মে মাসের ২৯ তারিখ এলে আগের মতোই অপেক্ষায় থাকি। মনে হয়, এই বুঝি ফরীদির ফোন_ খিচুড়ি খাওয়ার জন্য। প্রতি জন্মদিনে নিজ হাতে খিচুড়ি রান্না করত ফরীদি। আমি আর এশা ছিলাম ওর হাতের রান্না করা খিচুড়ির ভক্ত। জন্মদিনে দেশের বাইরে না থাকলে এটি ছিল তার রুটিন বাঁধা কাজ। ফরীদি প্রায়ই একা থাকলে রাত-বিরাতে আমাদের বাসায় আসত। সময়ের হিসাব ছিল না। আমার হাতের যে কোনো রান্না পছন্দ করতো। অনেক সময় এমন হয়েছে, ফরীদি গভীর রাতে ফোন করে এশা কেমন আছে জানতে চেয়েছে। হুট করেই বাসায় এসে আমার আর বাচ্চুর সঙ্গে গল্প করেছে। এশা ঘুমিয়ে পড়লে ওর কপালে চুমু খেয়ে চলে গেছে।

ঢাকা থিয়েটারে ও আমাদের ব্যাচ ছিল। ফরীদি কেবল সহকর্মী ছিল না, আমরা একে অপরের ভালো বন্ধু ছিলাম। একে অপরকে ভালো বুঝতে পারতাম। ব্যক্তি ফরীদিকে আমি ভাই হিসেবে, বন্ধু হিসেবে আপন করে নিয়েছিলাম। হয়তো অনেক সময় কাটানোর ফলেই আমাদের সম্পর্কটা রক্তের সম্পর্কের ঊধর্ে্ব গিয়ে আত্মার সম্পর্কে পেঁৗছে গিয়েছিল। ও যেন আমার ঘরেরই একজন। আমাদের বড় অভিভাবক।

ফরীদি কেবল অভিনয় করত না। ও অভিনয়ের সঙ্গে মেধা এবং বুদ্ধির সমন্বয় ঘটিয়েছিল। ঢাকা থিয়েটারে ওর প্রথম নাটক 'শকুন্তলা'। এ নাটকে তক্ষকের ভূমিকায় অভিনয় করে ফরীদি। প্রথম নাটকেই সবার নজরে পড়েছিল ফরীদি।

তখন রাইসুল ইসলাম আসাদ, আফজাল হোসেন, পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে উচ্চারিত হয়েছিল তার নাম। কেবল অভিনয় নয়, উচ্চারণের ক্ষেত্রে দারুণ সচেতন ছিল। প্রচুর পড়াশোনা করত। কবিতা ভালোবাসত। ধ্রুপদী সাহিত্যের পাশাপাশি সমসাময়িক লেখকদের খোঁজখবর রাখত। বাউণ্ডুলে স্বভাবের হলেও সঙ্গে বই থাকত সব সময়। থিয়েটার ও নাটক নিয়ে ওর জানাশোনা ঈর্ষণীয়। ফরীদি যখন জাহাঙ্গীরনগরের পাট চুকিয়ে ঢাকা থিয়েটারে এলো, ওর ধ্যান-জ্ঞান ছিল অভিনয়। প্রথমদিকে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানে চাকরিও করেছে, কিন্তু অভিনয়ের জন্য সব ছেড়ে দিয়েছে এক সময়। তখন টেলিভিশন বলতে কেবল বিটিভি ছিল। 'সেতু কাহিনী'তে [সম্ভবত] প্রথমবারের মতো সে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করে। সেখানে ওর সঙ্গে কাজ করেছিলাম। প্রথম নাটকেই ফরীদি নিজের অভিনয়-যোগ্যতা প্রমাণ করেছে। এর পর একে একে 'নির্বাসন', 'ভাঙনের শব্দ শুনি', 'সংশপ্তক', 'গ্রন্থিকগণ কহে'সহ আরও কত নাটক! তারপরের ইতিহাসটা সবাই জানে।

কেবল টিভিতে নয়, মঞ্চে ফরীদি ম্যাজিক সৃষ্টি করতে জানত। 'কেরামতমঙ্গল' নাটকে প্রৌঢ় কেরামত, 'কীত্তনখোলা'র ছায়ারঞ্জন মনে হতো পুরো মঞ্চ অধিকার করে নিয়েছে সে।একজন হুমায়ুন ফরীদির যা দেওয়ার ছিল, যা করতে পারত, তার কোনো কিছুই করতে পারেনি সে। এটি আমার জন্য অনেক কষ্টের যে ওর মতো বহুমুখী অভিনেতাকে আমরা ব্যবহার করতে পারলাম না।

শিমূল ইউসুফ ও হুমায়ুন ফরীদি

ফরীদির হাসিমাখা মুখটা বারবার মনে পড়ে। কোথাও ঘুরতে গেলে খুব মজা করত। থিয়েটার নিয়ে আলোচনা চলত, মহড়া চলত, পাশাপাশি ও বানিয়ে বানিয়ে ভূতের গল্প বলত। রীতিমতো থিয়েটারে যে রকম ইম্প্রোভাইজ করে গল্প বলত, সে রকম। আমরা সে গল্প শুনে ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতাম। রাতে ঘুমিয়ে পড়লে ও ভয় দেখানোর বিচিত্র সব উপায় বের করত। মাঝে মাঝে অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটাত। আমরা ভয় পেলেও জানতাম এটা ফরীদির কাজ। আর সকাল হতেই শুরু হতো ওর মার খাওয়ার পালা।

তাৎক্ষণিক অভিনয় ক্ষমতা অনেক নাটক ও চলচ্চিত্রে দেখতে পাই। মঞ্চে অনেক কঠিন সময়ে ও ইম্প্রোভাইজ করেছে। এটি এমন এক গুণ, যা স্বতঃস্ফূর্ত অভিনেতা ছাড়া কারও পক্ষে সম্ভব নয়। তাই দুষ্টুমি করলেও সব সময় আমাদের মূল আলোচনার বিষয় ছিল মৌলিক থিয়েটার নিয়ে। সেলিম আল দীনের সাহচর্যে একটি নির্দিষ্ট অভিনয়রীতি গড়ে তুলতে পেরেছিলাম সে সময়।

ফরীদি অনেক ভালো রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে পারত সেটা অনেকেই জানেন না। নাটকের শো শেষ করে আমরা একসঙ্গে গলা ছেড়ে গাইতাম। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে আজম খান পর্যন্ত আমাদের আয়ত্তে ছিল। ফরীদির প্রাণবন্ত গলা আসর মাতিয়ে রাখত। অবাক হবেন_ বিভিন্ন নাচের স্টেপিংও অদ্ভুতভাবে আয়ত্ত করেছিল ফরীদি।

ঢাকা থিয়েটার থেকে ফরীদি 'ভূত' নাটকের নির্দেশনা দিয়েছিল। তার আগে জাহাঙ্গীরনগর থিয়েটারে অনেক নাটকে সে নির্দেশনা দিয়েছে।

ফরীদির এত শত কথা, হাজারো স্মৃতি সংরক্ষণ করে রাখা উচিত পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। কারণ তাকে যারা দেখেনি; কেবল শুনে শুনে তার জীবনদর্শন, অভিনয়, নাট্যচর্চা থেকে জ্ঞানলাভ সম্ভব নয়। জলজ্যান্ত ফরীদিকে যারা দেখেনি, তাদের পক্ষে শুধু শুনে তার আদর্শ অনুভব করা সম্ভব নয়। আমি বিশ্বাস করি, ফরীদি যেখানেই থাকুক, ভালো আছে।