মানবদেহে ঘাড় বা গলার সামনে নিচের দিকে প্রজাপতি আকৃতির গ্লান্ড বা গ্রন্থির নামই থাইরয়েড। মানুষের বৃদ্ধি, বিকাশ, শারীরবৃত্তিক ও বিপাকীয় নানা ক্রিয়া-প্রক্রিয়া সাধন করার জন্য এই গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত থাইরয়েড হরমোন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। স্বাভাবিক অবস্থায় গলার শ্বাসনালির সামনে থাকা থাইরয়েড গ্লান্ডটি খালি চোখে দেখা যায় না। যখন থাইরয়েড গ্লান্ড ফুলে যায় তখন গলার সামনে মাঝবরাবর ঢোক গেলার সঙ্গে গ্লান্ডটিকে উপর-নিচ ওঠানামা করতে দেখা যায়।

থাইরয়েড গ্রন্থি আকারে বড় হয়ে গলার অগ্রভাগে ফোলাভাব দেখা গেলে একে গলগণ্ড বলে। এর কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- আয়োডিনের অভাব, গ্রেভস ডিজিজ, থাইরয়েডের সংক্রমণ, থাইরয়েডের টিউমার ইত্যাদি। তবে গলগণ্ড থাকার মানেই এই নয়- থাইরয়েড গ্রন্থি খারাপ বা এটি অপারেশন করে কেটে ফেলতে হবে। অনেকেই গলা ফোলা থাকলেই ক্যান্সার বা টিউমারের ভয় করেন; সব গলগণ্ডই খারাপ নয়।

গলগণ্ড হলে কী করবেন

গলগণ্ডের লক্ষণ দেখা দিলে নাক কান গলা রোগ বিশেষজ্ঞ সার্জনকে দিয়ে গলা পরীক্ষা করাবেন। প্রয়োজন ও সম্ভাব্য রোগের ধরন অনুযায়ী থাইরয়েড ফাংশন টেস্ট, অর্থাৎ রক্তের টিএসএইচ, ফ্রি-টিফোর, ফ্রি-টিথ্রি হরমোনসহ অন্যান্য পরীক্ষা করাতে হবে। পাশাপাশি থাইরয়েডের আলট্রাসনোগ্রাফি দিয়ে থাকেন চিকিৎসকরা। এই প্রক্রিয়াটি থাইরয়েড গ্রন্থির চিত্র তৈরি করতে উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সির শব্দ তৈরি করে। এটি থাইরয়েড নডিউল সম্পর্কিত তথ্য সরবরাহ করে এবং আপনার ডাক্তারকে চিকিৎসার সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করে।

এ ছাড়া শরীরের যে কোনো জায়গায় টিউমারের মতো গলগণ্ডের ক্ষেত্রেও এফএনএসি পরীক্ষা করাতে দেওয়া হয়, যার মাধ্যমে ক্যান্সার হয়েছে কিনা ধারণা পাওয়া যায়। পুরো কথা হলো, ফাইন নিড্‌ল অ্যাসপিরেশন সাইটোলজি। অর্থাৎ, কোনো টিউমার থেকে সুচের সাহায্যে রস বের করে পরীক্ষা করা হয়। টিউমারে কোনো ক্যান্সার কোষ আছে কিনা, তা বোঝার জন্য এফএনএসি টেস্ট করতে হয়।

কখন অপারেশনের প্রয়োজন হয়

রোগীর লক্ষণ, গলগণ্ডের আকার এবং এর কারণের ওপর চিকিৎসার প্রয়োজন ও ধরন নির্ভর করে। আকারে ছোট, চোখে পড়ে না এমন উপসর্গহীন নিরীহ ধরনের (ক্যান্সার নয়) গলগণ্ডের সাধারণত কোনো চিকিৎসার দরকার হয় না। সাধারণত নিল্ফেম্নাক্ত কারণ বা উপসর্গ পরিলক্ষিত হলে নাক কান গলা রোগ বিশেষজ্ঞ এবং হেড-নেক সার্জনরা বিভিন্ন ধরনের থাইরয়েড সার্জারির পরামর্শ দিয়ে থাকেন। যেমন-

- যদি অনেক বড় আকারের গলগণ্ড বা থাইরয়েড নডিউল থাকে যা গ্ল্যান্ডের পেছনে থাকা শ্বাসনালি, খাদ্যনালি, গলার স্নায়ু বা রক্তনালির ওপর চাপ প্রয়োগ করে, ফলে ঘাড়ের সামনে অস্বস্তিকর অনুভূতি, মাঝেমধ্যে শ্বাসকষ্ট, খাবার গিলতে অসুবিধা, কণ্ঠস্বর পরিবর্তন বা অন্যান্য সমস্যার সৃষ্টি করে থাকে।

-বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষায় থাইরয়েডের ক্যান্সার ধরা পড়লে বা সন্দেহ হলে সার্জারির প্রয়োজন পড়তে পারে। কারণ, থাইরয়েড ক্যান্সারের ক্ষেত্রে অপারেশনের কোনো বিকল্প নেই।

-থাইরয়েড গ্লান্ড বড় হয়ে (বিনাইন বা নিরীহ টিউমার) যদি আপনার জীবনযাত্রার স্বাভাবিকতাকে ব্যাহত করে।

-যদি রোগী গলগণ্ডকে সৌন্দর্যহানির কারণ বলে মনে করেন। বেশি বড় হয়ে দেখতে যদি কুৎসিত বা অসুন্দর লাগে সে ক্ষেত্রে সার্জারির প্রয়োজন হয়।

- রোগী যদি ক্যান্সারের ধারণা করে ভীত হয়ে থাকেন, তাহলে চিকিৎসকরা অপারেশনের পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

তাই গলার সামনের দিকে ফোলাভাব দেখা দিলে অথবা গলগণ্ড হয়েছে বলে মনে করলে আতঙ্কিত না হয়ে দ্রুত একজন নাক কান গলা রোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হবেন। অপারেশনের প্রয়োজন হলে আপনার চিকিৎসকের কাছ থেকে অপারেশন সম্পর্কিত সব বিষয় এবং ক্ষেত্রবিশেষ অপারেশন-পরবর্তী করণীয় জেনে নেবেন অবশ্যই।

অপারেশনের ফলে কী জটিলতা হতে পারে

থাইরয়েড গ্রন্থির পেছনে প্যারাথাইরয়েড নামে দুই জোড়া গ্রন্থি থাকে। যেই গ্রন্থির গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো, আমাদের শরীরে ক্যালসিয়ামের পরিমাণ স্বাভাবিক রাখা। পুরো থাইরয়েড গ্রন্থি কোনো কারণে কেটে ফেলার সময় প্যারাথাইরয়েড গ্রন্থি হঠাৎ অস্ত্রোপচারের সময় ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যদিও বর্তমান আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের যুগে খুব কম দেখা যায় এ ধরনের জটিলতা। পাশাপাশি অস্ত্রোপচারের আরেকটি জটিলতা হয় কোনো কোনো ক্ষেত্রে, যা ১ থেকে ২ শতাংশ। সেটা হলো, একটি নার্ভ বা স্নায়ু থাকে, এটি আঘাত করলে বা কোনো কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হলে রোগীর কণ্ঠস্বর বসে যায়। তবে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। সার্জনরা এ ব্যাপারে আগে থেকেই সতর্ক থাকার কারণে এই জটিলতাগুলো সাধারণত খুব কম ক্ষেত্রেই দেখা যায়।
আমাদের দেশে দেখা যায়, এখনও অনেকেই গলগণ্ডের ব্যাপারটায় বেশ অনীহা প্রকাশ করেন এবং এর জন্য রোগী ও তাঁর পরিবারকে শেষ পর্যন্ত যথেষ্ট ভোগান্তি পোহাতে হয়। তাই সচেতন থাকি, সুস্থ থাকি।

 [নাক কান গলা রোগ বিশেষজ্ঞ সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ]