ইউক্রেনের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত বসন্ত আসে পাল্টা আক্রমণে কিছু দখলকৃত অঞ্চল পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে। তবে রাশিয়ার বিপুলসংখ্যক বাহিনী, বিস্ফোরক খনির পেছনের পরিখা, ট্যাঙ্কের ফাঁদ এবং ড্রাগনের দাঁত তাকে ক্রিমিয়া এবং দনবাসের কিছু অংশের ওপর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে সহায়তা করছে। এভাবেই হয়তো ইউক্রেন যুদ্ধ পরিসমাপ্তির দিকে যাচ্ছে। শরৎ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এটাও স্পষ্ট হয়ে যচ্ছে– কোনো পক্ষই একক জয় পাচ্ছে না। বিশাল ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে, যেখানে রাশিয়া ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়লেও ইউক্রেনের সেনা ও অস্ত্রের সংকট প্রকট রূপ ধারণ করে, জয়ের ক্ষুধার ঘাটতিতে ভোগা কিয়েভের পশ্চিমা সমর্থকরা ‘টেকসই যুদ্ধবিরতি’র জন্য চাপ দিতে শুরু করে। চীনের অবস্থানও এমনই।

গত বছর অবৈধভাবে সংযুক্ত চারটি অঞ্চলের ওপর নিজের দাবি অব্যাহত রেখে রাশিয়া হয়তো শেষ পর্যন্ত শর্তসাপেক্ষে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হবে। ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনের ‘কৌশলগত নিরপেক্ষকরণ’-এর জন্য তার বাহিনীর প্রশংসা করবেন। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি তাঁর দেশের ২০১৪ সালের পূর্বের সীমানা পুনরুদ্ধার অভিযান সাময়িকভাবে স্থগিত করতে বাধ্য হবেন। বিনিময়ে ইউক্রেন তার প্রায় ৮৫ শতাংশ ভূখণ্ড ধরে রেখে মানবিক, অর্থনৈতিক এবং অবকাঠামোগত ক্ষতি থেকে রক্ষা পাবে। কোরীয় অঞ্চলের মতো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তত্ত্বাবধানে অসামরিক জোন তৈরি হবে। কিয়েভে মিসাইল আসা বন্ধ হবে; পুনর্গঠন শুরু হবে; শরণার্থীরাও ফিরতে শুরু করবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার পশ্চিম ইউরোপীয় ন্যাটো মিত্ররা ঘোষণা করবে– গণতান্ত্রিক ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা ও বিশ্বব্যাপী শৃঙ্খলা সুরক্ষিত রয়েছে। যদিও পোল্যান্ড এবং অন্যান্য পূর্ব ইউরোপীয় রাষ্ট্র স্বীয় সুরক্ষা নিয়ে ততটা নিশ্চিত নয়। ইউক্রেনের ইইউতে যোগদানও নতুন করে ঝুলে গেছে। গত সপ্তাহে বার্লিন-ব্রাসেলস দ্বন্দ্বের যে আভাস পাওয়া গেছে, তাতে ন্যাটোর সদস্যপদ আরও জটিল হবে। ‘শান্তি প্রক্রিয়া’র চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হতে কয়েক বছর সময় লাগতে পারে।

যদি এই দৃশ্যকল্প বা এর মতো কিছু আসন্ন বছরে দেখা যায়, তবে ইউক্রেনীয়রা অনিবার্যভাবে অনুভব করবে– তারা বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছে। রাশিয়াকে প্রতিহত করার জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ‘যা কিছু করা দরকার’– এমন প্রতিশ্রুতি হয়তো অসম্পূর্ণ থাকবে। পুতিন তাঁর অনেক নৃশংস অপরাধ সত্ত্বেও ক্ষমতায় টিকে থাকবেন।
পছন্দ করুন বা নাই করুন, এটিই সম্ভাব্য ফল হিসেবে সামনে আসছে। একটি টেকসই যুদ্ধবিরতির ব্যাপক আবেদন সুস্পষ্ট। এটি হত্যা বন্ধ করবে; রাশিয়া-ন্যাটোর পারমাণবিক অস্ত্র হুমকি বন্ধ করবে; বৈশ্বিক অর্থনৈতিক, জ্বালানি ও খাদ্য সংকট প্রশমিত করবে এবং এক ধরনের শান্তি আনবে। ইউরোপ এবং গ্লোবাল সাউথ বা লাতিন আমেরিকা, এশিয়া, আফ্রিকা এবং ওশেনিয়া অঞ্চলের অনেক দেশ এখনই তাঁর পক্ষে ভোট দেবে।

প্রশ্ন হলো, অন্যায্য আপস কি অনিবার্য? উত্তর হলো– না। তাত্ত্বিকভাবে উভয় পক্ষই এখন স্পষ্ট জিততে পারে। কিন্তু একটি চুক্তি অনুপস্থিত। ‘এই পটভূমিতে সংঘাত অবসানের কূটনৈতিক তৎপরতা স্বাভাবিকভাবেই বাড়ছে’ বলে রিচার্ড হাস, সাবেক প্রভাবশালী এক মার্কিন কূটনীতিক এবং জর্জটাউনের অধ্যাপক চার্লস কুপচান গত সপ্তাহে উল্লেখ করেছেন। তাঁরা বলছেন, ‘পশ্চিমাদের এখনই আরও কিছু করা উচিত, যাতে ইউক্রেন যুদ্ধক্ষেত্রে আরেকটু ভালো অবস্থানে থাকে; এই বছরের শেষের দিকে আলোচনার টেবিলে এটি যাতে গুরুত্ব পায়।’ তাঁরা বলছেন, ‘রাশিয়ার দখলে থাকা ভূমির হস্তান্তরই যুদ্ধের অবসান ঘটানোর সমাধান’– এই অনুযায়ী যুদ্ধবিরতি ‘নতুন করে সংঘাত প্রতিরোধ এবং একটি স্থায়ী শান্তির জন্য মঞ্চ তৈরি করতে পারে।’

ইউক্রেন বিষয়ে পেন্টাগনের ইউক্রেনের মূল্যায়ন এবং আমেরিকার নির্বাচনের সময়সূচি শিগগিরই আলোচনার টেবিলে বসার প্রত্যাশা জাগ্রত করছে। আমেরিকার শীর্ষ জেনারেল মার্ক মিলি বলেছেন, তিনি মনে করেন না, ইউক্রেন এই বছর সব রাশিয়ান বাহিনীকে বিতাড়িত করতে সফল হবে। সম্প্রতি ওয়াশিংটন সফর করে যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা বেন ওয়ালেস বলেছেন, ‘আমাদের বাস্তববাদী হওয়া উচিত। রাশিয়ার পতনের সময়টি কেবল একটি জাদুর কাঠির মুহূর্ত থাকবে না।’ ওয়ালেস নির্লজ্জভাবে দাবি করেছিলেন, তাঁর মিত্ররা নয়; কখন আলোচনা শুরু করবে, তা সিদ্ধান্ত নেবে কিয়েভ। বিপরীতটি সম্ভবত বেশি সত্য। আলোচনার দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য বাস্তব চাপ অন্যান্য মহলে তৈরি হচ্ছে, এমনকি ইইউ কূটনীতিকরা এবং ইউক্রেনের সঙ্গে যোগাযোগে ন্যাটোর দায়িত্বপ্রাপ্তরা এই সপ্তাহান্তে অতিরিক্ত নিষেধাজ্ঞা এবং সামরিক সহায়তা নিয়ে আলোচনা করছেন।

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ চীনকে পুতিনের ওপর প্রভাব খাটাতে অনুরোধ করছেন বলে জানা গেছে। তাইওয়ানের জন্য বেইজিং পরিকল্পনায় তাঁর সম্মতি দেখা যাচ্ছে। জার্মানির অনিচ্ছুক যোদ্ধা ওলাফ শলৎজ সর্বদা জোর দিয়ে আসছেন– কেবল সংলাপই যুদ্ধের অবসান ঘটাবে। বাইডেনের ক্ষমতা নিয়ে উদ্বেগজনক প্রশ্নগুলো ঝুলে আছে। এটা স্পষ্ট যে, ইউক্রেনের নেতাদের কাছে রাশিয়ানদের পরাজিত করার জন্য কয়েক মাস বাকি। এর আগে আলোচনার জন্য আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি হয়। সম্ভবত পুতিন এটি জানেন। এটি তাঁকে নিজের পায়ের তলের মাটি ধরে রাখতে অতিরিক্ত প্রণোদনা দেয়।
এক দল সাবেক সিনিয়র কূটনীতিক গত সপ্তাহে ক্রমাগতভাবে অতি-সতর্ক পশ্চিমা সরকারগুলোকে শেষ পর্যন্ত ‘সব ঝুঁকি গ্রহণ’-এর ওপর জোর দিচ্ছিলেন এবং ‘ইউক্রেনের বিজয়ের পথ প্রশস্ত করার জন্য’ আরও ভালো ট্যাঙ্ক, দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র এবং যুদ্ধবিমান সরবরাহ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। রিচার্ড হাস যেমন আহ্বান জানিয়েছিলেন, ‘পশ্চিমের ইউক্রেন যুদ্ধে না জড়ানোর নীতি থেকে বেরিয়ে আসার সময় এসেছে।’ তবে তিনি বলেছেন, তার পরও অনেক দেরি হয়ে যেতে পারে। অনেক রাজনীতিবিদ অনেক দিন ধরে দোনোমনা করছেন। তাই সবকিছুই ইউক্রেনের আসন্ন আক্রমণের ওপর নির্ভর করছে। বিষয়টি ইতোমধ্যে ‘ইউক্রেনের দীর্ঘতম দিন’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। এর মাধ্যমেই পূর্ব এবং পশ্চিম উভয়ের সঙ্গে দেশটির সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হতে পারে। আপাতত জেলেনস্কিকে ৬৪ শতাংশ ইউক্রেনীয় সমর্থন দিচ্ছে, যিনি অন্তত প্রকাশ্যে বলে বেড়াচ্ছেন– দখলকৃত অঞ্চলের প্রতিটি ইঞ্চি মুক্ত করা হবে।

তবুও তাঁর সৈন্যরা যখন এগোচ্ছে তখন জেলেনস্কি অবশ্যই তাঁর পেছনের মিত্রদের ব্যাপারে রাজনৈতিক হিোবনিকাশ করবেন। নিজেদের সংকট ও যন্ত্রণার অবসান ঘটানোর জন্য ইউক্রেনীয়দের শিগগিরই একটি খুব তিক্ত বড়ি খেতে বলা হতে পারে।


সাইমন টিসডাল: গার্ডিয়ানের পররাষ্ট্র ও যুক্তরাষ্ট্রবিষয়ক সম্পাদক; গার্ডিয়ান থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক