তিনি মঞ্চে পা রাখতেই বদলে গেল দৃশ্যপট। মিলনায়তনভর্তি দর্শকের গুঞ্জন রূপ নিল উচ্ছ্বাসে। কথার মায়ায় বাঁধলেন সবাইকে। বাংলা গানের জনপ্রিয় শিল্পী কবীর সুমন টুকরো টুকরো কথা, ফেলে আসা সময়ের স্মৃতিচারণ আর গানে গানে সম্মোহিত করে রাখলেন দর্শক-শ্রোতাদের।

শনিবার বিকেলে ঢাকার রমনার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে 'সুমনের গানের' অনুষ্ঠানটি শুরুর আগেই তাঁর ভক্তরা হাজির মিলনায়তনে। তিনি মঞ্চে উঠলেন প্রায় সাড়ে ৫টায়। মিলনায়তন তখন কানায় কানায় পরিপূর্ণ। দাঁড়িয়ে দর্শকদের অভিবাদন গ্রহণ করলেন। তুমুল করতালির মধ্যে বসলেন তাঁর আসনে। শুরুতেই এ দেশ নিয়ে ভালো লাগার বিষয়টি জানান ভক্তদের। তিনি বলেন, আমি ভারতের মানুষ; কিন্তু আমার ভাষা বাংলা, যা এ দেশের রাষ্ট্রভাষা। তাই বাঙালিদের মাঝে বসে বাংলা গান শোনাতে পারা অন্য রকম আনন্দের। বললেন আমি আরেকবার বাংলাদেশে আসব। তবে সেবার কোনো টাকা নেব না। দায় থেকে গাইব। আমার গান শোনানোর দায়।

অনুষ্ঠানের মাঝে হঠাৎ অসুস্থবোধ করলে একটু বিরতি নেন তিনি। ওই সময় ইনহেলার হাতে নিয়েই বলে ওঠেন, 'আমি এমন ভাগ্য নিয়ে জন্মাইনি যে বাংলাদেশে মরব।' সাময়িক খারাপ লাগা কেটে গেলে ১৫ মিনিট বিরতি নিয়ে আবার গান গাওয়া শুরু করেন। গানের মাঝে মাঝে গল্পে মাতিয়ে রাখেন দর্শকদের।

কবীর সুমনের কণ্ঠের মাদকতা এখনও ফুরায়নি। বয়স ৭৩ বছর। কিন্তু নন্দিত এই শিল্পীর কাছে এটা শুধুই একটা সংখ্যা। তার প্রমাণ আরও একবার পাওয়া গেল। বয়সের জড়তাকে তুচ্ছ করেই মঞ্চে উঠেছিলেন তিনি। একে একে শুনিয়েছেন কালজয়ী বেশ কিছু গান। অথচ তাঁর সংগীতসন্ধ্যা অনুষ্ঠিত হবে কিনা, তা নিয়ে সংশয়ে ছিলেন অনেকে। কারণ, নন্দিত এই শিল্পীর কালজয়ী গান 'তোমাকে চাই'-এর ৩০ বছর উদযাপন হওয়ার কথা ছিল জাতীয় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তনে। এটি দেশের অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হওয়ায় সেখানে গানের অনুষ্ঠানের অনুমতি দেয়নি ঢাকা মহানগর পুলিশ।

এদিকে, তিন দিনের আয়োজনের সব টিকিট বিক্রি করে ফেলেছে আয়োজক পিপহোল। যেসব দর্শক-শ্রোতা টিকিট সংগ্রহ করেছেন, তাঁরা কবীর সুমনের গান শোনার সুযোগ পাবেন কিনা, তা নিয়েই ছিল সংশয়। অবশেষে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে ভেন্যু বদল করে দর্শক-শ্রোতার আকাঙ্ক্ষা পূরণ করল আয়োজক প্রতিষ্ঠান।

ফলে সব দ্বিধা-সংকোচ দূরে ঠেলে কবীর সুমনও সুরের খেয়ায় ভাসালেন হলভর্তি দর্শককে। অনবদ্য পরিবেশনায় দুই ঘণ্টারও বেশি সময় মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখলেন সংগীতপ্রেমীদের।

এখন তিনি গিটার বাজাতে পারেন না। তাই বন্ধু ধ্রুব বসু রায় তাঁর গানের সঙ্গে গিটার বাজান। ধ্রুবর পাশাপাশি এদিন তাঁর সঙ্গে যাঁরা বাদ্যযন্ত্র বাজিয়েছেন, সেই রাকা ভট্টাচার্য, ইন্দ্রজিৎ প্রধান ও বিশ্বজিৎ রায়কে পরিচয় করিয়ে দেন তিনি। এরপর চিরচেনা কণ্ঠে একে একে তুলে আনতে থাকেন তাঁর নানা স্বাদের গান। শুরু করেন 'একেকটা দিন' গান নিয়ে। এরপর 'রেখবের রূপ' গানটি গাওয়ার পর বিরতি টানতে শুরু করেন স্মৃতিচারণ। বলে যান ওস্তাদ আয়ান রশীদ খানের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতার কথা। জানান, কীভাবে আয়ান রশীদ খানের অনুরোধে গানে গানে শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন ওস্তাদ আমির খানকে। এই কিংবদন্তির ললিত সংগীতে উজ্জীবিত হয়ে কণ্ঠে তুলে নিয়েছিলেন 'জাগে জাগে রাত' গানটি। সেই গল্প শেষ হতে না হতেই কবীর সুমন তাঁর পরিবেশনার তৃতীয় গান গাইতে শুরু করেন 'জাগে জাগে রাত...'।

বাঙালির হৃদয়ে রবিঠাকুর কতটা জায়গা করে নিয়েছেন- তা ভালোভাবেই জানা আছে কবীর সুমনের। যে জন্য চতুর্থ গান হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন 'পুরোনো সেই দিনের কথা' গানটি। কালজয়ী এই রবীন্দ্রসংগীত তিনি একাই গাননি; বরং একই সঙ্গে গেয়েছেন হলভর্তি দর্শক। এরপর 'হাল ছেড়ো না বন্ধু', 'তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা', 'যদি ভাবো কিনছো আমায়'সহ জনপ্রিয় আরও বেশ কিছু গান শুনিয়ে শ্রোতার বহুদিনের তৃষিত হৃদয় সিক্ত করেছেন তিনি। আয়োজন শেষে দর্শকও ফিরেছেন একরাশ ভালো লাগা নিয়ে।

গতকাল কবীর সুমনের মনোমুগ্ধকর পরিবেশনা থেকে যাঁরা বঞ্চিত হয়েছেন, তাঁদের জন্য সুযোগ আছে আরও দুটি আয়োজনে এই শিল্পীর গান শোনার। আয়োজকরা জানান, এই ভেন্যুতে ১৮ অক্টোবর আধুনিক বাংলা খেয়াল শোনাবেন উপমহাদেশের নন্দিত এই শিল্পী। এরপর ২১ অক্টোবর আবারও তাঁর কণ্ঠে শোনা যাবে আধুনিক বাংলা গান। তিন দিনের এই তিন আয়োজন দিয়েই উদযাপিত হবে তাঁর সুর ও বাণীর প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম 'তোমাকে চাই'-এর ৩০ বছর পূর্তি।