- বিনোদন
- পঞ্চগড়ে সব হারাদের নির্ঘুম রাত
পঞ্চগড়ে সব হারাদের নির্ঘুম রাত

দুর্বৃত্তদের হামলায় সব হারিয়ে কাঁদছেন সুফিয়া বেগম। পঞ্চগড়ের ফুলতলা গ্রামে তাঁর বাড়ি এখন ধ্বংসস্তূপ। রোববার তোলা - সমকাল
পঞ্চগড় শহরের ফুলতলা এলাকায় ষাটোর্ধ্ব সুফিয়া বেগম অঝোরে কাঁদছিলেন। পুড়ে যাওয়া বাড়ির ধ্বংসাবশেষ নাড়াচাড়া করে কানের দুল খুঁজছিলেন তিনি। দুষ্কৃতকারীদের দেওয়া আগুনে বাড়ির সবকিছুই পুড়ে গেছে। মজনু আহমদের স্ত্রী সুফিয়া বলেন, ‘আমার বিয়ের সময়ের একজোড়া সোনার দুল ছিল। ওই দুল জোড়া খুঁজছি। বাড়িতে আগুন দেওয়ায় নগদ ৬ লাখ টাকাও পুড়ে গেছে। এক টুকরো সুতাও রক্ষা হয়নি। আমরা সালানা জলসা মাঠেই ছিলাম। ভয়ে কেউ বের হতে পারিনি। ফাঁকা বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে তারা।’
সুফিয়া বেগমের মতো এই গ্রামের আহমদিয়া সম্প্রদায়ের অনেকেই পুড়ে যাওয়া বাড়ির ধ্বংসাবশেষ হাতড়ে বেড়াচ্ছেন জিনিসপত্রের খোঁজে। ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হওয়ায় অনেকেই রয়েছেন খোলা আকাশের নিচে। এমন দুর্ভোগে পড়েছে গ্রামের শতাধিক পরিবার। গতকাল রোববার আহমদনগর, ফুলতলা শালশিরি এলাকা ঘুরে বাসিন্দাদের এমন দুর্ভোগের চিত্র দেখা গেছে।
আহমদিয়া সম্প্রদায়ের সালানা জলসাকে কেন্দ্র করে তাদের ওপর হামলা, বাড়িঘর ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, দোকান লুটপাটের ঘটনায় এখনও আতঙ্ক বিরাজ করছে। সর্বশেষ শনিবার রাতে দু’জনের গলাকাটা হয়েছে এমন গুজব ছড়িয়ে আবারও তাদের ওপর হামলা এবং কয়েকটি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও মোবাইল ফোনে গুজব ছড়ানো হয়। এমন ঘটনা ফের ঘটতে পারে এই আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন আহমদিয়া সম্প্রদায়ের লোকজন।
গত শুক্রবার সকালে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের তিন দিনব্যাপী বার্ষিক সালানা জলসা শুরু হয় আহমদনগরে। কিন্তু এতে বাদ সাধে সম্মিলিত খতমে নবুওয়ত সংরক্ষণ পরিষদ সমর্থক মুসল্লিরা। তাঁরা এই জলসা বন্ধ করা এবং আহমদিয়া সম্প্রদায়কে অমুসলিম ঘোষণার দাবিতে শহরে ব্যাপক তাণ্ডব চালায়। রণক্ষেত্রে পরিণত হয় পঞ্চগড়। বাধ্য হয়ে প্রশাসন রাত ৮টায় জলসা বন্ধ করে দেয়। এর পরও দুষ্কৃতকারীরা ওই সম্প্রদায়ের লোকজনের বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুরসহ অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে। শনিবার রাতে আবারও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে জেলা শহরে। গুজবে কান দিয়ে কিছু যুবক লাঠিসোটা নিয়ে সড়কে নামে। এ সময় শহরে অবস্থানকারী পুলিশ ও বিজিবি সদস্যদেরও দৌড়াতে দেখা যায়। তাঁদের ধাওয়ায় পথচারীসহ মানুষজন দিগ্বিদিক ছোটাছুটি শুরু করে। তবে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গুজবে কান না দিয়ে শহরের বিভিন্ন মসজিদের মাইকে সজাগ থাকার আহব্বান জানানো হয়। পরে প্রশাসন, পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাদের তৎপরতায় পরিস্থিতি শান্ত হয়।
পুলিশ বলছে, গ্রেপ্তার যুবদল নেতা ফজলে রাব্বি অন্য একজনকে মোটরসাইকেলে নিয়ে পঞ্চগড় শহরের বিভিন্ন স্থানে গুজব ছড়ান। তাঁরা বলেন, আহমদিয়া সম্প্রদায়ের লোকজন মুসলিম দু’জনকে গলা কেটেছে। ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এদিকে গুজব ঠেকাতে শনিবার রাত ১২টার পর থেকে মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ রাখা হয়।
বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, দোকান লুট, পুলিশের ওপর হামলা, আহমদিয়া সম্প্রদায়ের একজনকে কুপিয়ে হত্যার অভিযোগে পুলিশ গ্রেপ্তার অভিযান অব্যাহত রেখেছে। রোববার সন্ধ্যায় এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ২৩ জনকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছে পুলিশ। তারা সবাই হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগে জড়িত এবং তাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলাসহ তিনটি মামলা হয়েছে বলে পুলিশ জানায়। পুলিশ সুপার এসএম সিরাজুল হুদা বলেন, তাদের মধ্যে দু’জন আহমদিয়া সম্প্রদায়ের জাহিদ হাসান হত্যায় সরাসরি জড়িত। তারা জাহিদকে হত্যার কথা স্বীকার করেছে। এ ঘটনায় আরও মামলা প্রক্রিয়াধীন। বিএনপি–জামায়াত চক্রই এই ঘটনার ইন্ধনদাতা। তারা গুজব ছড়িয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। এই সুযোগে চক্রটি শহরে লুটপাটেরও চেষ্টা করে। এ পর্যন্ত যুবদল নেতা ফজলে রাব্বিসহ ২৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে।
এদিকে আগের তিন দিনের মতো রোববারও পঞ্চগড় শহরের মোড়ে মোড়ে অতিরিক্ত পুলিশ ও বিজিবি মোতায়েন রাখা হয়। সকালে পুলিশের অ্যাডিশনাল আইজি আতিকুল ইসলামের উপস্থিতিতে জেলা প্রশাসনের সম্মেলন কক্ষে বৈঠক হয়েছে। জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলামের সভাপতিত্বে বৈঠকে সম্মিলিত খতমে নবুওয়ত সংরক্ষণ পরিষদ, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, খতমে নবুওয়ত মারকাযের নেতাসহ বিভিন্ন মসজিদের ইমামরা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে সবাই শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে সম্মত হন।
আহমদিয়া সম্প্রদায়ের গণসংযোগ ও প্রেস বিভাগের প্রধান আহমদ তবশির চৌধুরী বলেন, ‘আহমদনগর ও শালশিরি গ্রামে ৩ হাজারের বেশি পরিবার বসবাস করে। আমরা এখনও আতঙ্কের মধ্যে দিনযাপন করছি। একটি মহল গুজব ছড়িয়ে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের বাড়িঘর-দোকানপাটে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করছে। তারা যে কোনো সময় আবারও তাণ্ডব চালাতে পারে। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে জলসা করতে চেয়েছিলাম। জলসা বন্ধের পরও হামলা ও লুটপাট হয়েছে।’
পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, এ ঘটনায় বিভাগীয় পর্যায়ের একটি তদন্ত কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। আর কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার শঙ্কা নেই। আহমদনগর এলাকায় পুলিশ-বিজিবি সমন্বয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। যারা গুজব ছড়িয়েছে, তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে।
বিএনপি-জামায়াত চক্রকেই দায়ী করলেন রেলমন্ত্রী: পঞ্চগড়ে বিএনপি-জামায়াত গুজব ছড়িয়ে অপতৎপরতা চালাচ্ছে– এমন অভিযোগ করে আওয়ামী লীগ মাঠে সরব থাকার ঘোষণা দিয়েছে। রোববার বিকেলে পঞ্চগড়ের দলীয় কার্যালয়ের সামনে জেলা ছাত্রলীগ আয়োজিত প্রতিবাদ ও শান্তি সমাবেশে আওয়ামী নেতারা এই ঘোষণা দেন। এতে প্রধান অতিথির বক্তব্যে রেলমন্ত্রী ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, একাত্তরের কায়দায় ধর্মকে ব্যবহার করে কয়েকদিন ধরে পঞ্চগড়ে জ্বালাও-পোড়াও করা হচ্ছে। সড়ক অবরোধসহ গুজব ছড়িয়ে লুটপাট করা হচ্ছে। সবাইকে আইনের আওতায় এনে বিচার করা হবে।
সমাবেশে নেতারা বলেন, শনিবার রাতেও বিএনপি-জামায়াত চক্র গুজব ছড়িয়ে শহরে আতঙ্ক সৃষ্টিসহ রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করে। আবারও হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে। দুষ্কৃতকারীরা ট্রাক টার্মিনাল এলাকায় একটি গাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। তারা পঞ্চগড় বাজারের বিভিন্ন দোকানে লুটপাট চালায়।
মন্তব্য করুন