
শনিবার শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় আয়োজিত 'স্মৃতিতে স্মরণে আলী যাকের' শীর্ষক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন নাট্যজন ফেরদৌসী মজুমদার। মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন (বাঁ থেকে) আবদুস সেলিম, আবুল হায়াত ও আসাদুজ্জামান নূর- সমকাল
শুভ্রতার রং সাদা। সেই সাদার মোড়কে সাজানো মঞ্চে উপস্থিত নাট্যজনদের স্মৃতিচারণ, মূল্যায়ন ও তার ভালোলাগার গান-কবিতা পাঠের মধ্য দিয়ে স্মরণ করা হলো নাটকের মানুষ আলী যাকেরকে। গতকাল ৬ নভেম্বর ছিল গুণী এই নাট্যজনের ৭৭তম জন্মদিন। তিনি এখন স্মৃতির অন্তরালে। কিন্তু নাটকের মানুষরা ভোলেননি তাদের প্রিয় মানুষ ছটলুকে। নাট্যাঙ্গনের ভালোবাসার মানুষের 'ছটলু ভাই' ও দেশবাসীর প্রিয় মানুষ প্রয়াত আলী যাকেরকে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় তার জন্মদিন উদযাপন করেছেন নাট্যকর্মীরা।
দলের প্রয়াত সদস্যের জন্মদিন উপলক্ষে 'স্মৃতিতে স্মরণে আলী যাকের' শিরোনামে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়। গতকাল সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার মূল মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় ৭৭তম জন্মদিনের এই আয়োজন।
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সহ-অভিনয়শিল্পীরা বলেন, বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনের প্রবাদপুরুষ ছিলেন আলী যাকের। নাটকের চর্চা, প্রসার ও নাট্য আন্দোলনে শুরু থেকেই রেখেছেন অগ্রণী ভূমিকা। রচনা, অভিনয় ও নির্দেশনা শিল্পের তিন মাধ্যমেই ঘটিয়েছিলেন নিজের সফল বহিঃপ্রকাশ। এ দেশের নাটকের সব অর্জন ও সফলতার অংশীদার আলী যাকের। স্মৃতির অন্তরালে চলে যাওয়ার পরও নাটকের মাধ্যমে তিনি অমর হয়ে আছেন।
চার পর্বের স্মৃতিচারণ, আবৃত্তি ও গান দিয়ে সাজানো ছিল বর্ণাঢ্য এই আয়োজন। নাট্যজন সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানের শুরুতেই প্রথম পর্বের স্মৃতিচারণে আলী যাকেরের বর্ণিল জীবনের ওপর আলোকপাত করেন নাট্যজন ফেরদৌসী মজুমদার, আবুল হায়াত ও আবদুস সেলিম।
'তিনি আমার অন্যতম যোগ্য, সহ-অভিনতা ছিলেন' বলে উল্লেখ করেন ফেরদৌসী মজুমদার। তিনি বলেন, 'যাকেরের প্রবেশটাই ছিল অন্য রকম। বিশাল দেহের মানুষ হলেও ছিলেন একদম শিশুসুলভ মনের মানুষ। ভোজনরসিকও ছিলেন। খেতে ভালোবাসতেন। নিষ্ঠাবান ছিলেন কাজের প্রতি।'
আবুল হায়াত বলেন, 'তাকে নিয়ে মঞ্চে কথা বলতে হবে ভাবিনি। আজ তার জন্মদিন সবাই মিলে উদযাপন করার কথা;ড় কিন্তু তা স্মৃতিচারণে পরিণত হয়েছে। বহুমাত্রিক মানুষটি সবসময় সৃষ্টির চিন্তায় বিভোর থাকতেন। তিনি নাটক নির্মাণ করতে, অভিনয় করতে, গান গাইতে ভালোবাসতেন।
অভিনয়ের প্রতি তার এক ধরনের উন্মাদনা ছিল।'
আসাদুজ্জামান নূর বলেন, আলী যাকের ছিলেন বহুমাত্রিক। নানান পরিচয়ে তিনি পরিচিত ছিলেন। তিনি কলাম লেখকও ছিলেন। সর্বোপরি তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে তিনি ধারণ করেছিলেন।
এরপর রবীন্দ্রনাথের গান 'তুমি ডাক দিয়েছো কোন সকালে' গেয়ে শোনান রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা এবং 'নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ' কবিতাটি আবৃত্তি করেন আহকামউল্লাহ। দ্বিতীয় পর্বের স্মৃতিচারণে অংশ নেন নাট্যজন আতাউর রহমান, প্রয়াত সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের পত্নী আনোয়ারা সৈয়দ হক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু।
নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, আলী যাকের একজন মুক্তিযোদ্ধা। '৭২ সালে নাটক নির্দেশনার মধ্য দিয়ে মঞ্চে যোগ দেন। সে সময় প্রতি রোববার সকালে তার নাটক দেখার জন্য আমরা অপেক্ষা করতাম। বাংলা মঞ্চে আলী যাকেরের মতো 'আইকনিক ফিগার' কম এসেছেন। দেওয়ান গাজীর কিসসা নাটকে অসাধারণ অভিনয় ছিল তার। ক্রমান্বয়ে আলী যাকের থেকে ছটলু ভাই হয়ে যান তিনি। তিনি শুধু মঞ্চের মানুষই নন, তিনি আন্দোলন-সংগ্রামেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন।
এরপর রবিঠাকুরের 'তুমি নির্মল করো' গানটি পরিবেশন করেন প্রিয়াঙ্কা গোপ ও 'আট বছর আগের একদিন' কবিতাটি আবৃত্তি করেন শিমুল মুস্তাফা। তৃতীয় পর্বে স্মৃতিচারণ করেন শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী, নাট্যকার মাসুম রেজা ও অভিনেত্রী শিমূল ইউসুফ।
মাসুম রেজা বলেন, যাকের ভাইয়ের অভিনয় নিয়ে আমার বলার কিছু নেই। এই জায়গায় তিনি অসাধারণ ছিলেন। তিনি মানুষকে অনেক উৎসাহিত করতে পারতেন। তার বক্তব্য শুনে আমি অনেক অনুপ্রাণিত হয়েছি। তিনি মানুষকে অনেক আনন্দ দিতে পারতেন।
এ সময় বাবার স্মৃতিচারণ করেন আলী যাকেরের ছেলে ইরেশ যাকের। তিনি বলেন, বাবার চলে যাওয়ার তিন বছর আগে থেকে তাকে দেখেছি, তার বিশ্বাস ছিল তিনি বেঁচে থাকবেন। এটাই হয়তো একজন পারফর্মারের সেরা পরিবেশনা। অভিনয় জীবনেও যা করতেন আমার কাছে মনে হতো সেটাই ঠিক।
এ পর্ব শেষে 'মুক্তির মন্দির সোপান তলে' গেয়ে শোনান ফারহিন খান জয়িতা এবং আলী যাকের রচিত 'সেই অরুণোদয়ের থেকে' পাঠ করেন ত্রপা মজুমদার। চতুর্থ ও শেষ পর্বে স্মৃতিচারণে অংশ নেন নাট্যাভিনেতা রামেন্দু মজুমদার ও তারিক আনাম খান।
রামেন্দু মজুমদার বলেন, প্রায় প্রতি বছর আলী যাকেরের জন্মদিনে আমি তার বাড়িতে গেছি। তাকে আমি বস বলে সম্বোধন করতাম। আলী যাকের তার কাজের মাধ্যমে বেঁচে থাকবেন। তার চিরস্থায়ী একটা কাজ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। এটি নির্মাণের ক্ষেত্রে তার অবদান অনেক। আমরা অনেকেই যা করতে পারিনি, যাকের তা করে গেছেন। তিনি যেখানেই হাত দিয়েছেন সোনা ফলেছে।
তারিক আনাম খান বলেন, মঞ্চে অভিনয় করে মানুষের মনে কীভাবে দাগ কাটা যায়, তিনি তা প্রমাণ করেছেন। তার কাছে যে প্রয়োজনে গিয়েছি, নির্দি্বধায় তিনি সহযোগিতা করেছেন। প্রকৃতিপ্রেমী একজন মানুষ ছিলেন আলী যাকের। মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত নিজের মধ্যে শিশুর মতো ভাব লালন করেছেন।
সব শেষে স্বামীর স্মৃতিচারণ করেন আলী যাকেরপত্নী সারা যাকের। পরে বাপ্পা মজুমদারের কণ্ঠে 'পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে' গানটির মধ্য দিয়ে আয়োজনের সমাপ্তি ঘটে।
১৯৪৪ সালের ৬ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রতনপুরে জন্মগ্রহণ করেন আলী যাকের। মঞ্চ, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রের এই শক্তিমান অভিনেতা দেশের বিজ্ঞাপনশিল্পের পুরোধা ব্যক্তিত্ব। ১৯৭২ সালে আরণ্যক নাট্যদলের হয়ে মামুনুর রশীদের নির্দেশনায় মুনীর চৌধুরীর 'কবর' নাটকটিতে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে আলী যাকেরের মঞ্চাভিনয় শুরু। এরপর ওই বছরই আতাউর রহমান ও জিয়া হায়দারের আহ্বানে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ে যোগ দেন। নাগরিকের হয়ে প্রথম অভিনয় করেন 'বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ' নাটকে। এরপর ১৯৭৩ সালে দর্শনীর বিনিময়ে বাংলাদেশের প্রথম নাটক নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের 'বাকি ইতিহাস' নাটকটি নির্দেশনার মধ্য দিয়ে অভিনেতা থেকে নির্দেশক বনে যান আলী যাকের।
আলী যাকের অভিনীত উল্লেখযোগ্য মঞ্চনাটকগুলো হলো- কবর, বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ, বাকী ইতিহাস, বিদগ্ধ রমণীকুল, তৈল সংকট, এই নিষিদ্ধ পল্লীতে, দেওয়ান গাজীর কিস্সা, সৎ মানুষের খোঁজে, অচলায়তন, কোপেনিকের ক্যাপ্টেন, ম্যাকবেথ, টেমপেস্ট, নূরলদীনের সারাজীবন, কবর দিয়ে দাও, গ্যালিলিও ইত্যাদি। তিনি চারটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। সেগুলো হলো- আগামী (১৯৮৬), নদীর নাম মধুমতী (১৯৯৬), লালসালু (২০০১) ও রাবেয়া (২০০৮)। আলী যাকের অভিনীত উল্লেখযোগ্য নাটকগুলো হলো- বহুব্রীহি (১৯৮৮), আজ রবিবার (১৯৯৯), একদিন হঠাৎ (১৯৮৬), নীতু তোমাকে ভালোবাসি, পাথর সময়, অচিনবৃক্ষ, আইসক্রিম, পাণ্ডুলিপি, গণি মিয়ার পাথর ইত্যাদি। শিল্পকলায় বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ আলী যাকের ১৯৯৯ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন। এ ছাড়া তিনি পেয়েছেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, বঙ্গবন্ধু পুরস্কার, মুনীর চৌধুরী পদক, সেলিম আল দীন পদক, নরেন বিশ্বাস পদক ইত্যাদি।
ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০২০ সালের নভেম্বরে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন আলী যাকের। এরপর ২৭ নভেম্বর সকালে তিনি মারা যান।
মন্তব্য করুন