনও সেই স্বাদ পাওয়ার জন্য মাঝেমধ্যে গ্রামে যাই। আমার শৈশবের বরগুনার বামনায় গিয়ে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে শৈশব অনুভবের চেষ্টা করি। আসলে শৈশবের সেই বর্ষাই আমার দিগন্ত বিস্তৃত করে দিয়েছে। আমার লেখার, আমার স্বপ্নের ক্ষেত্র তৈরি করেছে। জীবনে শৈশব এক অতুলনীয় পর্ব। সে পর্বেই নির্মিত হতে থাকে মানুষের ভবিষ্যতের চেতনার অনেকখানি।
আমি বিশ্বাস করি, একজন সৃজনশীল মানুষ বেঁচে থাকে তার কাজের মাধ্যমে। আর সেই কাজ হতে হয় সময়ের চেয়ে কমপক্ষে ৫০ বছর এগিয়ে। সৃজনশীল মানুষ সমাজের অন্য আট-দশজনের মতোই বেড়ে ওঠে। সবার সঙ্গে একই কাতারে চলে। কিন্তু ভাবনার জায়গায় সে আশপাশের সবার চেয়ে এগিয়ে থাকে। এই ক্ষেত্রে ইতিহাস এবং কালচারালি যেসব দেশ এবং জাতি এগিয়ে তাদের সঙ্গে মিশতে পারলে এবং সরাসরি সেসব দেখে নিজের আয়ত্তে নিতে পারলে চিন্তার জগৎ আরও প্রশস্ত হবে। যদিও আধুনিক প্রযুক্তি আমাদের বিশ্বগ্রামের বাসিন্দা বানিয়ে দিয়েছে। তবু প্রত্যক্ষ দেখার স্বাদ মেটাতে পারবে না প্রযুক্তি ও আধুনিকতা। ইরানের কালচার, সংস্কৃতির সঙ্গে দীর্ঘ দিনের পরিচয়। এখনও আব্বাস কিরোয়াস্তামি, মাজিদ মাজদির মতো পরিচালকদের ভাবনায় পড়ে থাকি। তাঁদের ভাবনা এবং ক্যামেরার কারুকুরি আমার মতো হাজারো তরুণকে মুগ্ধ করে। নতুন করে ভাবনার তাগিদ দেয়। আশপাশটা দেখায় নতুন করে। অথচ আমরা একই পথে চলি। তবু তাঁদের ভাবনা আমাদের নতুন চোখ খুলে দেয়। আশা করি এর মাধ্যমে আমি আমার ভাবনার জগতে নতুন উস্কানি খুঁজে পাব। আরও অসংখ্য চোখ খুলে যাবে আমার ভাবনার। ডালপালা গজাবে মানবিক ও কল্পনার সবুজ গাছের!
সেই ছোটবেলায় টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে স্থানীয় পত্রিকায় লেখা পাঠাতাম। লেখা ছাপা হলে মা দুই টাকা হাতে দিয়ে বলতেন-
'থাক, টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে আর খাম কিনতে হবে না, এই নাও খামের টাকা।'
শুধু মায়ের কাছ থেকেই নয়, যখন যেখানে গিয়েছি সেখানেই এই সহযোগিতাটা পেয়েছি। এটাই আমার এক জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া। আর মানুষ এবং প্রকৃতি তো আছেই। এই তিন সখাই আমাকে লেখালেখির কিউপিড হয়ে ভালোবাসা বিলিয়ে যাচ্ছে। যে ভালোবাসা পুঁজি করে বাকিটা পথ হেঁটে যেতে চাই লেখালেখির উন্মুক্ত হাইওয়েতে!
তবে আমি লেখক হওয়ার জন্য এত-এত লেখাপড়া করে লিখতে শুরু করেছি- বিষয়টা তেমন না। বরং বলতে পারি আমার একটা অসাধারণ শৈশব-কৈশোর কেটেছে করতোয়া নদীর পাড়ে। চাকরি সূত্রে আমরা তখন বগুড়ায় থাকতাম। সেখানে অসাধারণ প্রকৃতির সান্নিধ্য পেয়েছি; নদী, মাঠ, গাছ, আম পাড়া, জাম পাড়া ইত্যাদি। আমরা মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কগুলো দেখেছি। তাদের অনেক কথা, ঘটনা, নীতি, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অনেক স্মৃতি আমার মধ্যে সঞ্চিত ছিল। সেই স্মৃতি থেকেই এক সময় লেখার তাড়না অনুভব করতে শুরু করলাম। শুরু করলাম লেখা।
অসংখ্য কবিতা লিখে লিখে ডায়েরিটা বিছানার নিচে লুকিয়ে রাখতাম। কাউকে দেখাতাম না। পরে ১৯৬৫ সালে আমি যখন রাজশাহী মহিলা কলেজে ইন্টারমিডিয়েট দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি তখন বিভাগীয় কমিশনার পুরো বিভাগের সব কলেজের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে একটা গল্প লেখা প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিলেন। সেখানে আমি অংশ নিই এবং আমার লেখা গল্পটা প্রথম হয়। এরপর যখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম তখন থেকে আমি পুরো মাত্রায় লেখক হয়ে উঠলাম এবং লিখতে গিয়ে দেখলাম আমার যে শৈশব-কৈশোরের স্মৃতির সঞ্চয়; কবিতাতে তার যথাযথ প্রকাশ ঘটাতে পারব না। আমার গদ্য দরকার। ক্যানভাসটা একটু বড় দরকার। তাই কবিতা থেকে গল্প লেখা শুরু করি। পরবর্তী সময়ে পরিসর আরও বড় করে উপন্যাসে চলে যাই।
আমার ছোটবেলার নদী করতোয়া। আমার তরুণ বয়সের নদী পদ্মা। রাজশাহীতে। শৈশব কেটেছিল বগুড়ায়। করতোয়ার যে বিশালতা দেখেছি, সেই করতোয়া এখন এতটুকু! দীর্ঘদিন পর মহাস্থানগড়ের সামনে গিয়ে যখন দাঁড়ালাম, আমার চোখে পানি এসে গেছে। এই করতোয়া তো আমার শৈশবের করতোয়া না!
আমার ছোটবেলায় করতোয়া নদীর খেয়াঘাটে বাড়ূয়া মাঝিকে যেভাবে দেখেছি; আমরা যে বলতাম-
কাকু, আমাদের পার করে দেন তো।
তখন তিনি বড়দের বাদ দিয়ে আমাদের পার করে দিতেন। তখন বড়রা তাঁকে বকাবকি করত-
হ্যাঁ, ওরা তোকে পয়সা দেবে না। তবু ওদেরকেই আগে পার করবি।
তখন কাকু বলতেন-
ওরা তো আমার ভবিষ্যৎ। ওদের জন্য তো করবই। ওদেরকে আমি গাছ চেনাব, ফুল চেনাব, মাটি চেনাব।
তখন তো এসব ভাবিনি, এখন দেখি তিনি তো একজন শিক্ষকের মতো কাজ করেছেন। তিনি তো মহান একজন শিক্ষক। একবার তাঁদের বাড়িতে আগুন লাগলে আমরা গিয়ে দেখি, তাঁর ছোটখাটো বউটি আগুন লাগা ঘরের এক কোণ থেকে চালের একটা বস্তা টেনে বের করছেন। আমরা যে নারীশক্তির কথা বলি, নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলি, এটাই সেটা। তিনি সাহস করে আগুনের মধ্য থেকে চালের বস্তাটা নিয়ে চলে এসেছেন।
শৈশবের কত কিছুই ছিল অন্যরকম! একেক ঋতুতে একেক রকম আনন্দ। সেই সময়ের বর্ষা ছিল মধুর বর্ষা। টানা কয়েক দিনের মুষলধারে বৃষ্টিতে পুকুর, খাল-বিল, নদী ভরে যেত। উঠোনে চলে আসত বর্ষার জল। আমরা আষাঢ়ের বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে খেলতাম, জমে থাকা নতুন পানিতে দৌড়াদৌড়ি করেছি। বৃষ্টির সময় বড় মানকচুর পাতা মাথায় দিয়ে চলাফেলার যে শৈশব, তা এতটা ভিন্ন আমেজের যে ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। অনুভবে তীক্ষষ্ট হয়ে আছে সেই বর্ষা। এখনও সেই স্বাদ পাওয়ার জন্য মাঝেমধ্যে গ্রামে যাই। আমার শৈশবের বরগুনার বামনায় গিয়ে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে শৈশব অনুভবের চেষ্টা করি। আসলে শৈশবের সেই বর্ষাই আমার দিগন্ত বিস্তৃত করে দিয়েছে। আমার লেখার, আমার স্বপ্নের ক্ষেত্র তৈরি করেছে। জীবনে শৈশব এক অতুলনীয় পর্ব। সে পর্বেই নির্মিত হতে থাকে মানুষের ভবিষ্যতের চেতনার অনেকখানি।
আমি বিশ্বাস করি, একজন সৃজনশীল মানুষ বেঁচে থাকে তার কাজের মাধ্যমে। আর সেই কাজ হতে হয় সময়ের চেয়ে কমপক্ষে ৫০ বছর এগিয়ে। সৃজনশীল মানুষ সমাজের অন্য আট-দশজনের মতোই বেড়ে ওঠে। সবার সঙ্গে একই কাতারে চলে। কিন্তু ভাবনার জায়গায় সে আশপাশের সবার চেয়ে এগিয়ে থাকে। এই ক্ষেত্রে ইতিহাস এবং কালচারালি যেসব দেশ এবং জাতি এগিয়ে তাদের সঙ্গে মিশতে পারলে এবং সরাসরি সেসব দেখে নিজের আয়ত্তে নিতে পারলে চিন্তার জগৎ আরও প্রশস্ত হবে। যদিও আধুনিক প্রযুক্তি আমাদের বিশ্বগ্রামের বাসিন্দা বানিয়ে দিয়েছে। তবু প্রত্যক্ষ দেখার স্বাদ মেটাতে পারবে না প্রযুক্তি ও আধুনিকতা। ইরানের কালচার, সংস্কৃতির সঙ্গে দীর্ঘ দিনের পরিচয়। এখনও আব্বাস কিরোয়াস্তামি, মাজিদ মাজদির মতো পরিচালকদের ভাবনায় পড়ে থাকি। তাঁদের ভাবনা এবং ক্যামেরার কারুকুরি আমার মতো হাজারো তরুণকে মুগ্ধ করে। নতুন করে ভাবনার তাগিদ দেয়। আশপাশটা দেখায় নতুন করে। অথচ আমরা একই পথে চলি। তবু তাঁদের ভাবনা আমাদের নতুন চোখ খুলে দেয়। আশা করি এর মাধ্যমে আমি আমার ভাবনার জগতে নতুন উস্কানি খুঁজে পাব। আরও অসংখ্য চোখ খুলে যাবে আমার ভাবনার। ডালপালা গজাবে মানবিক ও কল্পনার সবুজ গাছের!
মন্তব্য করুন