- ঈদ আনন্দ
- শিশুর জন্য নিরাপদ পৃথিবীর প্রত্যাশা তবু থাকবে
আয়াত হত্যাকাণ্ড
শিশুর জন্য নিরাপদ পৃথিবীর প্রত্যাশা তবু থাকবে

মাঝেমধ্যে টেলিভিশনের পর্দা ও পত্রিকার পাতায় এমন খবর আসে, যা শুধু ভয়াবহ, নিষ্ঠুর ও পাশবিকতাই প্রকাশ করে না; সমাজে কারও কারও চোখে নারী ও শিশুর অনিরাপদ অবস্থাও দেখিয়ে দেয় আমাদের। চট্টগ্রামে শিশু আয়াতের সঙ্গে যা ঘটেছে, তা এমন ঘটনারই অংশ। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানতে পেরেছি, ১৫ নভেম্বর বিকেলে শিশু আয়াত বাসার পাশে একটি মক্তবে পড়তে গিয়েছিল। পরে পরিবার জানতে পারে, শিশুটি মক্তবে যায়নি। উৎকণ্ঠায় থাকা পরিবার ১০ দিন পর জানতে পারে, তাদের আদরের সন্তান খুন হয়েছে পরিচিতজন আবীর মিয়ার হাতে। শিশু আয়াত তাকে ডাকত চাচ্চু বলে। আয়াতকে হত্যার ঘটনায় আবীরকে আটক করেছে পুলিশ। পুলিশকে আবীর জানিয়েছে, আয়াতকে অপহরণ করা হয়েছিল মুক্তিপণের জন্য। ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে ছয় টুকরা করে সাগরে ভাসিয়ে দেওয়া হয় মরদেহ।
শিশু আয়াতের ঘটনা কয়েকটি প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। আমাদের দেশে যে কোনো ঘটনার প্রথম অভিঘাত আসে নারীদের প্রতি। সেটি সামাজিক বা আর্থিক, এমনকি প্রাকৃতিক কারণেও। এর পরে সহজ লক্ষ্য শিশুরা। সমাজে নারী ও শিশুরা যেমন বঞ্চিত, তেমনিভাবে আরও বেশি অসহায় ও অবহেলিত। কারণ শিশুরা নিজেদের ওপর নির্যাতনের যথাযথ প্রতিবাদ করতে পারে না। শিশুদের বানানো হয় মুক্তিপণের টোপ। চট্টগ্রামের শিশু আয়াতের ঘটনা এর সাম্প্রতিক উদাহরণ। আমি মনে করি, সমাজে শিশুর প্রতি এই দৃষ্টিভঙ্গি নিতান্তই অল্পসংখ্যক মানুষের মধ্যে আছে। পৃথিবীর ফুল হচ্ছে শিশুরা। তাদের প্রতি আঘাত করার ক্ষেত্রে তাই কোনো সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষকে আমরা কল্পনা করতে পারি না। অল্পসংখ্যক মানুষের জন্য সমাজকে প্রশ্নবিদ্ধ করার পক্ষে আমি নই। চট্টগ্রামে আয়াতের ঘটনায় যাকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে, সেই আবীরকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে বিচার নিশ্চিত করতে হবে। একজন আবীরের জন্য সেই সমাজের অন্যদের প্রশ্নবিদ্ধ করে সমাজ বদলানো যাবে না। আবীরের শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে তবেই সমাজে এই ঘটনার বিষয়ে একটি বার্তা যাবে।
নারীর প্রতি সহিংস ঘটনা ছাড়াও আমাদের নারীরা যৌতুক, স্বামী কর্তৃক নির্যাতন, উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়া, কর্মস্থলে বৈষম্য ও প্রতারণামূলক বিয়ের শিকার হয়ে থাকেন। এসব অপরাধের বিরুদ্ধে শক্তিশালী আইন থাকলেও এর সুফল তাঁরা পাচ্ছেন না। ফলে বিচারহীনতার কারণে তাঁদের বিরুদ্ধে এসব অপরাধ প্রতিনিয়ত তীব্রতর হচ্ছে। দেখা যায়, নারীর সঙ্গে সংঘটিত এসব ঘটনায় নারীর পাশাপাশি শিশুরাও অসহায় পরিস্থিতির শিকার হয়ে থাকে। একাত্তরে যেমন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি ভাষণে গোটা জাতি মহান মুক্তিযুদ্ধের বার্তা পেয়ে গিয়েছিল; তেমনিভাবে শিশুদের নিরাপত্তা ও অধিকার বাস্তবায়নে নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের বার্তা সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। নারী ও শিশুদের প্রতি নির্যাতন, সহিংসতা ও বৈষম্যের কথা তুলে ধরার পাশাপাশি বিচারহীনতার সংস্কৃতির বিরুদ্ধেও কথা বলতে হবে।
আমাদের সমাজে হতাশাজনক একটি বাস্তবতা- বিচার পেতে বিলম্ব। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন অনুযায়ী একটি মামলা ১৮০ দিনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও দেখা যায়, শিশু অপহরণ মামলা ১৪ বছরেও শেষ হয়নি। এর কারণ আইনের শাসন ও জবাবদিহির অভাব। আইন প্রণীত হলেও যথাযথ প্রশাসনিক উদ্যোগ ও সচেতনতার অভাবে এটি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। আইন যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হলেই নারী ও শিশুর বিরুদ্ধে সহিংসতা, নির্যাতন ও বৈষম্য দূর হবে। শিশুদের নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, জনগণ না নড়লে উন্নয়ন হয় না। শিশুদের যৌন নির্যাতন নিয়ে কাজ করতে গেলেও বাধা আসে। আমাদের সীমাবদ্ধতার মধ্যেও অনেক অর্জন রয়েছে। সমন্বয় বিষয়েও কিছু ঘাটতি রয়ে গেছে। সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে শিশুদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হলে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা সহজ হবে। শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠায় সরকারের নানা অর্জন রয়েছে সত্যি, কিন্তু বাজেটসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে শিশুদের বিষয়ে আরও গভীরভাবে ভাবতে হবে। শিশুদের ওপর সহিংসতার যে চিত্র উঠে এসেছে, সেটি সত্যিই উদ্বেগজনক। আবার দেখা যায়, শিশুদের নানা উন্নতি ও অগ্রগতি থামিয়ে দেয় বাল্যবিয়ে। এ বিষয়ে সরকারের আরও জোরালো ভূমিকা চাই। বাল্যবিয়ের শিকার মেয়েরা দ্রুতই নানামুখী চাপের শিকার হয়। এটি তার জীবনটাও এলোমেলো করে দিতে পারে। উপকূলীয় ও উত্তরবঙ্গে এ ধরনের বহু ঘটনা রয়েছে। এখনই সময় বাল্যবিয়ে বন্ধে ফলপ্রসূ উদ্যোগ গ্রহণের। আবার শিশুশ্রম বন্ধেও উদ্যোগ নিতে হবে। তাদের ওপর চলমান সহিংসতা বন্ধে নীতিমালায় সংশোধন এনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। উপকূল, হাওর, পার্বত্য এলাকার শিশুদের উন্নয়নে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। অনেক শিশু জন্মের পর থেকেই মা-বাবার স্নেহবঞ্চিত। শিশুর সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য একটি পরিবার এবং মা-বাবা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরিবারহীন শিশুদের বিকল্প উপায়ে মায়ের স্নেহে বড় করে তুলতে হয়। সব শিশুর নিরাপদ শৈশব নিশ্চিত করতে আরও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আমাদের যে এসডিজি-টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, তা পূরণে মনিটরিংয়ের মাধ্যমে শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করা সম্ভব। ছোট ছোট লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে সহিংসতা শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে।
সহিংসতার পর প্রতিটি ঘটনা আলাদা করে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। অপরাধের কারণ ও ধরন অনুসন্ধান করে ব্যাখ্যা-বিশ্নেষণ করতে হবে। সহিংসতায় যারা জড়িত, তাদের বিচার নিশ্চিত করার পাশাপাশি মানসিক অবস্থা নিয়েও কাজ করতে হবে। কীসের পরিপ্রেক্ষিতে এমন সহিংস ঘটনা তারা ঘটায়, এর মনোবৈজ্ঞানিক বিশ্নেষণ করে সঠিক সমস্যা চিহ্নিত করতে হবে। একটি শিশুর শৈশব আনন্দময় করে গড়ে তুলতে পারলে তার মধ্যে অপরাধপ্রবণতা কমে আসে। তাই প্রত্যেক শিশুর শৈশব নিরাপদ, আনন্দমুখর করে গড়ে তুলতে ব্যবস্থা নিতে হবে।
শুধু বিচার করে দীর্ঘমেয়াদি সুফল পাওয়া যাবে না। স্থায়ী সুফল পেতে হলে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি প্রতিটি ঘটনার একটি মনোবিশ্নেষণমূলক উত্তর খোঁজা জরুরি।
সেলিনা হোসেন: কথাসাহিত্যিক
মন্তব্য করুন