শেষ পাতা
পারি না ফিরিতে দুয়ারে দুয়ারে

আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল [১ জানুয়ারি ১৯৫৬-২২ জানুয়ারি ২০১৯]
ধ্রুব এষ
প্রকাশ: ১৯ জানুয়ারি ২০২৩ | ১৮:০০
গাছ দেখি। বাঁচি।
কিছু মানুষ গাছ পৃথিবীর।
না হলে হতো না।
উত্তরের হাওয়া দক্ষিণের হাওয়া, পূর্বের পশ্চিমের, ঈশান নৈঋত বায়ু অগ্নিকোণের হাওয়ার শিস অবগত থাকেন সেইসব মানুষ বা গাছেরা।
মানুষ মরে, গাছ মরে না।
আমি কিছু গাছ দেখেছি, কিছু গাছের সঙ্গে দেখা হয়।
এত কথা বললাম কেবল একজন মানুষের কথা বলতে গিয়ে। তিনি আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। গানের মানুষ যেমন, তেমন বলি গাছের মানুষও। গাছ মানুষ- যে কিছু গাছ মানুষ পৃথিবীর। আমি এক সন্ধ্যায় এই গাছের চরণধূলি নিতে গিয়েছিলাম। অনুজপ্রতিম তানভীরের সঙ্গে। তানভীর লেখালেখি করে, ধর্মপ্রাণ ছেলে। সিলছাপ্পড় মেরে দেওয়া সহজ- এই ছেলে উগ্রবাদী। সেই চেষ্টা ছিল। কাজ হয়নি। আর আমি একদিন জানতে পারি তানভীরের চাচা হলেন মহান সুরস্রষ্টা, গীতিকবি আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। আর কী বলব? আমরা যে কোনদিকে যাচ্ছি? আফসোস! যাক এসব। স্মরণ করি আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল : এক গাছকে। কী সব গান এই মানুষটার বানানো! আমার সারা দেহ খেও গো মাটি ... উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম সব ঘুরে এক ব্রহ্মচারী ..., আমার গরুর গাড়িতে বউ সাজিয়ে ... চিরকালের গান হয়ে গেছে আমাদের। তানভীরের সঙ্গে আমি তাঁর গানের স্টুডিওতে গিয়েছিলাম। ব্যস্ত, গান রেকর্ড করছিলেন। মধ্যবয়স্কা দু'জন মানুষকে যেভাবে গান তুলে দিচ্ছিলেন আমি এক বিরাট শিশুকে দেখছিলাম। বিরাট শিশু গাছ। আহারে!
রেকর্ডিংয়ের পর আমার সিরিয়াল। বিরাট শিশু গাছ না হলে এত মায়া থাকে নাকি মানুষের কলবে! আমি তাঁকে প্রণাম করলাম, তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে তাঁর চেয়ারে বসিয়ে দিলেন, অরিস সিগারেট খেতে দিলেন। সে এক আশ্চর্য সন্ধ্যা।
সব মনে আছে, সব কথা। বিরাট শিশু গাছের সব জেশ্চার। ওয়েবের মতো। বিশ্বসংগীতের ইতিহাস নিয়ে একটা বইয়ের কাজ করছেন তিনি। ইংরেজি বই। পেঙ্গুইন হয়তো ছাপবে। কিছু ড্রয়িং থাকবে বইতে। আমি যদি করি।
'আমার ড্রয়িং ভালো না বুলবুল ভাই।'
'আমার ভালো ড্রয়িংয়ের দরকার নেই ধ্রুব। তোমার প্রাণ দরকার। তুমি আঁকলে যে বাউল হবে সে আমার দেশের বাউল। তার মুখ চোখ নাই থাকল, হয়তো ... হয়তো সে অস্পষ্টই থাকল।'
অস্পষ্ট দেখাও দেখা। তীব্র দেখাই। মর্মে পশে কেবল মহাজনের তা।
'আমার সারা দেহ খেও গো মাটি ..., গানটা যখন লিখেন তখন আপনার বয়স কত বুলবুল ভাই?'
'উনিশ। সুরও ওই বছরই করেছিলাম।'
উনিশ (আঠার) বছর বয়স কী দুঃসহ!
পরে তাঁর বই নিয়ে কথা বলতে আরেকদিন তানভীর, কামরুল হাসান মিথুন আর আমি আবার গিয়েছিলাম তাঁর স্টুডিওতে। বইয়ের কাজ করছেন তিনি। লেখা দ্রুত শেষ করে ফেলবেন। তানভীর আমার কাছে পাণ্ডুলিপি পৌঁছে দেবে। আচ্ছা, মিথুন আপনার দুই-একটা পোর্ট্রেট তুলবে বুলবুল ভাই।
ওরে! এই প্রস্তাবে সে কী কাঁচুমাচু মানুষটা! লজ্জায় শেষ বুঝি। ছবি তুলতে ছাদে যাবেন না- রাজনৈতিক অনিরাপত্তাজনিত কারণও ছিল। মিথুন বারান্দায় কয়েকটা ছবি তুলল তাঁর। সিলুয়েট ধরনের সেই ছবি আমার কাছে আছে। ব্যক্তিগত। প্রকাশ করব না। কিছুই প্রকাশ করতে চাই না। কেবল বলি আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের চোখ মাটি খায়নি। গাছেদের চোখ মাটি খায় না। বিরাট শিশু গাছ সব দেখছেন। দেখছেন :
উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম সব ঘুরে এক ব্রহ্মচারী
থমকে দাঁড়াল
চমকে তাকাল
দেখল অনেক দূরে একটা গ্রাম দেখা যায় ...।
মানুষটা আছেন, গান করছেন, একটার পর একটা অরিস সিগারেট টানছেন- আমি আবার চরণধূলি নিতে যাব তাঁর। কবে জানি না। তবে তানভীর সেদিন আমার সঙ্গে থাকবে না। আর কেউ থাকবে না।
পুনশ্চ : মহাপ্রাণ আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল লোকান্তরিত হয়েছেন ২২ জানুয়ারি ২০১৯। চার বছর হয়ে গেছে। তাঁর জন্য এখন পর্যন্ত কোথাও কোনো শোকসভা হয়নি। ধিক! তবে এ আনন্দের কথা, লজ্জার কথা না। একজন শিশু গাছের জন্য শোক করবে কিছু মানুষের ডামি? কোনো দরকার নাই। কোনোই দরকার নাই।
১১.০১.২৩
কিছু মানুষ গাছ পৃথিবীর।
না হলে হতো না।
উত্তরের হাওয়া দক্ষিণের হাওয়া, পূর্বের পশ্চিমের, ঈশান নৈঋত বায়ু অগ্নিকোণের হাওয়ার শিস অবগত থাকেন সেইসব মানুষ বা গাছেরা।
মানুষ মরে, গাছ মরে না।
আমি কিছু গাছ দেখেছি, কিছু গাছের সঙ্গে দেখা হয়।
এত কথা বললাম কেবল একজন মানুষের কথা বলতে গিয়ে। তিনি আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। গানের মানুষ যেমন, তেমন বলি গাছের মানুষও। গাছ মানুষ- যে কিছু গাছ মানুষ পৃথিবীর। আমি এক সন্ধ্যায় এই গাছের চরণধূলি নিতে গিয়েছিলাম। অনুজপ্রতিম তানভীরের সঙ্গে। তানভীর লেখালেখি করে, ধর্মপ্রাণ ছেলে। সিলছাপ্পড় মেরে দেওয়া সহজ- এই ছেলে উগ্রবাদী। সেই চেষ্টা ছিল। কাজ হয়নি। আর আমি একদিন জানতে পারি তানভীরের চাচা হলেন মহান সুরস্রষ্টা, গীতিকবি আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। আর কী বলব? আমরা যে কোনদিকে যাচ্ছি? আফসোস! যাক এসব। স্মরণ করি আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল : এক গাছকে। কী সব গান এই মানুষটার বানানো! আমার সারা দেহ খেও গো মাটি ... উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম সব ঘুরে এক ব্রহ্মচারী ..., আমার গরুর গাড়িতে বউ সাজিয়ে ... চিরকালের গান হয়ে গেছে আমাদের। তানভীরের সঙ্গে আমি তাঁর গানের স্টুডিওতে গিয়েছিলাম। ব্যস্ত, গান রেকর্ড করছিলেন। মধ্যবয়স্কা দু'জন মানুষকে যেভাবে গান তুলে দিচ্ছিলেন আমি এক বিরাট শিশুকে দেখছিলাম। বিরাট শিশু গাছ। আহারে!
রেকর্ডিংয়ের পর আমার সিরিয়াল। বিরাট শিশু গাছ না হলে এত মায়া থাকে নাকি মানুষের কলবে! আমি তাঁকে প্রণাম করলাম, তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে তাঁর চেয়ারে বসিয়ে দিলেন, অরিস সিগারেট খেতে দিলেন। সে এক আশ্চর্য সন্ধ্যা।
সব মনে আছে, সব কথা। বিরাট শিশু গাছের সব জেশ্চার। ওয়েবের মতো। বিশ্বসংগীতের ইতিহাস নিয়ে একটা বইয়ের কাজ করছেন তিনি। ইংরেজি বই। পেঙ্গুইন হয়তো ছাপবে। কিছু ড্রয়িং থাকবে বইতে। আমি যদি করি।
'আমার ড্রয়িং ভালো না বুলবুল ভাই।'
'আমার ভালো ড্রয়িংয়ের দরকার নেই ধ্রুব। তোমার প্রাণ দরকার। তুমি আঁকলে যে বাউল হবে সে আমার দেশের বাউল। তার মুখ চোখ নাই থাকল, হয়তো ... হয়তো সে অস্পষ্টই থাকল।'
অস্পষ্ট দেখাও দেখা। তীব্র দেখাই। মর্মে পশে কেবল মহাজনের তা।
'আমার সারা দেহ খেও গো মাটি ..., গানটা যখন লিখেন তখন আপনার বয়স কত বুলবুল ভাই?'
'উনিশ। সুরও ওই বছরই করেছিলাম।'
উনিশ (আঠার) বছর বয়স কী দুঃসহ!
পরে তাঁর বই নিয়ে কথা বলতে আরেকদিন তানভীর, কামরুল হাসান মিথুন আর আমি আবার গিয়েছিলাম তাঁর স্টুডিওতে। বইয়ের কাজ করছেন তিনি। লেখা দ্রুত শেষ করে ফেলবেন। তানভীর আমার কাছে পাণ্ডুলিপি পৌঁছে দেবে। আচ্ছা, মিথুন আপনার দুই-একটা পোর্ট্রেট তুলবে বুলবুল ভাই।
ওরে! এই প্রস্তাবে সে কী কাঁচুমাচু মানুষটা! লজ্জায় শেষ বুঝি। ছবি তুলতে ছাদে যাবেন না- রাজনৈতিক অনিরাপত্তাজনিত কারণও ছিল। মিথুন বারান্দায় কয়েকটা ছবি তুলল তাঁর। সিলুয়েট ধরনের সেই ছবি আমার কাছে আছে। ব্যক্তিগত। প্রকাশ করব না। কিছুই প্রকাশ করতে চাই না। কেবল বলি আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের চোখ মাটি খায়নি। গাছেদের চোখ মাটি খায় না। বিরাট শিশু গাছ সব দেখছেন। দেখছেন :
উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম সব ঘুরে এক ব্রহ্মচারী
থমকে দাঁড়াল
চমকে তাকাল
দেখল অনেক দূরে একটা গ্রাম দেখা যায় ...।
মানুষটা আছেন, গান করছেন, একটার পর একটা অরিস সিগারেট টানছেন- আমি আবার চরণধূলি নিতে যাব তাঁর। কবে জানি না। তবে তানভীর সেদিন আমার সঙ্গে থাকবে না। আর কেউ থাকবে না।
পুনশ্চ : মহাপ্রাণ আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল লোকান্তরিত হয়েছেন ২২ জানুয়ারি ২০১৯। চার বছর হয়ে গেছে। তাঁর জন্য এখন পর্যন্ত কোথাও কোনো শোকসভা হয়নি। ধিক! তবে এ আনন্দের কথা, লজ্জার কথা না। একজন শিশু গাছের জন্য শোক করবে কিছু মানুষের ডামি? কোনো দরকার নাই। কোনোই দরকার নাই।
১১.০১.২৩
- বিষয় :
- আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল
- ধ্রুব এষ