
মায়ের আঁচল তলে মমতার পরশ, বোনের আঁচলে মায়া আর প্রিয়সীর আঁচলে লেপ্টে থাকা গভীর মধুর প্রেম। বাঙালির মানসপটে শাড়ি যেন এভাবেই মোহময়তায় জড়িয়ে আছে আজন্ম। ফ্যাশনে কিংবা রুচিতে সময়ের গ্রিল বেয়ে পরিবর্তন হলেও বাঙালি নারীর পরিধেয় রূপে শাড়িতে একটুও ভাটা পড়েনি। বিচিত্র পরিচয়, রঙ ও কারুকাজে সেলাইবিহীন পরিধেয় হিসেবে কেবল শাড়িই যেন টিকে আছে আজও।
নারীর সাজে শাড়ি মানে, নারী অপরূপা, মুগ্ধনয়নী। তাই তো উৎসব কিংবা উপলে, পালা কিংবা পার্বণে বাঙালি নারীর একান্ত সঙ্গী শাড়ি। তাই শাড়ির প্রতি ভালোবাসা প্রকাশে ছাড় দেন না তরুণী থেকে বৃদ্ধাও। যদিও শাড়িই একমাত্র বাঙালি নারীর পরিধেয় নয়। তবে বর্তমান সময়ে বিশেষভাবে বাঙালি নারীর পোশাক হিসেবে শাড়ির পরিচিতি সবচেয়ে বেশি।
ডিজাইনারদের মতে, আজকালের নারীরা শুধু একটি ১২ হাত শাড়িতে তৃপ্ত নন। তারা শাড়িতে আর্ট-কালচারের একটি রিফেকশন খুঁজে বেড়ান। নজর রাখেন আরামদায়ক দিকেও। তাদের যেমন রয়েছে করপোরেট রুচিবোধ, তেমনি রয়েছে লিটারেরি রুচি। তাই শাড়িতে গুরুত্ব পায় নারীর রুচিবোধ, নারীর সামাজিক মর্যাদা, নারীর শিল্পমনস্কতা এবং বিদ্যমান সমাজ বাস্তবতা।
যেমন করে এলো
ইতিহাসবিদদের মতে, সংস্কৃত ‘সত্তিকা’ শব্দ থেকে শাড়ি শব্দটি এসেছে, যার অর্থ ‘কাপড়ের টুকরা’। তবে অনেকে মনে করেন, সংস্কৃত ‘শটী’ থেকে শাড়ি শব্দের উদ্ভব।
শাড়ি উৎপত্তির ইতিহাস খুব একটা স্পষ্ট নয়। সেলাইবিহীন বস্ত্রখণ্ড থেকে শাড়ি ধারণাটির উৎপত্তি। ধারণা করা হয়, বয়নশিল্পের প্রচলন ঘটার পরই শাড়ির প্রচলন ঘটেছিল। সিন্ধু সভ্যতায়ও এই পোশাকের ইতিহাস পাওয়া যায় । পুরোনো লেখমালা, মূর্তি, স্থাপত্য, বিগ্রহ, পোড়ামাটির শিল্প এবং বিচ্ছিন্ন কিছু সাহিত্য উপাদানেও বস্ত্রটির উৎসের খোঁজ বিদ্যমান। নবম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীতে রচিত চর্যাপদে শাড়ির অনুরূপ পোশাকের আভাস রয়েছে। চৌদ্দ শতকের কল্পকাহিনী, গল্প-গাঁথা ও গীতিকবিতায় রয়েছে শাড়ির কথা। কবি চণ্ডীদাসের কবিতায় শাড়ির কথা জানা যায় এভাবে, “নীল শাড়ি মোহন কারী/উছলিতে দেখি পাশ।/কি আর পরানে সঁপিনু চরণে/দাস করি মনে আশ।” ঐতিহাসিক মতে, প্রায় ৫৫০০ বছরের আগে আর্যগণ শাড়ি পরার প্রচলন শুরু করে। সময়ের ধারাবাহিকতায় ভারতবর্ষে মুসলমানদের আগমন আর মোঘল আমলে শাড়ি আভিজাত্যের ছোঁয়া পায়। যা পরবর্তীতে অঞ্চলভেদে পরিধানে নানা স্টাইলের দেখা মিলে। আধুনিকভাবে শাড়ী পরিধানে নতুনত্বের প্রকাশ ঘটে জোড়াসাঁকো পরিবারে।
নব্বই দশকে শুরু হলেও শূন্য শতকের শুরুর দশকে আমাদের দেশীয় ফ্যাশন হাউসগুলো শাড়ির বুনন ও ডিজাইনে নিয়ে আসেন বৈচিত্র্য। একই দশকের শেষের দিকে ধর্মীয় এবং সামাজিক উৎসবগুলোতে দেশীয় ফ্যাশন হাউসগুলোর পোশাক জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করে। ফ্যাশন ডিজাইনারদের নিপুণ শৈল্পিক দতায় শাড়ির বুনন, নকশায়, প্যার্টানে আসে বৈচিত্র্য। রঙের ব্যবহারে আসে নতুনত্ব। এভাবেই পোশাককে বাঙালি নতুন আঙ্গিকে আবিষ্কার করতে শুরু করে।
বিচিত্র নামে পরিচয়
শাড়ির নামেও বৈচিত্র্যের ছোঁয়া বিদ্যমান। অযোধ্যার সীতাদেবী পরিধেয় সূ্ম বস্ত্রটির নাম ‘অমুকা’। কৃষ্ণের সঙ্গে অভিসারে রাধার পরনে ছিল রুপালি জরিকাজের ‘মেঘবরণ’ শাড়ি, কবি রাজশেখর যার নাম দেন ‘মেঘাম্বরী’ শাড়ি। তার নাটকের খল চরিত্রের নারীরা পরেছে ‘অগ্নিপট্ট’। নাটকের উৎসব-দৃশ্যে সৎ নারীর পরনে ছিল সুদৃশ্য ‘মনোজ-পুষ্প’ শাড়ি। এই কবির কাব্যনাট্যের নারী চরিত্রের পরিধেয়র নানা রকম নাম পাওয়া যায়। যেমন: ‘ময়ূরকণ্ঠী’, ‘ধনুশ্রী’, ‘রাজবেলি’, ‘হংসল্মী’। আর সি মজুমদার ‘হিস্ট্রি অব বেঙ্গল’ গ্রন্থে জানিয়েছেন, প্রথম চন্দ্রগুপ্তের আমলে চার রকমের শাড়ি তৈরি হতো– দুকূলা, কুসুম, পত্রোনা, কার্পাসিকা। প্রাচীনকালের নারীরা বিভিন্ন উদ্দেশ্য ও অনুষ্ঠানে ভিন্ন ভিন্ন শাড়ি পরত। সেসবের নামের মধ্যে রয়েছে– অধ্যয়া, ব্রশতী, বীরাঞ্জলি, পদ্মলতা, মৎস্য-পুষ্প শাড়ি। কবি জসীমউদ্দীনের ‘পূর্ববঙ্গের নঙী কাঁথা ও শাড়ি’ প্রবন্ধে শাড়ির বাহারী নাম পাওয়া যায়, যেমন– কৃষ্ণ নীলাম্বরী, সোনাঝুরি, মধুমালা, কলমীলতা, গোলাপ ফুল, কুসুম ফুল, রাসমঙ্গল, জলে-ভাসা, কাদিরের শাড়ি, জামের শাড়ি, ফরাসি শাড়ি, ল্মীবিলাস, এক-পাছুল্লা, কাচ পাইড়, বাঁশি পাইড়, চোদ্দরসী, কাঁকড়ার ছোপ, কালপিন, গাল পাইড়, কুনারি, আয়না ফোঁটা ইত্যাদি। এলাকাভেদে রয়েছে নকশা বা উপকরণে বিভিন্নতা। রয়েছে নামের ভিন্নতাও। যেমন: কাতান– বার্মিজ, সাইমন, ইরানি।
গ্রন্থনা: রিক্তা রিচি
মন্তব্য করুন