গতকাল মঙ্গলবার প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় মহাসিন্ধুর ওপারে চিরঅনন্তের পথে যাত্রা করলেন। ছয় দশকের বেশি সময়জুড়ে তার গাওয়া অগণিত ক্লাসিক্যাল, আধুনিক ও সিনেমার গান আজও সমান জনপ্রিয়। তিনি কয়েক প্রজন্মের প্রিয় শিল্পী। বরেণ্য এ সংগীত-ব্যক্তিত্ব্বের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন দেশের চার বিশিষ্ট শিল্পী....

ফেরদৌসী রহমান
গুণী শিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গানের ভক্ত আমি। সংগীতজীবনে লতা মঙ্গেশকরের চেয়ে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গানই বেশি গেয়েছি। বাবারও খুব প্রিয় শিল্পী ছিলেন। মনে পড়ে, আব্বা যখন রেকর্ড কিনতেন তখন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের রেকর্ড থাকত তালিকায়। তার গায়কিই ছিল আলাদা। সে জন্য তার গানের সঙ্গে আর কারও গান মেলানো কঠিন। চার দশক আগে চব্বিশ পরগনার একটি অনুষ্ঠানে তার সঙ্গে এক মঞ্চে গেয়েছি। পরে কলকাতায়ও দেখা হয়েছিল। সাদাসিদে একজন মানুষ। চলনে-বলনেও অন্যরকম। কাছাকাছি গেলে মুগ্ধতা বেড়ে যায়। এক সাক্ষাৎকারে এপার বাংলার শিল্পীদের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে আমার গানের প্রশংসা করেছিলেন। এটা সংগীতজীবনের পরম পাওয়া।

খুরশীদ আলম
বাংলা গানে লতা মঙ্গেশকরের পরেই যার নাম উচ্চারিত হয় তিনি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। তার অনিন্দ্য কণ্ঠ আর অনবদ্য গায়কিতে মুগ্ধ হয়নি- এমন শ্রোতা খুঁজে পাওয়া কঠিন। গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় শুধু শিল্পীই ছিলেন না; ছিলেন শিল্পী হয়ে ওঠার স্বপ্নদ্রষ্টা। তার গান শুনেই অনেকে সুরের ভুবনে পথচলার স্বপ্ন রচনা করেছেন। ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্রকে তিনি গানে গানে মুখরিত করে রেখেছিলেন কয়েক দশক। তার কণ্ঠ আর গায়কির কথা মাথায় রেখেই অনেকে নতুন সুর সৃষ্টি করতেন। একদিকে ক্লাসিক্যাল, আধুনিক থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের গানে তিনি পারদর্শী ছিলেন। এক কথায়, তিনি ছিলেন তার কালের শ্রেষ্ঠ ভার্সেটাইল শিল্পী। এমন একজন শিল্পীর চলে যাওয়া তাই কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।

সৈয়দ আবদুল হাদী
লতা মঙ্গেশকরের চলে যাওয়ার শোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতে কানে এলো- সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় আর নেই। মনে হলো, লতাই যেন সন্ধ্যাকে বলেছে, 'আমি তো চলে গেলাম, তুমিও আমার কাছে চলে আসো।' আসলে এত অল্প সময়ের ব্যবধানে শ্রেষ্ঠ দু'জন শিল্পীর চলে যাওয়া কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না। চোখে সেই পুরোনো দিনের একটি স্মৃতি ভেসে উঠছে। কলকাতায় গিয়েছিলাম একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। অসুস্থ থাকার পরও সে আয়োজনে এসেছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। ভালো লাগার বিষয় এটাই যে, সেদিন তার সামনে গাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। যাদের গানে ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্র সমৃদ্ধ হয়েছে, তিনি তার অন্যতম। চলচ্চিত্রের গানে নবযুগের সৃষ্টি হয়েছিল সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের আগমনে। তিনি নেই- এটা ভাবতেই ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।

কুমার বিশ্বজিৎ
আরেক নক্ষত্রের পতন হলো। অনেক বছর আগে কলকাতায় সন্ধ্যা দিদির সঙ্গে দেখা হয়েছিল। প্রিয় মানুষটির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পেরে খুবই ভালো লেগেছিল। এ ধরনের শিল্পী ক্ষণজন্মা। আমার মা-বাবা, দাদা তার গান শুনেছেন। আমিও শুনে শুনে বড় হয়েছি। সুরের জাদুতে প্রজন্মের পর প্রজন্ম বিমোহিত করেছেন তিনি। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় একটি মহিরুহ। বাংলা গানের এক ব্যতিক্রমী কণ্ঠস্বর। তার গান শুনে আমরা কল্পনার জগতে চলে গেছি হাজারবার। মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের লিপে তার গান ছিল একেবারে পারফেক্ট। গান শুনে মনে হতো, সুচিত্রা সেনই গাইছেন। তার গানে যে নাটকীয়তা, সুরের সঙ্গে অভিনয়- সবকিছু মিলিয়ে তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়।
তার কালজয়ী গান
- মধু মালতী ডাকে আয়
- এ শুধু গানের দিন
- চন্দন পালঙ্কে
- হয়তো কিছুই নাহি পাবো
- আমি তার ছলনায়
- ঘুম ঘুম চাঁদ ঝিকিমিকি তারা
- আর ডেকো না
- কে তুমি আমারে ডাকো
- প্রিয়া প্রিয়া কে ডাকে
- কী মিষ্টি দেখো মিষ্টি
- আজ কৃষ্ণচূড়ার আবির
- কাজ নেই আর আমার
- কিছু ক্ষণ আরো না হয়
- আমি প্রিয়া তুমি প্রিয়
- আমি তো তোমারই কাছে
- আর জনমে হয় যেন গো
- মায়াবতী মেঘে এলো তন্দ্রা
- এ শুধু গানের দিন
-সজনী দিন রজনী কাটে না যে
- ভালোবাসার দিনগুলি মোর
- আমি তো তোমারে চাইনি জীবনে
- তুমি আরেকটি দিন থাকো
- আমি জেনে শুনে বিষ করেছি পান
-আর ডেকো না সেই মধুনামে
- আমি স্বপ্নে তোমায় দেখেছি
-এই পথ যদি না শেষ হয়