
সংগীতের নেশায় একজন মানুষ কীভাবে ডুবে থাকতে পারে- তা বাচ্চুকে [আইয়ুব বাচ্চু] দেখে নতুন করে জেনেছিলাম। সংগীত হয়ে উঠেছিল ওর ধ্যান-জ্ঞান। বাচ্চু যখন ঢাকায় আসে, তখনই ওর সঙ্গে পরিচয়। গানের ভুবনে কিছু একটা করে দেখাবে- এই জেদ নিয়ে চট্টগ্রাম ছেড়ে ঢাকায় এসেছিল। আইয়ুব বাচ্চুর গিটার বাদন নিয়ে তো নতুন করে বলার কিছু নেই। আমার বিচারে বাচ্চু উপমহাদেশের সেরা গিটারিস্টের একজন। বাচ্চু বলত, গিটারই ওকে ঘরছাড়া করেছে। এ শুধু কথার কথা নয়, এটাই তার জীবনে বাস্তব একটি ঘটনা। তাই যখনই এই গিটারপাগল ছেলেটার কথা মনে হয়, একরাশ কষ্ট বুকে ভর করে। ও আমাকে বড় ভাই বলে সম্বোধন করত। সম্মানও করত বড় ভাইয়ের মতো। সেই ছোট ভাইয়ের অকালে চলে যাওয়া তাই কোনোভাবেই মেনে নিতে পারিনি। আমি শুধু আমার ছোট ভাইকে নয়, হারিয়েছি সংগীতের এক মেধাবী সুহৃদকে।
আশির দশকের কথা। আইয়ুব বাচ্চু তখন তরুণ মিউজিশিয়ান। নামি মিউজিশিয়ানদের ভিড়েও তাকেই বেছে নিয়েছিলাম, নতুন গান করার জন্য। বাচ্চু দুটি গান তৈরি করেছিল আমার জন্য; যা শুনে যতটা মুগ্ধ হয়েছি, তার চেয়ে বেশি অবাক হয়েছি সংগীতে তার দূর দৃষ্টিভঙ্গি দেখে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কীভাবে নতুন কিছু তুলে ধরা যায়, তার অনেক উদাহরণ দেখে গেছে সে। আমার 'মেঘের পালকী' অ্যালবামে বাচ্চুর সুর, সংগীতের গান দুটি ছিল তার অনন্য উদাহরণ।
কবে, কোথায় বাচ্চু আমার মেয়ে তনিমার [তনিমা হাদী] গান শুনেছিল জানা নেই। একদিন হঠাৎ করেই বাচ্চু বলল, 'হাদী ভাই, তনিমার কণ্ঠ তো অসাধারণ। দারুণ গান করে। আমি ওকে নিয়ে একটি অ্যালবাম করতে চাই।' বাচ্চুর এই কথা শুনে না বলার কিছু ছিল না। কারণ ওর কাজ সম্পর্কে আমার আগে থেকেই ধারণা ছিল। আমার সম্মতি পেয়েই ও আর দেরি করেনি। পুরো একটি অ্যালবাম তৈরি করে ফেলেছিল। এখানেই শেষ নয়, তনিমা বিদেশে থেকে দেশে ফিরেছে- এই খবর কানে যাওয়া মাত্রই বাচ্চু বাসায় এসে হাজির হতো। যথারীতি ওর সঙ্গে থাকত একটি গিটার। ঘণ্টার পর ঘণ্টা গিটার বাজিয়ে তনিমাকে দিয়ে গান গাওয়াত। তনিমাও ততদিনে বাচ্চুর সংগীতের সঙ্গে তার গায়কী দারুণভাবে মিলিয়ে নিয়েছিল। এভাবেই আমার পরিবারের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল বাচ্চু। তাই বাচ্চুর অকাল বিদায় তনিমাও ভীষণ কষ্ট পেয়েছে। রক্ত সম্পর্কের কেউ হঠাৎ চলে গেলে যে কষ্ট মনে ভর করে, বাচ্চুর চলে যাওয়ার সংবাদে তনিমার চোখেমুখেও ফোটে ওঠে সেই কষ্টের ছাপ।
আইয়ুব বাচ্চুকে বেশিরভাগ মানুষ ব্যান্ডশিল্পী হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন। কিন্তু আমি তাকে শুধু ব্যান্ডশিল্পী নয়, একজন পরিপূর্ণ শিল্পী হিসেবে উল্লেখ করতে চাই। গিটার প্রসঙ্গে নাইবা গেলাম, কারণ সবাই জানেন এবং মানেন, আইয়ুব বাচ্চু তার কালের সেরা গিটারিস্ট। যার সঙ্গে দেশের আর কারও তুলনা চলে না। গিটার শিল্পী ছাড়াও সে যে অসাধারণ এক সংগীত পরিচালক- এটাও মানতে হবে। সময়ের চাহিদা পূরণ ছাড়াও বাচ্চু অসংখ্য নিরীক্ষাধর্মী কাজ করে গেছে। মূলধারার বাংলা গানের সঙ্গে পাশ্চাত্য সংগীতের মিশ্রণে তার সৃষ্টি এক কথায় অনবদ্য। ব্যান্ড সংগীত নিয়ে যারা বিভিন্ন সময় নানা কথা বলেছেন, সেসব শ্রোতাকেই অভিনব সংগীত সৃষ্টির মাধ্যমে মত বদলাতে বাধ্য করেছেন। দেশীয় ব্যান্ড সংগীতের উত্থানে যাদের অবদান, আইয়ুব বাচ্চু ছিলেন তাদের অন্যতম একজন। নব্বই দশকের বাংলা গানের দিকে নজর দিলে দেখা যায়, ব্যান্ড সংগীত দেশের তরুণ প্রজন্ম থেকে শুরু করে প্রায় সব বয়সী শ্রোতার মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে। আর শ্রোতার রুচি বদলে যাদের ভূমিকা ছিল, তাদের মধ্যে আইয়ুব বাচ্চু ও তার ব্যান্ড এলআরবির অবদান অনস্বীকার্য। ব্যান্ডের বাইরেও একক ও মিশ্র অ্যালবামের জন্য নানা ধরনের গান তৈরি করেছে বাচ্চু। প্লেব্যাকও করেছে বেশ কিছু ছবিতে। যার অনেক গান এখনও মানুষের মুখে শোনা যায়। এভাবেই আইয়ুব বাচ্চু তার অনবদ্য সৃষ্টির মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকবে যুগের পর যুগ- এটাই আমি বিশ্বাস করি।
মন্তব্য করুন