সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি নির্বাচন ঘিরে কম ঘোলা হয়নি জল। আওয়ামী লীগ ও বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের উত্তেজনা শেষ পর্যন্ত সংঘাতে গড়ায়। ভাঙচুর, ধাক্কাধাক্কি, হাতাহাতি সবই চলে। সামাল দিতে গিয়ে চড়াও হয় পুলিশও। লাঠিপেটায় আহত হন সাংবাদিকসহ অনেকে। মামলা গড়িয়েছে আদালতে। ভোট শেষে নিরঙ্কুশ জয় পায় আওয়ামী লীগপন্থি প্যানেল। পেশাজীবী এ নির্বাচনে কেন এবার উত্তেজনার পারদ এতটা চড়ল। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক দুই সভাপতির কাছে কারণ খোঁজার চেষ্টা করেছে সমকাল


সমকাল : সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন ঘিরে আইনজীবীদের হট্টগোল, ভাঙচুর এবং পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনাকে কীভাবে দেখছেন? ঘটনার কারণ কী?

এ এম আমিন উদ্দিন : ঘটনাটি অত্যন্ত দুঃখজনক। পেছনের কারণ জানতে পুরো বিষয়টি বিশ্লেষণ করতে হবে। জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ঐক্য প্যানেল (বিএনপিপন্থি) নির্বাচন করবে কিনা– তা নিয়ে শুরু থেকেই দ্বিধায় ছিল। কারণ, প্রথম যখন বার থেকে নির্বাচন পরিচালনা কমিটি করা হয় তখন তাঁরা বললেন ‘একতরফা’। পাল্টা কমিটি দিলেন। তখন বারের সাবেক ও বর্তমান সভাপতিসহ কয়েকজন সিনিয়র নেতা মিলে বসলাম, আমিও ছিলাম। তাঁরা রাজি হলেন। আমরা (আওয়ামীপন্থি) এবং তাঁরা (বিএনপিপন্থি) মিলে তিনজনের নাম দিলাম। তাতে পছন্দের প্রথম দু’জন দায়িত্ব নিতে রাজি হননি। পরে তৃতীয় পছন্দ বারের সিনিয়র আইনজীবী ও অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মুনসুরুল হক চৌধুরী নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব নিতে রাজি হন। পরে  তিনিও পদত্যাগ করলেন। তখন চেষ্টা হয়েছিল, আবারও আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি সমাধানের। সেটি আর হয়নি। তখন বিচারপতি মুনসুরুল হক চৌধুরীর নেতৃত্বে যে সাত সদস্যের নির্বাচন পরিচালনা কমিটি গঠন হয়েছিল, সেই কমিটির জ্যেষ্ঠ সদস্যকে আহ্বায়ক করে কমিটি পুনর্গঠন করা হয়। তাতে ওনারা (বিএনপিপন্থি) প্রতিবাদ করলেন, ব্যালট ছিনতাই করে নিয়ে গেলেন, ছিঁড়ে নষ্ট করলেন। এগুলো সবই হয়েছে নির্বাচনের আগের দিন রাতে। অরাজকতা তৈরি হয়, বিষয়টি সংঘর্ষের পর্যায়ে চলে যায়। তাঁরা নির্বাচন করতে দেবেন না। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচন পরিচালনা কমিটি মামলা করে। পুলিশি হস্তক্ষেপ শুরু হয়। অন্যদিকে বার চাইল নির্বাচন হবে। পরদিন যখন ভোট শুরু হলো তখন বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা এলেন এবং বললেন, তাঁরা নির্বাচন করতে দেবেন না। মুনসুরুল হক চৌধুরীকে আসতে হবে ইত্যাদি। এটা খারাপ কিছু নয়। তাঁরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে প্রতিবাদ করতেই পারেন। পরে যেটা করা হলো তাঁরা দক্ষিণের যে গেট দিয়ে ভোটাররা আসছেন সেখানে বাঁশ, লাঠিসহ নানা কিছু নিয়ে হামলা চালালেন, পর্দা ছিঁড়ে ফেললেন। বুথ ভাঙচুর হলো। মহিলা আইনজীবীরা পর্যন্ত এতে যুক্ত হন। একজন সিনিয়র আইনজীবী অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেলকে পর্যন্ত ধাক্কা দিয়েছেন। ঢিল মারলেন। পুলিশ, আইনজীবী কেউ তাঁদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাননি। শেষ মুহূর্তে তাঁরা সুপ্রিম কোর্টের লোগোসহ বারের দরজা-জানালা ভাঙচুর করেন। আমাদের নির্বাচনের সময় বরাবরই নিরাপত্তার স্বার্থে পুলিশ থাকে, বার-ই চিঠি দিয়ে পুলিশি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে।

সমকাল : নির্বাচন ঘিরে যেসব ঘটনা ঘটেছে, তাতে আইন অঙ্গনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে কিনা।

এ এম আমিন উদ্দিন : অবশ্যই। অবশ্যই। আমরা কোনোভাবেই এটা আশা করতে পারি না। আইনজীবীরা এভাবে ভাঙচুর করবেন বা পুলিশকে ঢিল ছুড়বেন। এর মাধ্যমে আইনজীবীদের সম্মান নষ্ট হয়েছে, এটি ঠিক হয়নি।

সমকাল : অনেকে বলছেন জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে এ ধরনের ঘটনা ঘটানো হয়েছে, আপনি কী মনে করেন?

এ এম আমিন উদ্দিন : দেখেন ওনারা (বিএনপিপন্থি) একটি রাজনৈতিক দলের। তাঁদের দলের মহাসচিব (মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর) কিন্তু বিবৃতি দিয়েছেন। বলেছেন– এভাবে হলে জাতীয় নির্বাচন কীভাবে হবে। এমন পরিস্থিতিতে অনেকেই এখন বলছেন, তাঁরা সামনের জাতীয় নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে এই কাজগুলো করেছেন।

সমকাল : সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন নিয়ে যা হয়েছে, এর প্রভাব আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পড়বে কিনা?

এ এম আমিন উদ্দিন : জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনেক বড় বিষয়। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি একটি সংগঠন। সারা বাংলাদেশেরও নয়। আইনজীবীদের একটি অংশমাত্র। তবে সুপ্রিম কোর্ট সমিতির নির্বাচনে যেটা হয়েছে, তাতে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে জনমনে ভীতির সঞ্চার করা হয়েছে। দেখানো হয়েছে, জাতীয় নির্বাচনও কিন্তু এমনই হবে। এটা  উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে করা হয়েছে। তবে আমি বিশ্বাস করি, যে ঘটনা ঘটেছে, তা আইনজীবীরাও সরাসরি করেননি, বাইরে থেকে কালো পোশাক পরিয়ে এনে তাদের দিয়ে এসব ঘটনা ঘটানো হয়েছে। এখানে অবশ্য যুবদলের সহ-আইনবিষয়ক সম্পাদক, মহিলা দলের নেতা এবং জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের কিছু নেতা ছিলেন। যাঁদের চেনা গেছে। অন্যরা হলেন বাইরের লোকজন– যাঁরা বিএনপিপন্থিদের হয়ে বাইরে থেকে সংঘর্ষে জড়িয়েছেন।

সমকাল : পুলিশের হামলা থেকে আইনজীবী ও সাংবাদিক– কেউ রক্ষা পাননি, এ ক্ষেত্রে পুলিশের বাড়াবাড়ি রয়েছে বলে মনে করেন কী?

এ এম আমিন উদ্দিন : দেখুন ওনারা (বিএনপিপন্থি) যে ঘটনা ঘটিয়েছেন, সেটা সামাল দিতে গিয়ে হয়তো পুলিশ বল প্রয়োগ করেছে। এ জন্য কিন্তু আমরাই দায়ী। কারণ আইনজীবীরা যদি পরিস্থিতি খারাপ না করতেন, তাহলে তাদের (পুলিশ) এ ঘটনায় জড়ানোর প্রয়োজন হতো না। তাই দায় আমাদেরও নিতে হবে। তবে পুলিশ এ ঘটনায় যেভাবেই জড়াক, সেটা আমার পছন্দ হয়নি। তাছাড়া এ ঘটনায় পুলিশ, সাংবাদিকও আহত হয়েছেন। এটি দুঃখজনক। দেখেন, এখানেও বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা সাংবাদিকদের ব্যবহার করেছেন। তাঁদের ডেকে নিয়ে গিয়ে সামনে এগিয়ে দিয়ে পেছন থেকে ভাঙচুর চালানো হয়। তখন সাংবাদিকরা ভাঙচুরকারী ও পুলিশের মাঝে পড়ে গেলেন এবং পুলিশি হামলার শিকার হলেন। এটা যেভাবেই হোক, সাংবাদিকদের লাঞ্ছিত হওয়া বা তাঁদের নির্যাতন করা কোনোভাবেই আমি পছন্দ করি না। এটি ঠিক হয়নি।

সমকাল : বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের দাবি, তাঁদের মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়েছে। এখন পরিস্থিতি কোন দিকে যেতে পারে, সমাধানের উপায় কী?

এ এম আমিন উদ্দিন : সবাই মিলে বসে সমাধান করতে হবে। সবার শুভবুদ্ধির উদয় হোক। নির্বাচন একটা হয়ে গেছে। ফল হয়েছে। এখন আর কিছু করার নেই। আবার যদি তাঁরা (বিএনপিপন্থি) ভাঙচুর করেন বা পরিবেশ অস্থিতিশীল করেন, তাহলে আবার মামলা হবে। আরেক পক্ষ প্রতিহত করবে। ভাঙচুরের ঘটনায় মামলা হবে– এটাই স্বাভাবিক। তাতে তো আর ভালো কিছু হবে না। তখন আবারও হয়তো পুলিশ আসবে। এটি আবারও আমাদের জন্য লজ্জাজনক হবে।

সমকাল : আপনাকে ধন্যবাদ।

এ এম আমিন উদ্দিন : সমকাল এবং আপনাকেও ধন্যবাদ।