কোনো অপরাধের ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তি নিশ্চিত করার পূর্বশর্ত হলো, সুচারুভাবে তদন্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা। একই সঙ্গে নির্ভুল তথ্যসংবলিত মামলা দায়ের করাও জরুরি। তবে প্রায়ই দেখা যায়, কোনো অভিযোগ দায়েরের পর গ্রহণযোগ্য তথ্য-উপাত্ত ছাড়া সন্দেহবশত অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়। এর পর জিজ্ঞাসাবাদ করতে রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। মামলার তদন্ত চলাকালেও অভিযুক্তদের ছবিসহ প্রতিবেদন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র ফারদিন নূর পরশ হত্যাকাণ্ডের পর তাঁর বান্ধবী আমাতুল্লাহ বুশরাসহ অজ্ঞাতপরিচয় আরও কয়েকজনকে আসামি করে মামলা হয়। রামপুরা থানায় দায়ের ওই মামলার বাদী হলেন ফারদিনের বাবা। এরই মধ্যে ওই মামলায় বুশরাকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে মামলার তদন্ত সংস্থা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। বুশরার পরিবারসহ অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, ফারদিনের সঙ্গে পূর্বপরিচয় থাকলেও এই হত্যায় তাঁর সংশ্নিষ্টতা নেই। সন্দেহ করার মতো কোনো উপযুক্ত কারণ ছাড়াই তাঁকে আসামি করা হয়েছে। শুধু এই ঘটনা নয়, এর আগেও বিভিন্ন চাঞ্চল্যকর ঘটনায় তদন্তের আগেই সন্দেহভাজন হিসেবে অনেকের নাম-পরিচয় সামনে চলে এসেছিল। পরে দেখা গেছে, তাঁরা ওই ঘটনায় সংশ্নিষ্ট নন। কেউ কেউ বলছেন, ভুল জনমতের চাপেও অনেক সময় তদন্ত প্রক্রিয়া সঠিক পথে এগোয় না।

সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক সমকালকে বলেন, সব আসামিকে সন্দেহভাজন হিসেবেই গ্রেপ্তার করা হয়। এর পর তার বিরুদ্ধে থাকা অভিযোগের প্রমাণপত্র সংগ্রহ করে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয় আদালতে। আর প্রমাণ না পেলে দিতে হয় ফাইনাল রিপোর্ট। আইনের বিধান এমনই। তবে মনগড়া সন্দেহের বশে যাকে ইচ্ছা তাকে গ্রেপ্তার করা যাবে না। গ্রেপ্তারের আগে অবশ্যই অভিযোগের ভিত্তি খতিয়ে দেখতে হবে। অভিযোগের সপক্ষে উপযুক্ত কারণ বা প্রমাণ থাকতে হবে।

তিনি বলেন, আমি ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার থাকার সময় কড়া নির্দেশনা দিয়েছিলাম, মিথ্যা মামলায় কাউকে গ্রেপ্তার তো দূরের কথা, কোনোভাবে হয়রানি করা যাবে না। শত্রুতাবশত কেউ মামলায় কারও নাম দিল, আর গ্রেপ্তার করে ফেললেন, তা হবে না। বাদী অনেক সময় ভুল করে বা ইচ্ছা করে আসামির তালিকায় এমন নাম দেন, যিনি অপরাধে জড়িত নন। সে জন্য তদন্ত-সংশ্নিষ্টদের অভিযোগ যাচাই করে ব্যবস্থা নিতে হবে।

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ উমর ফারুক বলেন, দেশে অপরাধের বিচার ব্যবস্থার মধ্যে তদন্ত একটি দুর্বল জায়গা। অনেক ভুক্তভোগী সঠিক বিচার পান না দুর্বল চার্জশিটের কারণে। প্রাথমিকভাবে যাদের সন্দেহভাজন মনে হয়, শুরুতেই তাদের গ্রেপ্তার না করে বা রিমান্ডে না নিয়ে বিজ্ঞাননির্ভর পদ্ধতিতে তথ্য-উপাত্ত যাচাই করে দেখতে হবে। প্রয়োজনে অভিযুক্ত ব্যক্তির বাসায় বা অন্য কোনো নিরাপদ স্থানে গোপনীয়ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা যেতে পারে। এমন কিছু করা যাবে না, যাতে তার মানহানি ঘটে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ ও তথ্য অনুসন্ধানে সম্পৃক্ততা নিশ্চিত হলে তাকে আদালতে নেওয়া উচিত। এর আগে যদি গ্রেপ্তার করা হয় এবং পরে তার অপরাধ খুঁজে না পাওয়া যায়, সে ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী সামাজিক ও ব্যক্তিগতভাবে হেয়প্রতিপন্ন হন। এক ধরনের জড়তায় ভোগেন, তাঁর জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।

তিনি বলেন, কারও প্রতি সন্দেহ হলে তা যথাযথ কিনা, তা বিজ্ঞাননির্ভর কিনা, অপরাধ-সংশ্নিষ্টতার বিষয়টি সুনির্দিষ্ট কিনা, তা নিশ্চিত করার পরই সন্দেহভাজন বলা যেতে পারে। বিচার ব্যবস্থার চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে যদি নির্দোষ প্রমাণিত হয়, তাহলে তো আগের প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। এ জন্য অভিযোগ বস্তুনিষ্ঠভাবে যাচাই করতে হবে। নইলে যে কেউ এ প্রক্রিয়ার ভুক্তভোগী হতে পারেন।

বুশরার মা মোসাম্মৎ ইয়াসমিন বলেন, চার বছরের বেশি সময় ধরে বুশরা ও ফারদিনের মধ্যে পরিচয়। বিতর্ক প্রতিযোগিতা নিয়ে কথা হতো তাদের। পরে তাদের মধ্যে ভালো বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাদের মধ্যে ফোনে ও মেসেঞ্জারে নিয়মিত কথা হতো। তাও জানত বুশরার পরিবার। দু'জনের মধ্যে কোনো প্রেমের সম্পর্ক ছিল না।

তিনি আরও বলেন, বুশরা গত বছর ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর ফারদিনের সঙ্গে প্রথম সরাসরি সাক্ষাৎ হয় তার। এর পর যখনই ফারদিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ হতো তখন বাসায় জানাত সে। এই হত্যার সঙ্গে আমার মেয়ে কোনোভাবে জড়িত হতে পারে না।

পুলিশের অন্তত দু'জন দায়িত্বশীল কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফারদিনের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে বুশরার সম্পৃক্ত থাকার ব্যাপারে এখনও কোনো তথ্য তাঁরা পাননি। আর ৪ নভেম্বর রাত সোয়া ১০টার দিকে বুশরাকে রামপুরা ব্রিজ এলাকায় নামিয়ে দিয়েছেন ফারদিন। এর পর বুশরা তাঁর বাসায় চলে যান। ওই রাতে তিনি আর বের হননি। এমনকি তথ্যপ্রযুক্তিগত তদন্তে বুশরার সঙ্গে অন্য কারও সন্দেহজনক ফোনালাপ বা মেসেঞ্জারে চ্যাটিং পাওয়া যায়নি। মামলা দায়ের করার আগে কয়েক দফায় ফারদিনের বাবাকে বুশরার ভূমিকার ব্যাপারে বোঝানো হয়েছিল। তবে ফারদিনের বাবা তাঁকে আসামি করার ব্যাপারে অটল ছিলেন।

তদন্তের সঙ্গে যুক্ত একজন কর্মকর্তা জানান, প্রযুক্তিগত তদন্তে তাঁরা জানতে পারেন, ঘটনার রাতে ফারদিন কেরানীগঞ্জ, জনসন রোড, এর পর ডেমরা এবং রূপগঞ্জসংলগ্ন চনপাড়ায় ছিলেন। ধারণা করা হচ্ছে, মোটরসাইকেলে এসব জায়গায় যেতে পারেন তিনি। চনপাড়া বস্তি মাদকের বড় আস্তানা হিসেবে পরিচিত। এরই মধ্যে একাধিক দফায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চনপাড়ায় অভিযান চালিয়েছে। ৪ এপ্রিল সেখানে ফারদিনের যাতায়াতের সূত্র পাওয়া গেলেও, তাঁর পরিবার ও সহপাঠীদের ভাষ্য- 'ফারদিনকে কখনও তাঁরা সিগারেট খেতেও দেখেননি।' তথ্যপ্রযুক্তিগত তদন্তে বের করার চেষ্টা চলছে, চনপাড়া এলাকায় কতবার ফারদিনের যাতায়াত ছিল। এ দিকে সর্বশেষ গতকাল শুক্রবারও সেখানে অভিযান চালায় ডিবি পুলিশ। তবে অভিযানে কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে কিনা, এ ব্যাপারে তারা মুখ খোলেনি। ফারদিনের ছোট ভাই আব্দুল্লাহ বিন নূর তাজিম বলেন, 'তাঁর ভাইয়ের মাদকের সঙ্গে সংশ্নিষ্টতার প্রশ্নই আসে না। মাদক কেন, সিগারেট খেতেও কখনও দেখা যায়নি। চনপাড়ায় কেন গিয়েছিলেন, এটা পুলিশ তদন্ত করে বের করুক। কেউ তাকে অপহরণও করতে পারে।' ফারদিনের বন্ধু সাজ্জাদ হোসেন ফেসবুক স্ট্যাটাসে বলেন, 'নারীদের প্রতি ফারদিনের শ্রদ্ধা ছিল অনুকরণীয়। তার সঙ্গে নারীঘটিত কোনো ঝামেলা কারও সঙ্গে থাকার কথা নয়।'

সংশ্নিষ্টরা বলছেন, বরগুনার আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যার ঘটনার পর উচ্চ আদালত থেকে পর্যবেক্ষণ আসে- আলোচিত অপরাধের তদন্ত চলাকালীন বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেপ্তারের পর অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সংশ্নিষ্ট আদালতে হাজির করার আগে গণমাধ্যমের সামনে উপস্থাপন করা হয়, যা অনেক সময় মানবাধিকারের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অমর্যাদাকর এবং অনুমোদনযোগ্য নয়।

আবার এমনও দেখা যায়, কারও কারও বুকের সঙ্গে 'মাদক ব্যবসায়ী', 'চোরাকারবারি', 'ডাকাত' লেখা প্ল্যাকার্ডও ঝুলিয়ে রাখা হয়। ছবি দেখে মনে হতে পারে, ওই ব্যক্তি সত্যি সত্যি অপরাধী। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার বিকেলে 'সাভার মডেল থানা, ঢাকা' নামক ফেসবুক পেজে দুটি ছবি প্রকাশের পর সমালোচনার মুখে তা সরিয়ে নেওয়া হয়। সাভারে ১২ বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে হওয়া মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। এর পর ভিকটিম শিশুটির পরিচয়, ছবিসহ সাভার মডেল থানার ফেসবুক পেজে পোস্ট করা হয়েছে। যদিও ধর্ষণের শিকার কারও পরিচয় প্রকাশ ও প্রচার করা আইনত নিষিদ্ধ।