- বিনোদন
- দারুণ রক্তিম পুষ্পাঞ্জলি
দারুণ রক্তিম পুষ্পাঞ্জলি

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বেশ কয়েক যুগ শহীদ আলতাফ মাহমুদকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হতো শুধু একটি গানের সুরস্রষ্টা হিসেবে। অথচ তাঁকে জানতে গিয়ে তাঁর সন্তান হিসেবে বারবার গর্বিত হই। আলতাফ মাহমুদ এমন একটি নাম, যিনি ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত নিজেকে উৎসর্গ করে গেছেন দেশ ও দেশের মানুষের জন্য। ভাষা আন্দোলনে তিনি তাঁর চিন্তা, মনন, মেধাকে উৎসর্গ করেছিলেন একুশের গানের সুর দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধে নিজের অস্তিত্ব উৎসর্গ করেছিলেন আত্মমতবাদ, সাহস, বীরত্বগাথার মধ্য দিয়ে। একুশের গানটি পরিবেশনের সময়কাল নিয়ে ভিন্ন মত থাকলেও আলতাফ মাহমুদ নতুন সুরারোপে মনোনিবেশ করেন এবং ১৯৫৪ সালেই তাঁর দেওয়া নতুন সুরে গানটি পরিবেশন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে।
ইতিহাসকে সামনে রেখে সে সময়ের কথা বলতে গিয়ে খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস এভাবে লেখেন, 'আব্দুল লতিফের সুরটি মন্দ ছিল না। কিন্তু কীসের যেন অভাব ছিল তাতে। ... আলতাফ মাহমুদের নতুন সুরে জনতার কর্ণে যেন মধু ঢেলে দিল। কী ভীষণ মাদকতা, কী ভয়ংকর আকর্ষণ সে গানের। ... এই গানের সুর নিয়ে আব্দুল লতিফ নিজে কোনোদিন বলেননি এটি আমার সুর। বরং আলতাফ মাহমুদের সুরের প্রশংসা করে নিজের আরোপিত সুরটি প্রত্যাহার করেন, যা কালের গর্ভে বিলীন- বহু অনুসন্ধান করেও আব্দুল লতিফের সুরের সন্ধান করা যায়নি।'
'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি' কবিতায় আলতাফ মাহমুদের ধ্রুপদি সুরারোপের পর আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী রচিত কবিতাটি বাংলাদেশে রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে যায়। প্রথম দিকে আলতাফ মাহমুদ নিজেই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পুরো কবিতাটি গেয়ে পরিবেশন করেছেন। এরপর দু'তিনবার নিজের সুরকে নিজেই সামান্য পরিবর্তন করেন। যতদূর জানা যায়, নিজস্ব তৃতীয় সুর করার পর বাংলাদেশের গণসংগীতের দুই দিকপাল শেখ লুৎফর রহমান ও আব্দুল লতিফের কাছে গিয়েছিলেন এবং দু'জনে তাঁর সুরের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে মতামত দিয়েছিলেন। আব্দুল লতিফ বলেছিলেন, এখন থেকে এই সুরেই গানটি গাওয়া হবে।
বর্তমানে যে সুরে এ গানটি পরিবেশন করা হয়, তা আলতাফ মাহমুদের নিজস্ব তৃতীয় মোডিফিকেশনের ফল। তিনি শুধু যে গানের সুর পরিবর্তন করেছেন তা নয়, কবিতাটির শেষের ছয়টি চরণও বাদ দিয়েছিলেন। তবে তা আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরীর অনুমতি নিয়ে বাদ দিয়েছিলেন।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে নিজ ভাষা রক্ষা করার আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করেছিল। যদিও এ লড়াইয়ের বীজ '৪৭ সাল-পরবর্তী সময় থেকেই মানুষের মধ্যে রোপিত হয়ে আসছিল। তরুণ আলতাফ সে সময়ে কাঁধে হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে, হেঁটে কিষানসভা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন। ধর্মনিরপেক্ষ স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার ইতিহাস দিনের পর দিন ধরে তৈরি করেছেন তাঁর মতো তখনকার তরুণের বিশাল অংশ।
একঝাঁক অলৌকিক তরুণের চেতনায় মননে এবং কর্মে তৈরি হয়েছিল বর্ণ-ধর্ম-শ্রেণি ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে, এক অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের মানচিত্র। যে দেশে উগ্রবাদ, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি, স্বৈরাচার, অসমঅধিকার, মুক্তবাক রুদ্ধতার দেখা মিলবে না। অথচ বাংলাদেশ সেই একঝাঁক অদম্য তরুণের কথা স্মরণ করে না, তাঁদের কর্ম চর্চা করে না। কোথাও গিয়ে তাই শূন্য এক দুঃখবোধ কাজ করতে থাকে।
বাবার মতো লাখো শহীদের আত্মত্যাগে পাওয়া এই দেশ। যাঁরা নিজের আত্মপরিচয়, কৃষ্টি, ঐতিহ্য, ইতিহাস জানেন না, তাঁদের এই আত্মিক বিষয়গুলো গুলিয়ে খাওয়ানো যায় না। এটা গুলিয়ে খাওয়ানোর বিষয়ও নয়, ধারণ করার বিষয়। দেশের প্রতিটি মানুষকে তাঁর নিজের কাছে প্রশ্ন করতে হবে- যে ভাষায় কথা বলছি, সেই ভাষা কোথা থেকে এসেছে? যে দেশে হাঁটছি সে দেশটা মুক্ত হলো কেমন করে? আমার আগামী প্রজন্ম নিজ অস্তিত্ব সম্পর্কে জানে কি? এমন সব প্রশ্নোত্তরের চর্চা পরিবার থেকে আসে, শিক্ষা থেকে, সমাজ এবং দেশ থেকেও আসে। সব শেষে আশার আলোয় আলোকিত হতে থাকি আর হৃদয়ের গহিন কোণে প্রার্থনা করতে থাকি- তারুণ্য জাগ্রত থাকুক প্রজন্ম হতে প্রজন্মের প্রতিটি রক্তবিন্দুতে। বাংলাদেশের রক্তাক্ত ইতিহাস সেসব রক্তবিন্দুর সাক্ষী হোক।
লেখক: ভাষাশহীদ সন্তান
মন্তব্য করুন