- বিনোদন
- মেডিকেলে ভর্তির প্রশ্ন বিক্রির বিজ্ঞাপন
মেডিকেলে ভর্তির প্রশ্ন বিক্রির বিজ্ঞাপন
দিনভর গুজব, প্রশ্ন ফাঁসের নামে প্রতারণায় গ্রেপ্তার ২

প্রতীকী ছবি
দেশের সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস কোর্সে ভর্তি পরীক্ষা গতকাল শুক্রবার অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে দিনভর ছিল প্রশ্ন ফাঁসের গুজব। ফেসবুকে একজন প্রশ্ন বিক্রির বিজ্ঞাপন দিয়ে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। যদিও এটি ছিল প্রতারণার ফাঁদ। এমন প্রতারণায় জড়িত দু’জনকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এর মধ্যে গতকাল গ্রেপ্তার এসএম আনিসের চক্রে যুক্ত আছেন স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগ থেকে সদ্য অবসরে যাওয়া অতিরিক্ত সচিব নীতিশ চন্দ্র সরকার। এ ছাড়া জড়িত আছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কয়েক কর্মকর্তা-কর্মচারী ও কোচিং সেন্টারের লোকজন।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ জামাল সমকালকে বলেন, মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার সুযোগ নেই। হয়তো কোনো শিক্ষার্থী প্রশ্নপত্রের ছবি তুলে ফেসবুকে দিতে পারে। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (শেকৃবি) কেন্দ্রে মোবাইল ফোন ও ডিভাইস ব্যবহারের কারণে এক নারী শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার ও তার বিরুদ্ধে শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা হয়েছে। ওই শিক্ষার্থীর চশমায় ক্যামেরা লাগানো ছিল। পরীক্ষা শুরুর আধাঘণ্টা পর তার আচরণে সন্দেহ হলে তল্লাশি করে দুটি মোবাইল ফোন পাওয়া যায়। এমন হয়তো আরও শিক্ষার্থী মোবাইল ফোন নিয়ে কেন্দ্রে আসতে পারে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এবার এমবিবিএস কোর্সে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার আবেদন করেন এক লাখ ৩৯ হাজার শিক্ষার্থী। সারাদেশের ১৯টি কেন্দ্রের ৫৭টি ভেন্যুতে গতকাল সকাল ১০টায় এক ঘণ্টার এমসিকিউ পরীক্ষা হয়।
সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে পরীক্ষাকেন্দ্র পরিদর্শন শেষে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, প্রশ্নপত্রের সঙ্গে ট্র্যাকিং ডিভাইস যুক্ত থাকায় কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।
শাহিদুল হাসান তামিম নামে একটি ফেসবুক আইডি থেকে সকাল ৭টা ১১ মিনিটে মেডিকেলের প্রশ্ন বিক্রি সংক্রান্ত একটি পোস্ট দেওয়া হয়। সেখানে মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নের প্রথম পৃষ্ঠা সংযুক্ত করা হয়েছে। তবে পৃষ্ঠা সংযুক্ত করা হয় ১২টার পর। তিনি পোস্টে উল্লেখ করেন, মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ২০২৩– সময় সকাল ৭টা ৯ মিনিট। কিছু ফ্রি দিলাম, পরীক্ষার পর এসে মিলিয়ে নিয়ো। আমি অ্যাডভান্স টাকা ছাড়া কাউকে কোনো প্রশ্ন দিইনি, আর কোনোদিন দেবও না। বলছিলাম, পরীক্ষার কিছুক্ষণ আগে ফ্রি দেব, কিছু দিলাম। এইটুকুই প্রমাণের জন্য যথেষ্ট। যাদের ডেন্টাল অ্যাডমিশন টেস্ট, প্রাইমারি শিক্ষক নিয়োগসহ যে কোনো ভর্তি পরীক্ষার শতভাগ কমন প্রশ্ন লাগবে, তারা দ্রুত যোগাযোগ কর। টাকা ফিক্সড এবং অ্যাডভান্স।
পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর দেখা যায়, অনুষ্ঠিত পরীক্ষার প্রশ্নের সঙ্গে ওই প্রশ্নের হুবহু মিল পাওয়া গেছে। এতে পরীক্ষায় অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিরূপ প্রভাব পড়ে। পোস্টটি ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দিনভর প্রশ্ন ফাঁসের গুজব লক্ষ্য করা যায়। অনেকে ওই পোস্টের নিচে মন্তব্য লিখছেন– মানে কী! পরীক্ষা দেওয়াই বৃথা তাহলে। হুমাইয়া জাহান জিম নামে একজন লিখেছেন– এটা কি ছিল, আসলেই মিলে গেল। এ ছাড়া তামিমের ফেসবুকে আরও পাঁচটি পোস্ট পাওয়া যায়। সবই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ও নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন বিক্রি সংক্রান্ত।
তবে তামিমের মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন বিক্রি সংক্রান্ত পোস্টের এডিট হিস্টরিতে গিয়ে দেখা যায়, শুধু টেক্সট (লেখা) পোস্ট করা হয়েছে ৭টা ১১ মিনিটে। পরে প্রশ্নপত্রের ছবিটি যুক্ত করা হয়েছে ১২টা ৪ মিনিটে। অর্থাৎ পরীক্ষার আগেই প্রশ্ন ফাঁসের দাবি সঠিক নয়। দুপুর ২টার মধ্যে আরও দুই থেকে তিনটি ওয়েবসাইটে পরীক্ষায় আসা প্রশ্নের উত্তরসহ আপলোড করা হয়েছে। তবে নিয়ম অনুযায়ী মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন কেন্দ্রের বাইরে নেওয়ার সুযোগ নেই। ফলে প্রশ্ন উঠেছে– কীভাবে মূল প্রশ্ন ফেসবুক বা ওয়েবসাইটে গেল? তা যখনই যাক না কেন।
প্রশ্ন ফাঁসের নামে প্রতারণা, চক্রে কর্মকর্তা-কর্মচারী : মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের নামে প্রতারণার অভিযোগে এসএম আনিস নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। গতকাল শুক্রবার রাজধানীর মণিপুরিপাড়া এলাকায় এ অভিযান চালায় ডিবি লালবাগ বিভাগের কোতোয়ালি জোনাল টিম। এ সময় তার কাছ থেকে চলমান ও পূর্ববর্তী এমবিবিএস পরীক্ষার অনেক প্রবেশপত্র, বিভিন্ন ব্যাংকের শতাধিক চেক, পুলিশ কনস্টেবল পদপ্রার্থীর প্রবেশপত্র, লেখা ও ফাঁকা নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প, একাধিক প্যাড, পাঁচটি ডিজিটাল এবং পুরোনো স্ট্যাম্প-সিল এবং একটি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়েছে।
ডিবি বলছে, পরীক্ষার আগেই প্রশ্নপত্র সরবরাহ, এমনকি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলেও বিশেষ ব্যবস্থায় ভর্তি করানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিপুল অর্থ হাতিয়েছে আনিস ও তার সহযোগীরা। স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগের এক কর্মকর্তাও এই অর্থের ভাগ পেতেন। এই চক্রে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অবসরপ্রাপ্ত কয়েকজন অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী ও কোচিং সেন্টারের লোকজন যুক্ত। তারা সবাই মিলে প্রশ্ন ফাঁসের নামে ছাত্রছাত্রী ও তাঁদের অভিভাবকের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে আসছিল।
ডিবি লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার মশিউর রহমান সমকালকে বলেন, আনিস এসএসসি পাস করে কিছুদিন পিপলস জুট মিলে, পরে কাপড়ের কারখানায় ডাইংয়ের কাজ করে। ২০১০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত সে ফার্মগেট ও গ্রিন রোডে ছাত্র-ছাত্রী হোস্টেল এবং বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজে ভর্তির ফরম কেনাবেচা করে। এখানে নিজ এডুকেশন নামে কনসালটেন্সি ফার্মের স্বত্বাধিকারী জাহিদের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। এর পর উচ্চ মাধ্যমিক পাস আনিস নিজেই একটি ফার্ম খোলে; নাম দেয় ‘ফ্রেন্ডস অ্যাডমিশন কনসালটেন্ট’। সিটি করপোরেশন থেকে মুদি দোকানের লাইসেন্স নিয়ে সে শুরু করে দেশি ও সার্কভুক্ত বিদেশি ছাত্রছাত্রীদের মেডিকেল কলেজে ভর্তির বাণিজ্য। এই কাজের জন্য সে নিজের প্যাডে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষদের আসন সংরক্ষণের জন্য চিঠিও লিখেছে।
ডিবি জানায়, মেডিকেল কলেজে ভর্তি ছাড়াও বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায় দালালি বা প্রতারণা করে বিপুল অর্থের মালিক হয়েছে আনিস। প্রতারণার টাকায় সে দুটি হোটেল এবং মণিপুরিপাড়ায় বিলাসবহুল ফ্ল্যাট কিনেছে। চলমান এমবিবিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের সক্ষমতা তার ছিল না। তবে এই পরীক্ষার নামে বিস্তর প্রতারণার জাল বিভিন্ন মাধ্যমে বিস্তার করেছে।
এর আগে বুধবার মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের নামে প্রতারণার অভিযোগে আরেকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার নাম মিরাজ হোসেন তুহিন। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট রাজধানীর মিরপুরে এ অভিযান চালায়।
স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগ থেকে সদ্য অবসরে যাওয়া অতিরিক্ত সচিব নীতিশ চন্দ্র সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ সত্য নয় বলে দাবি করেন।
মন্তব্য করুন