- বিনোদন
- হাজারো বধ্যভূমি কে সংরক্ষণ করবে
হাজারো বধ্যভূমি কে সংরক্ষণ করবে

১৯৭১ সালের ১ জুন গভীর রাতে দিনাজপুরের খানসামা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অমিয় কুমার গুহকে আটক করে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর রাজাকাররা। পরে তাঁকে পাকিস্তান বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়। পাকিস্তান বাহিনী অমিয় গুহকে সাইকেলে রশি দিয়ে বেঁধে ইছামতী নদীর তীরে খানসামা ও পার্শ্ববর্তী নীলফামারী উপজেলার সংযোগস্থল পুলহাটে নিয়ে যায়। সেখানে তাঁকে গুলি করে, নির্মমভাবে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়।
একই দিন একই স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া টেডি ডাক্তার ও মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগী খুট্টু মিয়াকেও হত্যা করে পাকিস্তানিরা। পরে স্থানীয় তরণীকান্ত, নজরুল ইসলামসহ কয়েকজন তাঁদের মরদেহ নদী থেকে তুলে কবরস্থ করেন। গণহত্যার এসব স্থান বধ্যভূমি নামে পরিচিত থাকলেও সরকারি উদ্যোগের অভাবে সেগুলো অরক্ষিত।
পুলহাট গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী নজরুল ইসলামের বয়স এখন ৯৫। কানে একটু কম শুনলেও তাঁর স্মৃতিশক্তি প্রখর। তিনি সমকালকে বলেন, পাকিস্তানিরা অমিয় গুহসহ কয়েকজনকে পুলহাটে হত্যা করে লাশ ফেলে যায়। লুকিয়ে অনেকেই এই হত্যাযজ্ঞ দেখেছি। পাকিস্তানিরা চলে যাওয়ার পর তরণীকান্ত, সোনাউল্লা, রহিম মেম্বার, শিষেণ বাবুসহ কয়েকজন মিলে আমরা নদীর পাড়ে সরকারি খাস জায়গায় মৃতদেহগুলো কবরস্থ করেছিলাম। কিন্তু গণকবরগুলো সংরক্ষণ না করায় তা নদীতে বিলীন হওয়ার উপক্রম।
শুধু দিনাজপুরের পুলহাট নয়; সারাদেশে এমন হাজারো বধ্যভূমি অযত্ন-অবহেলায় সংরক্ষণের অভাবে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এক সময়ে চিহ্নগুলোও থাকবে না।
ঢাকার অদূরে হরিহরপাড়া গ্রামের অবস্থান বুড়িগঙ্গা নদী-সংলগ্ন নারায়ণগঞ্জ জেলায়। ১৯৭১ সালে এই গ্রামের ২০ হাজার মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। মার্কিন পত্রিকা ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’-এর প্রতিনিধি লুই এম. সাইমনস ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি ওই গ্রামে গিয়েছিলেন। কথা বলেছিলেন প্রত্যক্ষদর্শী বহু মানুষের সঙ্গে। প্রকাশিত তাঁর প্রতিবেদনে বলা হয়, হরিহরপাড়া গ্রামের পাশাপাশি ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও অন্যান্য স্থান থেকেও বাঙালিদের ধরে এনে পিছনে হাত বাঁধা অবস্থায় বুড়িগঙ্গা নদীর ধারে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হতো। পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণের আগের দিন ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর এই হরিহরপাড়ায় অসংখ্য মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল। প্রতিবেদক যখন ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’-এ প্রতিবেদন পাঠান, তখনও গ্রামটি ছিল জনবসতিশূন্য। অথচ বর্তমান প্রজন্মের কেউ হরিহরপাড়ায় গণহত্যা বা বধ্যভূমি সর্ম্পকে জানে না। কারণ হরিহরপাড়া গ্রামে বধ্যভূমির অস্তিত্বই নেই।
একই অবস্থা খোদ রাজধানীতে। বিভিন্ন গবেষণায় ঢাকার মিরপুরে ২৩টি বধ্যভূমির তথ্য থাকলেও ১৩টি চিহ্নিত করা এখন দুঃসাধ্য। যে ১০টি চিহ্নিত হয়েছে, সেগুলোর অধিকাংশ সরকারিভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে না। মিরপুরে শনাক্ত হওয়া বধ্যভূমি– শিয়ালবাড়ী, আলোকদি, মুসলিমবাজার, পল্লবীর কালাপানি, রাইনখোলা, মিরপুরের শিন্নিরটেক, সারেংবাড়ি, গোলারটেক পালপাড়া, বাঙলা কলেজের আমবাগান ও কল্যাণপুর বাস ডিপো।
গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ১৯৮০-এর দশক থেকে সারাদেশে মাঠ পর্যায়ে কাজ করছেন ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির প্রধান ডা. এমএ হাসান। তাঁর নেতৃত্বে ১৩ জনের একটি গবেষক দল জেনোসাইড আর্কাইভ অ্যান্ড হিউম্যান স্টাডিজ সেন্টারের ব্যানারে ২০০১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যা বিষয়ে ৮৩৮ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস লাইব্রেরিতে জমা দেয়। ওই প্রতিবেদন পরে তাঁরা জাতিসংঘের ৫৭তম অধিবেশনেও দাখিল করেন। প্রতিবেদনে সারাদেশে প্রায় পাঁচ হাজার বধ্যভূমি এবং ৮৮টি নদীতীর ও ৬৫টি ব্রিজ চিহ্নিত করা হয়েছিল, যেখানে পাকিস্তানি বাহিনী নিয়মিত গণহত্যা চালিয়েছিল।
ডা. হাসান বলেন, জরিপে পাওয়া বধ্যভূমির তালিকা তাঁরা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে প্রতিমন্ত্রীকে দিয়েছিলেন। তখন বিএনপি জোট সরকার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। বর্তমান সরকার এ খাতে অর্থ ব্যয় করলেও দৃশম্যান পরিবর্তন আসেনি।
জানা যায়, ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে দেশের সব বধ্যভূমি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর পর গত দেড় যুগে কয়েকশ বধ্যভূমি চিহ্নিত হলেও তা সংরক্ষণ করা হয়নি। ২০১৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর চিহ্নিত ২৭১টি বধ্যভূমি সংরক্ষণের জন্য ৪৪২ কোটি ৪০ লাখ টাকার প্রকল্প জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন করে সরকার। দুই দফা মেয়াদ বাড়ানোর পর ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করার কথা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের গত জানুয়ারির তথ্যানুযায়ী, মাত্র ২০টি বধ্যভূমি সংরক্ষণ সম্পন্ন হয়েছে। আরও ৭১টি বধ্যভূমি সংরক্ষণ বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত দেশের ৩৮ জেলায় ৮০৭টি বধ্যভূমি চিহ্নিত করেছে খুলনায় স্থাপিত গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্ট। তাতে বধ্যভূমি, গণকবর, টর্চার সেলসহ গণত্যার অন্যান্য বিষয় নিয়ে ১৮ হাজার ৯৫৬টি স্মৃতিচিহ্ন শনাক্ত করা হয়েছে। বাকি ২৬ জেলায় জরিপ শেষ হলে বধ্যভূমির সংখ্যা দেড় হাজার ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন জাদুঘর-সংশ্নিষ্টরা।
ট্রাস্টের সভাপতি অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন সমকালকে বলেন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া শনাক্ত হওয়া বধ্যভূমি সংরক্ষণ সম্ভব হবে না। বধ্যভূমির অনেক স্থান নদনদীর ভাঙনে হারিয়ে গেছে। কিছু দখল হয়ে সেখানে স্থাপনাও নির্মিত হয়েছে। অবিলম্বে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণ করা জরুরি।
খুলনা শহরতলিতে বহুল পরিচিত একটি বধ্যভূমি রয়েছে গল্লামারীতে; খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে। মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানে কতজনকে হত্যা করা হয়েছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা হিসাব করে অনুমান করা হয়, এখানে শহীদের সংখ্যা ১০ হাজারের কাছাকাছি। গল্লামারী নদীর ওপরে নির্মিত বর্তমান পাকা সেতুটি তখন ছিল কাঠের পুল।
সরেজমিন দেখা যায়, ২০১৬ সালের ৬ জানুয়ারি গণহত্যা জাদুঘর ট্রাস্টের উদ্যোগে গল্লামারী বধ্যভূমিতে শহীদ স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়েছে, যা দূর-দূরান্তের পথিককেও কিছু সময়ের জন্য থমকে দিচ্ছে। খুলনা জেলা পরিষদের তত্ত্বাবধানে ২০০৮ সালে গল্লামারীতে স্বাধীনতা সৌধ নির্মাণ করা হয়। অবশ্য এর রক্ষণাবেক্ষণে যত্ন নিতে দেখা যায় না।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ডা. সারওয়ার আলী সমকালকে বলেন, বধ্যভূমিসহ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণ করা জরুরি। যদি একজন বীর শহীদ মুক্তিযোদ্ধার কবর হয়, তাহলেও। তরুণ প্রজন্মের কেউ যখন একটি কবরের পাশ দিয়ে যাবে, তখন যেন তার মনে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ত্যাগের বিষয়টি মনে আসে। এতে দেশপ্রেম জাগ্রত হবে।
তিনি বলেন, বধ্যভূমি সংরক্ষণে সরকারি চেষ্টা আছে, তবে বাস্তবায়ন হচ্ছে ধীরগতিতে। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত সব স্থাপনায় ঘটনার বর্ণনাসহ স্মৃতিফলক স্থাপন করার ওপর তিনি জোর দেন।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক সমকালকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জানাতে চিহ্নিত সব বধ্যভূমি সংরক্ষণ করা উচিত। মন্ত্রণালয় বধ্যভূমির তালিকা তৈরি করে সংরক্ষণে কাজ শুরু করেছে। তবে মন্ত্রণালয়ের একার পক্ষে সব করা সময়সাপেক্ষ। জেলা ও স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনকেও এ বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
মন্তব্য করুন