দীর্ঘদিন পর সিনেমা হলে উপচেপড়া ভিড় দেখা গেল 'পরাণ' ও 'হাওয়া' ছবির কল্যাণে। দুই ছবির টিকিট নিয়েই তৈরি হয় হাহাকার। চলচ্চিত্র দুটির প্রতি দর্শক আগ্রহ ঢাকাই চললচ্চিত্র শিল্প যখন নতুন করে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে ঠিক এই সময়ে মেজবাউর রহমান সুমন পরিচালিত  ‘হাওয়া’র প্রদর্শনী বন্ধের জন্য আইনি নোটিশ দিয়েছেন এক আইনজীবী। সিনেমাটিতে বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন লঙ্ঘনসহ ‘ভায়োলেন্স’ ও ‘অশ্লীলতা’ ছড়ানোর অভিযোগ এনে এই নোটিশ দেওয়া হয়।

কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে এ ঘটনায় চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট কোনো সংগঠনকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবাদ করতে দেখা যায়নি। দেখা যায়নি 'হাওয়া' ছবির পাশে দাঁড়াতেও। তবে চলচ্চিত্রের অনেকেই ব্যক্তিগত পর্যায়ে এর প্রতিবাদ করেছেন। কথা বলেছেন। 

এ ঘটনায় চলচ্চিত্র সংগঠনগুলো নিরব ভূমিকা পালন করলেও সোচ্চার নাটকের শিল্পীদের সংগঠন ‘অভিনয়শিল্পী সংঘ’।  মঙ্গলবার আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছে।

গতকাল সংগঠনটির সভাপতি আহসান হাবীব নাসিম ও সাধারণ সম্পাদক রওনক হাসানের স্বাক্ষরিত একটি বিবৃতিতে এই ঘটনাকে চলচ্চিত্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

বিবৃতিতে বলা হয়, “বাংলাদেশের চলচ্চিত্র যখন কয়েকজন তরুণ, মেধাবী, শিক্ষিত শিল্পী, নির্মাতার হাত ধরে ধ্বংসস্তূপ থেকে আবার নতুনভাবে একটু একটু করে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শুরু করেছে, আবার যখন সিনেমা হলে মানুষের জোয়ার নেমেছে, মানুষ দলে দলে সিনেমা দেখতে আসছে, ঠিক তখনই এ জোয়ার বন্ধ করার ষড়যন্ত্র নিয়ে অশুভ শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে এই অশুভ শক্তি বাংলাদেশের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার জন্য জঘন্যতম তৎপরতা চালিয়ে আসছে। এবার তারা আইনের ধারা উপধারাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে যে ‘হাওয়া’য় পুরো বাংলাদেশ ভাসছে, সেই ‘হাওয়া’কে রুদ্ধ করার ষড়যন্ত্রের নকশা নিয়ে উপস্থিত।

সেখানে আরও বলা হয়, হাওয়া চলচ্চিত্রের সকল রকম প্রদর্শনী বন্ধ করতে হবে। বলা হচ্ছে বন্য প্রাণী আইন লঙ্ঘন হয়েছে। আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। শিল্পী সাহিত্যিক সংস্কৃতি কর্মী মানেই তারা সমাজের সবচেয়ে সচেতন জনগোষ্ঠীর অংশ। আমরা কখনোই আমাদের সমাজ, পরিবেশ ও প্রকৃতি বিরুদ্ধ কোনো কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করি না। বরং সকল প্রকার সমাজ সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডে শিল্পীরাই সর্বাগ্রে সবসময় ভূমিকা পালন করে আসছে। নাটক চলচ্চিত্র নির্মাণে কখনোই শিল্পী নির্মাতারা পশু-পাখি প্রাণী হত্যা ও নির্যাতন করেন না। গল্পের প্রয়োজনেই কখনো কখনো পশু-পাখিদের দেখানো হয়ে থাকে। যা ‘হাওয়া’ চলচ্চিত্রে ঘটেছে।”

হাওয়া ছবিতে পাখি দেখানো বিষয়টি উল্লেখ করে বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘জেলেরা গভীর সমুদ্রে হারিয়ে গেলে পাখি ছেড়ে দিয়ে দেখেন কাছাকাছি কোনো স্থলভূমি আছে কিনা। যা এই চলচ্চিত্রে দেখানো হয়েছে। এটি জীবনেরই অংশ এবং চলচ্চিত্রে ঘোষণাই দেয়া হয়েছে এখানে কোনো বন্য প্রাণীর ক্ষতিসাধন করা হয়নি। জন্মলগ্ন থেকে আমরা বিভিন্ন নাটক চলচ্চিত্রে দেখে আসছি এমন কতো দৃশ্য সেগুলো নিয়ে আপত্তি উঠলো না কেন!’

পাখি দেখানোর ঘটা এবারই প্রথম নয় এর আগেও এমন দৃশ্য দেখানো হয়েছে। উদাহরণ টেনে বিবৃতিতে বলা হয়, “সরকার নিয়ন্ত্রিত বাংলাদেশ টেলিভিশন প্রযোজিত ভীষণ জনপ্রিয় নাটক ‘বহুব্রীহি’র সেই খাঁচায় বন্দী টিয়া পাখির ‘তুই রাজাকার’ সংলাপ এখনো আমাদের স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে। এমন হাজারও ঘটনায় কর্তৃপক্ষ তখন কোথায় ছিলো? এ ঘটনায় চলচ্চিত্রের প্রযোজক, পরিচালককে ডেকে কথা বলা যেতো। আইন লঙ্ঘন হয়ে থাকলে কীভাবে তা শোধরানো যায় সেই আলোচনা ও পদক্ষেপ নেয়া যেতো। তা না করে ২০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ মামলা, চলচ্চিত্র প্রদর্শনী বন্ধের জন্য আইনি তলব এসবই আমাদের শিল্প সংস্কৃতির কণ্ঠ রুদ্ধ করার, শিল্প সাহিত্য চর্চাকে নিরুৎসাহিত করার ষড়যন্ত্র হিসেবেই আমরা দেখছি।

কিছুদিন আগে নাট্যনির্মাতা অনন্য ইমনের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ এনে ১৫ কোটি টাকার মামলা করা হয়। সে কথা উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “নাট্য নির্মাতা অনন্য ইমন এর বিরুদ্ধে ১৫ কোটি টাকার মামলা, মেজবাউর রহমান সুমন এর বিরুদ্ধে ২০ কোটি টাকার মামলা ও ‘হাওয়া’ সিনেমা প্রদর্শনী বন্ধের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আমরা তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাচ্ছি। আমাদের সংস্কৃতি চর্চার পথকে রুদ্ধ করার সকল অপচেষ্টাকে রুখে দেবার জন্য আমরাও বদ্ধ পরিকর।