অভিজিৎ দাশ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ৬০তম ব্যাচের ছাত্র। ডাক্তারি পড়াশোনা ভালো লাগে না তাঁর। ভালো লাগে মানুষ পেটাতে। ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের হামলা-সংঘর্ষের এক পর্যায়ে সহপাঠী মাহাদি জে আকিবকে ক্ষুর দিয়ে মাথার খুলি থেঁতলে দেওয়ার ঘটনায় আলোচনায় আসেন তিনি। ১৭ মাস আগের ওই ঘটনায় তাঁকে দুই বছরের জন্য বহিস্কার করে কলেজ কর্তৃপক্ষ। কাগজে-কলমে তাঁর এই বহিস্কারাদেশ শেষ হওয়ার কথা আগামী নভেম্বরে। তবে অভিজিতের ক্ষেত্রে বছর হয় ছয় মাসে! তাই ২৪ মাস শেষ হওয়ার আগেই আবার মেডিকেলের ত্রাস হয়ে ওঠেন অভিজিৎ। ক্লাসরুম থেকে ছাত্রাবাস সবকিছুতে চলতে থাকে তাঁর অবাধ বিচরণ। রাজত্ব বড় করতে 'দাগ' থাকা আরও ১০ জনকে রাখেন সঙ্গী হিসেবে। তাঁরাও এক থেকে দুই বছরের জন্য বহিস্কৃত হয়েছিলেন ক্যাম্পাস থেকে। এই ১১ জনের নৃশংসতা ১৭ মাস আগে নাড়া দিয়েছিল পুরো দেশকে। নাড়া দিল এবারও। আগে ডাক্তারি পড়তে আসা আকিবের মাথার হাড় থেঁতলে দিয়েছিলেন তাঁরা। এবার তাঁরা টর্চার রুমে গত বুধবার মধ্যরাতে ডেকে নিয়ে লোহার পাইপ ও খেলার স্টাম্প দিয়ে বেধড়ক পেটালেন চার শিক্ষার্থীকে। তাঁদের মধ্যে দু'জনকে নিতে হয়েছে আইসিইউতে। ওই আইসিইউতে গিয়েও আহত ছাত্রদের হুমকি দিয়ে এসেছেন তাঁরা। বহিস্কৃত শিক্ষার্থীদের এমন বেপরোয়া আচরণে উৎকণ্ঠা ও শঙ্কার মধ্যে আছেন চমেক ক্যাম্পাসে থাকা দেড় হাজারের বেশি 'হবু' ডাক্তার।

এ ব্যাপারে চমেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. সাহেনা আক্তার বলেন, 'অতীতে হামলা-সংঘর্ষসহ শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে বিভিন্ন মেয়াদে যাদের বহিস্কার করা হয়েছে তাদের অনেকে আবার মারামারিতে জড়িয়ে পড়ছে।' আইসিইউতে গিয়েও হুমকি দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'ঘটনাটি জানার পর তাদের নিরাপত্তায় আইসিইউতে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।'

ওরা ১১ জন 'ভয়ংকর' :অভিজিতের সঙ্গী ৬২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সৌরভ বেপারী। আরেক সঙ্গী সাজেদুল ইসলাম ৩০তম বিডিএস ব্যাচের শিক্ষার্থী। আধিপত্যের জানান দিতে সামনে ও পেছনে থাকেন আরও দু'জন। জাহিদুল ৩১তম ও ইমতিয়াজ ৩০তম বিডিএস ব্যাচের শিক্ষার্থী। এই পাঁচজনের সবাই আকিবের ঘটনায় দুই বছরের জন্য চমেক থেকে বহিস্কৃত। কয়েক মাস নীরব থেকে আবার ক্যাম্পাসে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে চাইছেন তাঁরা। আগের ঘটনায় এক থেকে দেড় বছরের জন্য বহিস্কার হওয়া আরও ছয়জন আছেন তাঁদের সহযোগী হিসেবে। তাঁরা হলেন- সাজু দাস, রিয়াজুল ইসলাম, জাকির হোসেন, মাহিন আহমেদ, জুলকাফল মোহাম্মদ শোয়েব ও চমন দাশ। সম্প্রতি চারজনকে পিটিয়ে গুরুতর আহতের ঘটনায় ফের নাম এসেছে তাঁদের। এ ঘটনায় এখনও মামলা দায়ের না হলেও আকিবের ঘটনায় প্রত্যেকেই মামলার আসামি। তাঁরা সবাই শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অনুসারী হিসেবে ক্যাম্পাসে পরিচিত।

যেখানে মারামারি সেখানেই অভিজিৎ ও তাঁর বাহিনী : এরই মধ্যে অভিজিত দাশের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকবার বহিস্কারসহ নানা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে প্রশাসন। এরপরও থামানো যাচ্ছে না নানা অপরাধ। আকিবকে গুরুতর আহত করার পরও বেশ কয়েকটি ঘটনায় নাম আসে অভিজিতের। এ ঘটনাসহ আরও দুটি পৃথক ঘটনায় তদন্ত কমিটি তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করে। গত ১৭ জানুয়ারি চমেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগের পাশের ফার্মেসিতে হামলা চালায় ছাত্রলীগের একদল অনুসারী। এই সময় দোকানের এক কর্মচারী জনিকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করেন তাঁরা। হামলার ঘটনার কথা গণমাধ্যমকে জানানোর অপরাধে ফার্মেসির ম্যানেজার ঝুটন নাথ ও মালিকের ভগ্নিপতি পিন্টু দাশকে রুম নম্বর ১৭-এতে বেঁধে রাখেন তাঁরা।
আইসিইউতে গিয়েও দেওয়া হচ্ছে হুমকি :চমেক হাসপাতালের আইসিইউতে ঢুকেও চিকিৎসাধীন শিক্ষার্থীকে হুমকি দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ সংক্রান্ত একটি ভিডিওতে দেখা যায়, আইসিইউতে ঢুকে কয়েক যুবক (ছাত্রলীগ কর্মী) চিকিৎসাধীন জাহিদ হোসেন ওয়াকিল ও সাকিব হোসেনকে হুমকি দিচ্ছেন। ভিডিও ফুটেজে ওয়াকিলের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় নওফেলপন্থি সাজু দাশকে।

ছাত্রাবাসের দুই কক্ষে ছাত্রলীগের 'টর্চার সেল' : 'প্রথমে আমাকে তিনতলার একটা কক্ষে নিয়ে যায় এক সহপাঠী। সেখানে দেখি ৮ থেকে ১০ জন লাঠিসোটা, রড, স্টাম্প নিয়ে বসে আছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সবাই মিলে মারধর শুরু করে আমাকে। পরে আরেকটি রুমে নিয়ে আবার পেটায় তারা।' এভাবেই নির্যাতনের সেই রাতের বীভৎস ঘটনার কথা সমকালকে বলেন আবু রাইয়াত। প্রাণে বেঁচে গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায় চলে গেলেও এখনও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তিনি। সন্তক নিয়ে এখন দুশ্চিন্তায় আছেন আবু রাইয়াতের বাবা অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মো. আবু জামাল। তিনি বলেন, 'ডাক্তারি পড়াতে ছেলেকে চমেকে ভর্তি করেছি। কিন্তু অমানুষিক নির্যাতনে এখন আমার ছেলে কথাও বলতে পারছে না।'

নাছির গ্রুপের সাম্রাজ্য দখলে নিতে মরিয়া নওফেল গ্রুপ :চমেক ক্যাম্পাসে আছে দুটি গ্রুপ। একটি গ্রুপ মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অনুসারী বলে পরিচিত। আরেকটি গ্রুপ চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী। এত দিন ক্যাম্পাসে একক আধিপত্য ছিল নাছির গ্রুপের। এখন সেটিতে ভাগ বসাতে চায় নওফেল গ্রুপ। এজন্য বারবার ঘটছে হামলা-মারামারির ঘটনা। ২০২১ সালে আকিবকে গুরুতর আহত করা ছাড়াও একই বছরের ২ মার্চ কলেজের ছাত্রাবাসে ছাত্রলীগের দু'পক্ষের মধ্যে ব্যাপক মারামারির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ছাত্রাবাস বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ। ২৭ এপ্রিল রাতে ছাত্রলীগের দু'গ্রপের সংঘর্ষে আহত হন বেশ কয়েকজন ইন্টার্ন চিকিৎসক। ১২ জুলাই ও ১৩ আগস্ট দুই দফায় সংঘর্ষে জড়ায় ছাত্রলীগের দু'গ্রুপ। জানা গেছে, তিনটি ছাত্রাবাসের দখল নিতে ও মেডিকেলের আশপাশে থাকা দোকান থেকে তোলা চাঁদার ভাগবাটোয়ারা নিয়েই বেশিরভাগ সময় মারামারিতে লিপ্ত হয় দুই গ্রুপ।

যা বললেন অভিযুক্তরা : চার ছাত্রকে নির্যাতনে মূল অভিযুক্ত অভিজিৎ দাশ বলেন, 'তাঁরা সবাই শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। কোনো মারধর করা হয়নি। তাঁদের শাসানো হয়েছে।' তবে তাঁর বিরুদ্ধে থাকা অন্যান্য অভিযোগ প্রসঙ্গে বক্তব্য নিতে গতকাল বিভিন্ন নম্বর থেকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। নির্যাতনের ঘটনায় নাম আসার কারণে এখন গণমাধ্যমকে অভিজিৎ এড়িয়ে চলছেন বলে জানান তাঁর সহপাঠীরা। আরেক অভিযুক্ত জুলকাফল মোহাম্মদ শোয়েব বলেন, 'ঘটনার সময় আমি বাড়িতে ছিলাম। আমি কিছুই জানি না'। আরেক অভিযুক্ত রিয়াজুল ইসলাম জয় সমকালের পরিচয় পাওয়ার পর সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। অভিযুক্ত সাজু দাশের মোবাইলে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।