‘ওকি গাড়িয়াল ভাই- হাকাও গাড়ি তুই চিলমারীর বন্দরে’। এই বন্দরেই বেড়ে উঠা প্রখ্যাত ভাওয়াইয়া শিল্পী ও সাংবাদিক সফিউল আলম রাজা ২০১৯ সালের ১৭ মার্চ মিরপুর পল্লবীতে নিজ কার্যালয় কলতান সাংস্কৃতিক একডেমিতে ঘুম থেকে চির ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমান। 

রাজা ভাওয়াইয়ার অন্যতম প্রখ্যাত এক শিল্পীর নাম। শ্রোতা দর্শকের কাছে ভাওয়াইয়ার ফেরিওয়ালা, ভাওয়াইয়ার রাজকুমার, গাড়িয়াল ভাই ও ভাওয়াইয়া রাজা নামে পরিচিত। তার জনপ্রিয়তা আর গায়কী প্রতিভায় ভাওয়াইয়া সংগীত অঙ্গনে যোগ হয়েছে এক নতুন মাত্রা। 

সঙ্গীতজ্ঞদের মতে, টেলিভিশনে সব চেয়ে বেশি ভাওয়াইয়া গান করেছেন রাজা। ভাওয়াইয়া গানকে তিনিই টেলিভিশনে প্রতিষ্ঠা করেছেন। ভাওয়াইয়ার প্রচার ও প্রসারে নতুন প্রজন্মকে শেকড়মুখী করতে দেশ ও দেশের সীমানা পেরিয়ে সারা বিশ্বের সকল বাংলা ভাষা ভাষীর কাছে এই গানকে ছড়িয়ে দিয়েছেন তিনি।   

গীতিকার, সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি সাংবাদিকতাও করেছেন রাজা। তার সাংবাদিকতা ক্যারিয়ার ২৪ বছরের। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন অনেকগুলো সম্মাননা পুরস্কার। সাংবাদিকতায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পুরস্কার, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কার, ডেমোক্রেসি ওয়াচ হিউম্যান রাইটস অ্যাওয়ার্ড, ইউনেস্কো ক্লাব অ্যাসোসিয়েশন অ্যাওয়ার্ড, ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অ্যাওয়ার্ড সহ অনেক পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন তিনি। 

রাজা বাংলাদেশ বেতারের ‘বিশেষ’ ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের ‘প্রথম’ শ্রেণির শিল্পী ছিলেন। এ ছাড়াও তিনি দেশের সব কয়টি চ্যানেলে সংগীত পরিবেশন করেছেন। সংগীত পরিবেশন করেছেন বিদেশি বিভিন্ন মঞ্চ এবং মিডিয়াওতে (এর মধ্যে কলকাতার তারা মিউজিক এবং কলকাতা টিভি উল্লেখযোগ্য)। লোক সংগীতের অন্যতম ধারা ভাওয়াইয়া গানের প্রচার এবং প্রসারের লক্ষ্যে শিল্পী রাজা ২০০৮ সালে রাজধানীতে ‘ভাওয়াইয়া’ গানের দল প্রতিষ্ঠা করেন। এ ছাড়াও ২০১১ সালে রাজধানীতে প্রতিষ্ঠা করেন ‘ভাওয়াইয়া স্কুল’। যে স্কুলে ভাওয়াইয়ার ওপর এক বছরের ফ্রি সার্টিফিকেট কোর্স করানো হতো। ২০১৭ সালের ১৭ জানুয়ারি সংস্কৃতির সকল শাখা নিয়ে রাজধানীর পল্লবীতে ‘কলতান সাংস্কৃতিক একাডেমি’ প্রতিষ্ঠা করেন এই শিল্পী। তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘উত্তরের সুর’- এ চারটি মৌলিক ভাওয়াইয়া গান গেয়েছেন। 

শিল্পী জীবনের স্বীকৃতিস্বরূপ রাজা বেঙ্গল ফাউন্ডেশন আয়োজিত বেঙ্গল বিকাশ প্রতিভা অন্বেষণে লোকসঙ্গীত বিভাগে (ভাওয়াইয়া নিয়ে) ২০০৬ সালে শ্রেষ্ঠ শিল্পী নির্বাচিত হয়েছেন। রাজধানীতে রাজার ৬টি একক সঙ্গীতানুষ্ঠান হয়েছে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির উদ্দ্যোগে দুটি, আড়িয়াল সেন্টারের উদ্দ্যোগে একটি, আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের উদ্দ্যোগে একটি, গুরুর চিকিৎসা সহায়তায় ‘ভাওয়াইয়া’ গানের দল- এর আয়োজনে একটি এবং ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টারের আয়োজনে একটি একক সঙ্গীতানুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। 

বেঙ্গল ফাউন্ডেশন থেকে রাজার একটি মিক্সড অ্যালবাম এবং ভায়োলিন মিডিয়া থেকে ২০১১ সালে প্রকাশিত হয়েছে একক ভাওয়াইয়া অ্যালবাম ‘কবর দেখিয়া যান’। সংগীত নিয়ে সফর করেছেন অস্ট্রেলিয়া, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে। তিনি সরকারি ও বেসরকারিভাবে বিভিন্ন রিয়েলিটি শোতে ‘বিচারক’ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।   

 তার গবেষণা, সাধনা ও শিল্প কর্মের মূল উদ্দেশ্যই ছিল নতুন প্রজন্মকে শেকড়মুখী করা। চিলমারীর বন্দরে ঠিক শান্তিনিকেতনের আদলে একটি ভাওয়াইয়া ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন দেখতেন সফিউল আলম রাজা। যেখানে নিয়মিত ভাওয়াইয়ার চর্চা ও গবেষণা হবে। থাকবে ভাওয়াইয়া মিউজিয়াম।

রাজাদের মৃত্যু হয় না। তিনি বেঁচে থাকবেন তার অজস্র শ্রোতা-ভক্তদের হৃদয়ে, শিল্পকর্ম, গান এবং গল্পে। এই গুণী শিল্পীর মৃত্যু ও জন্ম তারিখ ঘিরেও থাকে না ভাওয়াইয়া অঙ্গনে তেমন কোনো আয়োজন। শক্তিধর ভাওয়াইয়ার এই রাজকুমার রাজাকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে এবং ভাওয়াইয়ার প্রচার ও প্রসারে ভাওয়াইয়ার বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠান পালনে সরকারি উদ্যোগের দাবি করেছেন সকল ভাওয়াইয়া প্রেমি।