![গাজী মাজহারুল আনোয়ার [জন্ম :২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩; মৃত্যু : ৪ সেপ্টেম্বর ২০২২]](https://samakal.com/uploads/2022/09/online/photos/Untitled-24-samakal-63162e3c0acc7.jpg)
গাজী মাজহারুল আনোয়ার [জন্ম :২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩; মৃত্যু : ৪ সেপ্টেম্বর ২০২২]
গাজী মাজহারুল আনোয়ারকে নিয়ে প্রয়াত সুরকার সত্য সাহার কাছে শুনেছিলাম চমৎকার একটি গল্প। ১৯৬৪ সালে 'সুতরাং' ছবিতে সত্য সাহার সুর করা গানগুলো 'হিট' হওয়ায় চলচ্চিত্র নির্মাতাদের কাছে তাঁর কদর বেড়ে যায়। প্রচুর কাজ আসতে থাকে। ব্যস্ত থাকতেন ভীষণ। পুরান ঢাকার র্যাংকিন স্ট্রিটে কোনো এক রোববার (তখন সাপ্তাহিক ছুটি) সকালে বাসায় বসে একটি গানের সুর করছিলেন। এমন সময় কলিংবেল বেজে ওঠে। গৃহকর্মী একটু পরে এসে বলে- একটি ছেলে দেখা করতে চায়। তিনি একটু বিরক্ত- সাত সকালে কে আবার এলো!
হারমোনিয়াম থেকে মুখ তুলে দেখেন কাঁচা বয়সের একটি ছেলে দাঁড়িয়ে, হাতে দুটি খাতা। না বসেই বলল- 'আমি গান লিখি। কয়েকটা গান এনেছি আপনার জন্য। পছন্দ হলে সুর করতে পারেন।' সত্য সাহা মনে মনে বলেন- 'হাতি-ঘোড়া গেল তল...!' তবে মুখে কিছুই বললেন না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও খাতাগুলো টেনে নিয়ে পাতা উল্টাতে থাকেন। কয়েকটি গানের বাণী পড়ে মনে হলো, নির্ঘাত প্রতিষ্ঠিত কোনো গীতিকারের গান 'মেরে' দিয়েছে! কথাগুলো ছেলেটার মুখের ওপরে বলেও ফেলেন ভদ্রতার মাথা খেয়ে। ছেলেটি বেশ আহত। তবে দৃঢতার সঙ্গে বলল- 'না, আমি কারও গান নিইনি। এগুলো সব আমার লেখা।' সত্য সাহা চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেন- যদি তক্ষুনি একটা গানের কয়েকটা লাইন লিখে দিতে পারে এবং সেগুলো যদি পছন্দ হয় তাহলে তিনি তাঁর গানে সুর করবেন। ছেলেটি চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে ডাইনিং টেবিলে বসে পড়ল। ছেলেটির জন্য এক কাপ চা দিতে বলে সত্য সাহা আবার হারমোনিয়াম টেনে নেন।
১০-১৫ মিনিট পর ছেলেটি নতুন লেখা গানের কাগজ এগিয়ে দেয় সত্য সাহার দিকে। কাগজটি হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করেন- 'চা খেয়েছ?' ছেলেটি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। অভিমান করেছে!
কাগজে লেখা গানের বাণী পড়ে সত্য সাহার চোখ উঠে গেল কপালে! ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে ছেলেটি লিখেছে- 'আকাশের হাতে আছে এক রাশ নীল, বাতাসের আছে কিছু গন্ধ/ রাত্রির গায়ে জ্বলে জোনাকি, তটিনীর বুকে মৃদু ছন্দ'! তিনি লাফ দিয়ে ওঠেন গানের কথায়। স্ত্রীকে বলেন- 'শোনো, এই ছেলের জন্য রান্না করো। ও আজ আমাদের সঙ্গেই দুপুরে খাবে।' আর ছেলেটিকে বলেন- 'গানটি কমপ্লিট করে ফেলো। আজই আমি সুর করব।' সেই গানটিই ব্যবহূত হলো সুভাষ দত্ত পরিচালিত 'আয়না ও অবশিষ্ট' ছবিতে। আর সেদিনের সেই ছেলেটিই পরবর্তীকালের ধ্বজাধারী গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার!
সত্যদার মুখে গল্পটি শুনেছিলাম সম্ভবত আশির দশকের শেষ ভাগে! এর মাঝে সত্য সাহাও (জন্ম ২৫ ডিসেম্বর, ১৯৩৪; মৃত্যু ২৭ জানুয়ারি, ১৯৯৯) বিদায় নিয়েছেন আমাদের মাঝ থেকে। বিদায় নিয়েছেন 'আয়না ও অবশিষ্ট' ছবির পরিচালক সুভাষ দত্ত (জন্ম ৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩০; মৃত্যু ১৬ নভেম্বর, ২০১২)। আর রোববার (৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২) বিদায় নিলেন সেই গল্পের নায়ক কিংবদন্তিসম গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার। তাঁর জেদ, গানের প্রতি ভালোবাসা আর 'ওনারশিপ' গাজী মাজহারুল আনোয়ারকে তাঁর সময়ে শীর্ষ অবস্থানে অধিষ্ঠিত করেছে।
গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা গানের সঠিক সংখ্যা আমার জানা নেই। তাঁর একটি সাক্ষাৎকারে জেনেছিলাম- এই সংখ্যা ২০ হাজার! তবে 'কাল' অতিক্রম করার জন্য একজন গীতিকারের গানের 'সংখ্যা' যতটা না প্রয়োজন, তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন গানের গুণমান! গাজী মাজহারুল আনোয়ার সেই গুণমানের জায়গাতেও জিতে গেছেন দক্ষতার সঙ্গে। তাঁর লেখা অসংখ্য মানসম্পন্ন গানের কথা চাইলে উল্লেখ করা যায় এক্ষুনি; কিন্তু কাগজের কলেবর তো সেই সুযোগ দেবে না।
অনেকের মতে, গাজী মাজহারুল আনোয়ারের শ্রেষ্ঠ গান- 'জয় বাংলা বাংলার জয়'। গানটি মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে 'সূচনা সংগীত' হিসেবে পরিবেশিত হতো। পাকিস্তানি শাসকদের শোষণ-নির্যাতনে বাংলা নামের এই জনপদে সাধারণ মানুষের যে নিদারুণ দুর্গতি, তারই চিত্ররূপ ফুটে উঠেছিল এই কালজয়ী গানে। আনোয়ার পারভেজের হাতে সুরটাও হয়েছিল যথাযথ।
'আকাশের হাতে আছে এক রাশ নীল' গানটি প্রথম যখন শুনি ১৯৬৫ কিংবা '৬৬ সালে, তখন আমি ক্লাস ফাইভ-সিক্সে পড়ি। আজ আমার বয়সও ৭০ ছুঁই ছুঁই। এই বয়সে এসেও আমি এ গান আজও মুগ্ধ হয়ে শুনি; রোমাঞ্চিত হই; স্মৃতিকাতরতায় ভুগি!
গাজী মাজহারুল আনোয়ারের গানে এসেছে মুক্তিযুদ্ধ, দেশপ্রেম, প্রকৃতি, জীবনবোধ, প্রেম, বিরহ আর মানুষের মায়া-মমতার কথা। আগেই বলেছি তাঁর গানের গুণমানের উচ্চতার কথা। কয়েক বছর আগে 'বিবিসি বাংলা' একটা জরিপ করেছিল বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বাংলা গান নিয়ে। সেই তালিকায় গাজী মাজহারুল আনোয়ারের তিনটি গান স্থান পেয়েছে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের মানুষের ভোটে- জয় বাংলা বাংলার জয়, একতারা তুই দেশের কথা, একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়।
গাজী মাজহারুল আনোয়ারের অনেক কালজয়ী গান আছে, যেগুলো সেই ষাটের দশক থেকে আজ পর্যন্ত শ্রোতাদের মুখে মুখে ফিরছে। 'চোখ যে মনের কথা বলে', 'তুমি কখন এসে দাঁড়িয়ে আছো', 'নীল আকাশের নীচে আমি', 'প্রেম যেন মোর গোধূলিবেলার', 'অনেক সাধের ময়না আমার', 'আমি নিজের মনে নিজেই যেন', 'আছেন আমার মোক্তার', 'এই পৃথিবীর 'পরে', 'সবাই বলে বয়স বাড়ে', 'তুমি আরেকবার আসিয়া', 'গীতিময় সেই দিন', 'মনের রঙে রাঙাব', 'গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে', 'অশ্রু দিয়ে লেখা এ গান'- এ রকম অসংখ্য গানের কথা উল্লেখ করা যায়। এ গানগুলো আজও যে কোনো বয়সের মানুষকে আন্দোলিত করে; স্মৃতিকাতরতায় ভারাক্রান্ত করে তোলে।
গাজী মাজহারুল আনোয়ার সরাসরি দলীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিলেন। আমার উপস্থাপিত একটি টিভি অনুষ্ঠানে (মাই টিভি) তিনি বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁর আনুগত্য ও ভালোবাসার কথা বলে আবেগ প্রকাশ করেছিলেন। পাশাপাশি তিনি বিএনপির রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। গাজী মাজহারুল আনোয়ার গানের জন্য জাতীয় এবং সরকারি-বেসরকারি শতাধিক পুরস্কার পেয়েছেন। তিনিই বাংলাদেশের ব্যতিক্রমী প্রতিভাবানদের একজন, যিনি রাষ্ট্রের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ একুশে পদক পেয়েছেন খালেদা জিয়া সরকারের আমলে (২০০২ সালে) আর রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মান স্বাধীনতা পদক লাভ করেছেন শেখ হাসিনা সরকারের আমলে (২০২১ সালে)। তিনি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও আওয়ামী লীগ সরকার তাঁকে সম্মানিত করতে দ্বিধা করেনি!
গাজী মাজহারুল আনোয়ারের বিদায়ের মধ্য দিয়ে ষাটের দশকের গীতিকারদের সবাই (সম্ভবত) বিদায় নিলেন! সৈয়দ শামসুল হক, ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল, ড. মনিরুজ্জামান, নয়ীম গহর, ফজল-এ-খোদার মতো ষাটের দশকের গীতিকবিরা বিদায় নিয়েছেন তো আরও আগে! সব শেষে চলে গেলেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার। তাঁদের শূন্যতা কখনও পূরণ হওয়ার নয়। গাজী মাজহারুল আনোয়ার- না ফেরার দেশে আপনি ভালো থাকুন হে গুণী। বিদায়।
কাওসার চৌধুরী: প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা ও অভিনেতা
হারমোনিয়াম থেকে মুখ তুলে দেখেন কাঁচা বয়সের একটি ছেলে দাঁড়িয়ে, হাতে দুটি খাতা। না বসেই বলল- 'আমি গান লিখি। কয়েকটা গান এনেছি আপনার জন্য। পছন্দ হলে সুর করতে পারেন।' সত্য সাহা মনে মনে বলেন- 'হাতি-ঘোড়া গেল তল...!' তবে মুখে কিছুই বললেন না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও খাতাগুলো টেনে নিয়ে পাতা উল্টাতে থাকেন। কয়েকটি গানের বাণী পড়ে মনে হলো, নির্ঘাত প্রতিষ্ঠিত কোনো গীতিকারের গান 'মেরে' দিয়েছে! কথাগুলো ছেলেটার মুখের ওপরে বলেও ফেলেন ভদ্রতার মাথা খেয়ে। ছেলেটি বেশ আহত। তবে দৃঢতার সঙ্গে বলল- 'না, আমি কারও গান নিইনি। এগুলো সব আমার লেখা।' সত্য সাহা চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেন- যদি তক্ষুনি একটা গানের কয়েকটা লাইন লিখে দিতে পারে এবং সেগুলো যদি পছন্দ হয় তাহলে তিনি তাঁর গানে সুর করবেন। ছেলেটি চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে ডাইনিং টেবিলে বসে পড়ল। ছেলেটির জন্য এক কাপ চা দিতে বলে সত্য সাহা আবার হারমোনিয়াম টেনে নেন।
১০-১৫ মিনিট পর ছেলেটি নতুন লেখা গানের কাগজ এগিয়ে দেয় সত্য সাহার দিকে। কাগজটি হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করেন- 'চা খেয়েছ?' ছেলেটি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। অভিমান করেছে!
কাগজে লেখা গানের বাণী পড়ে সত্য সাহার চোখ উঠে গেল কপালে! ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে ছেলেটি লিখেছে- 'আকাশের হাতে আছে এক রাশ নীল, বাতাসের আছে কিছু গন্ধ/ রাত্রির গায়ে জ্বলে জোনাকি, তটিনীর বুকে মৃদু ছন্দ'! তিনি লাফ দিয়ে ওঠেন গানের কথায়। স্ত্রীকে বলেন- 'শোনো, এই ছেলের জন্য রান্না করো। ও আজ আমাদের সঙ্গেই দুপুরে খাবে।' আর ছেলেটিকে বলেন- 'গানটি কমপ্লিট করে ফেলো। আজই আমি সুর করব।' সেই গানটিই ব্যবহূত হলো সুভাষ দত্ত পরিচালিত 'আয়না ও অবশিষ্ট' ছবিতে। আর সেদিনের সেই ছেলেটিই পরবর্তীকালের ধ্বজাধারী গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার!
সত্যদার মুখে গল্পটি শুনেছিলাম সম্ভবত আশির দশকের শেষ ভাগে! এর মাঝে সত্য সাহাও (জন্ম ২৫ ডিসেম্বর, ১৯৩৪; মৃত্যু ২৭ জানুয়ারি, ১৯৯৯) বিদায় নিয়েছেন আমাদের মাঝ থেকে। বিদায় নিয়েছেন 'আয়না ও অবশিষ্ট' ছবির পরিচালক সুভাষ দত্ত (জন্ম ৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩০; মৃত্যু ১৬ নভেম্বর, ২০১২)। আর রোববার (৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২) বিদায় নিলেন সেই গল্পের নায়ক কিংবদন্তিসম গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার। তাঁর জেদ, গানের প্রতি ভালোবাসা আর 'ওনারশিপ' গাজী মাজহারুল আনোয়ারকে তাঁর সময়ে শীর্ষ অবস্থানে অধিষ্ঠিত করেছে।
গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা গানের সঠিক সংখ্যা আমার জানা নেই। তাঁর একটি সাক্ষাৎকারে জেনেছিলাম- এই সংখ্যা ২০ হাজার! তবে 'কাল' অতিক্রম করার জন্য একজন গীতিকারের গানের 'সংখ্যা' যতটা না প্রয়োজন, তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন গানের গুণমান! গাজী মাজহারুল আনোয়ার সেই গুণমানের জায়গাতেও জিতে গেছেন দক্ষতার সঙ্গে। তাঁর লেখা অসংখ্য মানসম্পন্ন গানের কথা চাইলে উল্লেখ করা যায় এক্ষুনি; কিন্তু কাগজের কলেবর তো সেই সুযোগ দেবে না।
অনেকের মতে, গাজী মাজহারুল আনোয়ারের শ্রেষ্ঠ গান- 'জয় বাংলা বাংলার জয়'। গানটি মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে 'সূচনা সংগীত' হিসেবে পরিবেশিত হতো। পাকিস্তানি শাসকদের শোষণ-নির্যাতনে বাংলা নামের এই জনপদে সাধারণ মানুষের যে নিদারুণ দুর্গতি, তারই চিত্ররূপ ফুটে উঠেছিল এই কালজয়ী গানে। আনোয়ার পারভেজের হাতে সুরটাও হয়েছিল যথাযথ।
'আকাশের হাতে আছে এক রাশ নীল' গানটি প্রথম যখন শুনি ১৯৬৫ কিংবা '৬৬ সালে, তখন আমি ক্লাস ফাইভ-সিক্সে পড়ি। আজ আমার বয়সও ৭০ ছুঁই ছুঁই। এই বয়সে এসেও আমি এ গান আজও মুগ্ধ হয়ে শুনি; রোমাঞ্চিত হই; স্মৃতিকাতরতায় ভুগি!
গাজী মাজহারুল আনোয়ারের গানে এসেছে মুক্তিযুদ্ধ, দেশপ্রেম, প্রকৃতি, জীবনবোধ, প্রেম, বিরহ আর মানুষের মায়া-মমতার কথা। আগেই বলেছি তাঁর গানের গুণমানের উচ্চতার কথা। কয়েক বছর আগে 'বিবিসি বাংলা' একটা জরিপ করেছিল বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বাংলা গান নিয়ে। সেই তালিকায় গাজী মাজহারুল আনোয়ারের তিনটি গান স্থান পেয়েছে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের মানুষের ভোটে- জয় বাংলা বাংলার জয়, একতারা তুই দেশের কথা, একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়।
গাজী মাজহারুল আনোয়ারের অনেক কালজয়ী গান আছে, যেগুলো সেই ষাটের দশক থেকে আজ পর্যন্ত শ্রোতাদের মুখে মুখে ফিরছে। 'চোখ যে মনের কথা বলে', 'তুমি কখন এসে দাঁড়িয়ে আছো', 'নীল আকাশের নীচে আমি', 'প্রেম যেন মোর গোধূলিবেলার', 'অনেক সাধের ময়না আমার', 'আমি নিজের মনে নিজেই যেন', 'আছেন আমার মোক্তার', 'এই পৃথিবীর 'পরে', 'সবাই বলে বয়স বাড়ে', 'তুমি আরেকবার আসিয়া', 'গীতিময় সেই দিন', 'মনের রঙে রাঙাব', 'গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে', 'অশ্রু দিয়ে লেখা এ গান'- এ রকম অসংখ্য গানের কথা উল্লেখ করা যায়। এ গানগুলো আজও যে কোনো বয়সের মানুষকে আন্দোলিত করে; স্মৃতিকাতরতায় ভারাক্রান্ত করে তোলে।
গাজী মাজহারুল আনোয়ার সরাসরি দলীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিলেন। আমার উপস্থাপিত একটি টিভি অনুষ্ঠানে (মাই টিভি) তিনি বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁর আনুগত্য ও ভালোবাসার কথা বলে আবেগ প্রকাশ করেছিলেন। পাশাপাশি তিনি বিএনপির রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। গাজী মাজহারুল আনোয়ার গানের জন্য জাতীয় এবং সরকারি-বেসরকারি শতাধিক পুরস্কার পেয়েছেন। তিনিই বাংলাদেশের ব্যতিক্রমী প্রতিভাবানদের একজন, যিনি রাষ্ট্রের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ একুশে পদক পেয়েছেন খালেদা জিয়া সরকারের আমলে (২০০২ সালে) আর রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মান স্বাধীনতা পদক লাভ করেছেন শেখ হাসিনা সরকারের আমলে (২০২১ সালে)। তিনি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও আওয়ামী লীগ সরকার তাঁকে সম্মানিত করতে দ্বিধা করেনি!
গাজী মাজহারুল আনোয়ারের বিদায়ের মধ্য দিয়ে ষাটের দশকের গীতিকারদের সবাই (সম্ভবত) বিদায় নিলেন! সৈয়দ শামসুল হক, ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল, ড. মনিরুজ্জামান, নয়ীম গহর, ফজল-এ-খোদার মতো ষাটের দশকের গীতিকবিরা বিদায় নিয়েছেন তো আরও আগে! সব শেষে চলে গেলেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার। তাঁদের শূন্যতা কখনও পূরণ হওয়ার নয়। গাজী মাজহারুল আনোয়ার- না ফেরার দেশে আপনি ভালো থাকুন হে গুণী। বিদায়।
কাওসার চৌধুরী: প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা ও অভিনেতা
মন্তব্য করুন