
করোনাকালীন নতুন যে বাস্তবতায় আমরা আটকে পড়েছিলাম ঘরে, সেই সময়ে কীভাবে হয়েছে আমাদের দিনাতিপাত। পিছু ফিরলেই দেখা যাবে কেমন করে দিনের পর দিন কাটিয়ে দিয়েছি চার দেয়ালের মাঝে, কীভাবে আমাদের চারপাশের সূক্ষ্ম ডিটেলগুলো বদলে গেছে। যে সমস্ত সাধারণ বস্তুর মাঝে আমাদের বসবাস ছিল, ব্যস্ত জীবনে হয়তো তাকানোই হয়নি কখনও সেসবের দিকে; কিন্তু করোনার ‘নিউ নরমাল’ জীবনে সেসব অবজেক্টেই হয়তো মিশেল ঘটল বাস্তবতার সঙ্গে কল্পনার।
মহামারি পরিস্থিতির সঙ্গে নিজের ব্যক্তিগত উপলব্ধির এমনই এক উপস্থাপনা করলেন শিল্পী ওয়াকিলুর রহমান। নিত্য যে আবাস, সে আবাসটিই ঘরবন্দি সময়ে হয়ে উঠছিল পরিবর্তিত। ফলে পুনরায় উদ্ভাবন ঘটে শিল্পীর জাগতিক মনস্তাত্ত্বিকের। ঘরের একেকটি কোণ, একেকটি উপকরণ হয়ে উঠল ভাবনার নতুন সব আঙ্গিক। অথবা পুরোনো ভাবনারই নয়া জাগরণ।
কলাকেন্দ্রে ১ এপ্রিলে শুরু হওয়া ‘করোনায়– আত্ম সন্ধান’ প্রদর্শনীটি ওয়াকিলুর রহমানের সেই সময়ের প্রকাশ। ২৫ এপ্রিল অবধি চলেছে এ প্রদর্শনী।
২০২০-এর মার্চের ২২ তারিখ থেকে অর্থাৎ লকডাউন শুরু হবার পর থেকে পরবর্তী ৮১ দিন ওয়াকিলুর রহমান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যামে প্রকাশ করেছিলেন তাঁর ‘Home Object’ সিরিজটি। দেখা যেত, ঘরের সাধারণ কিছু জিনিস; যেগুলো রোজই ব্যবহার করা হয়, রোজ হয়তো একই নিয়মে নড়াচড়া করানো হয়, সেসব জিনিসের ফটোগ্রাফ অথবা স্থানকে ব্যবহার করে এঁকেছেন ছবি। তবে এই ফটোগ্রাফ কিংবা ড্রয়িংগুলোর উপস্থাপনায় ছিল শিল্পীর নিজস্ব ধ্যানধর্মী ছাপ; অর্থাৎ ছবি তোলার জন্যই তিনি ছবি তোলেননি বরং এমনভাবে বিষয়বস্তু সাজিয়েছেন, যেন সেগুলোতে ফুটে ওঠে অন্তর্নিহিত অর্থ।
কিন্তু যেখানে করোনাকালীন সময়েও শিল্পীরা কাজ করেছেন অন্য আরও অনেক মাধ্যম নিয়ে, এঁকেছেন বিশাল বিশাল ক্যানভাসে, ওয়াকিলুর রহমান কেন বেছে নিলেন এই সমস্ত ‘Banal’ বস্তু?
এ ক্ষেত্রে শিল্পীর এই কাজগুলোকে minimalistic চর্চা বলতে গেলেও তাতে প্রশ্ন রয়ে যায়। বরং বলা যেতে পারে এটি শিল্পীর নান্দনিক শৈলীর একটি প্রকাশ মাত্র।
তবে, নেরুদার ‘Odes to Common Things’ এর কথা মনে পড়ে যায় এই প্রদর্শনীর বিষয়বস্তু কিংবা মনস্তাত্ত্বিক চিন্তার দিকে তাকালে। টেবিল, চেয়ার, চামচ, কাঁচি, ভায়োলিন, এমনকি পেঁয়াজ, টমেটোর মতন জিনিস নিয়ে নেরুদা লিখে গেছেন অসামান্য সব সনেট। এখানে এড়িয়ে যাবার মতন সব বিষয় এই ‘Common’ শব্দটি দিয়ে যেন আলাদা ভাবগাম্ভীর্যে প্রকাশ করা হয়েছে। একটা মাটির তৈরি বাসন এখানে কেবলই বাসন নয়, বরং যখন প্রজন্মের পরে প্রজন্মে হস্তান্তরিত হতে থাকে, মাটির এই পাত্রটি তখন অজান্তে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। আমরা বড়জোর তা দৃষ্টিগোচর করি। শিল্পী ওয়াকিলুর রহমানের এই সব Banal বস্তুকে তাঁর শিল্পকর্মের বিষয়বস্তু হিসেবে নির্ধারণ করাকেও হয়তো বলা যেতে পারে একেকটি ode. তাই শুধু মিনিমালিজম বলে ছেড়ে না দিলেই ভালো। কারণ, তিনি নিজেই উল্লেখ করেছেন, করোনার সময়টিতে তিনি সর্বোচ্চ সময় নিজগৃহে থাকার জন্য লক্ষ্য করেছিলেন নিজের জমানো বিভিন্ন জিনিসগুলোকে। যেগুলোর খানিক জায়গা পরিবর্তনে বদলে যাচ্ছে অর্থ। কিংবা ঘরের কোণগুলোতে এসে পড়া আলোয় দেখা আসবাব গুলোর বয়েস, ব্যবহার আর স্থবিরতা যেন বয়ে চলছিল একেকটা সময়ের অস্তিত্ব।
এ ছাড়া নিউ নরমাল সময়টিতে বদ্ধ জীবন হয়তো আমাদের সবাইকেই ভাবিয়েছিল সামনের সময়টি নিয়েও। অনিশ্চিত আবার কিছুটা সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ নিয়ে ভেবেছিলেন শিল্পী নিজেও। প্রকৃতি যেভাবে নতুনভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল সবুজে, একই সাথে শুরুতে চলছিল মিতব্যয়ী জীবনযাপন, এই ভোক্তা সমাজ ব্যবস্থারও একটি আমূল পরিবর্তনের আশা করছিলেন তিনি। সেসবের প্রতিচ্ছবি দেখা যায় তাঁর কাজগুলোতে।
ওয়াকিলুর রহমানের এই সিরিজের প্রথম প্রকাশ করা ছবিটি ছিল একটি ম্যানিপুলেশনের মতন। ঘরের মাঝে ঢুকে পড়েছে মেঘ। আরেকটি ছবিতে মশারির ভেতরেও এক টুকরো মেঘ। অথচ তখনকার বন্দী জীবনে এ রকম পেঁজা মেঘ ঘরে ঢুকে পড়া মানে রূপকার্থে মুক্তিই। আলোছায়ার খেলা, কিংবা একটা কাঠির ছায়ার প্রতিকৃতি হয়তো অনেক দিন এত সময় ধরে মনোযোগ দিয়ে দেখেননি শিল্পী। তাই তখন তা প্রকাশের রূপ পেয়েছিল ভিন্নভাবে।
নিজের দমিয়ে রাখা ভ্রমণের ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় তাঁর স্যুটকেসগুলোর বিন্যাসে, ঝাড়ুগুলোর আলোছায়া আর বিন্যস্ততার কারণে মনে হয় যেন তিনি সাজিয়ে রেখেছেন একগুচ্ছ পেইন্ট ব্রাশ। কালোর পর্দার মাঝে আঁকা উপবৃত্ত, দেয়ালের পাশের চৌকোগুলো একেকটা মনোলিথের মতন। যেসব মনোলিথ পেরোলেই পৌঁছে যাওয়া যেতে পারে অন্য প্রান্তে। তিনি মূলত বারংবারই এঁকে গেছেন নতুন সব সম্ভাবনা। ব্যক্তিগত অনুভূতি, চিন্তার জগতের বাইরেও এই সম্ভাবনা বা আশার জায়গাটা আরও বড় হয়ে ওঠে এখানে।
ব্রিটিশ শিল্পী ট্রেসি এমনই একবার এমন এক অদ্ভুত কাণ্ড করে বসলেন। টানা চার দিন একটা ঘরে বিছানায় শুয়ে কাটিয়ে দিলেন কোনোরকম খাবার কিংবা জল ছাড়া, শুধু অ্যালকোহলে। এ চার দিনে তার ঘর এবং বিছানা জঞ্জাল হয়ে উঠল। সম্পর্ক বিচ্ছেদের হতাশা এবং তাবৎ সমস্যার সবটুকু বহিঃপ্রকাশ দেখা গেল ওইটুকুন বিছানা এবং মেঝেতে। এক বছর পরে Tate Gallery-এর এক প্রদর্শনীতে ভিজুয়াল আর্ট হিসেবে তিনি রাখলেন তার সেই বিছানা, ‘My Bed’. পুরস্কারের নমিনেশন এলো, মিডিয়া ঝাঁপিয়ে পড়ল, এ কেমন শিল্প? একটা অগোছালো, বিতিকিচ্ছিরি বিছানা! বলা হলো, এ শিল্পে সৃজনশীলতার চেয়ে Shock value বেশি কিনা? এর উত্তরও এলো, Some people like the art, some people like being shocked by it.
তবে, এ কথা অগ্রাহ্য করা যাবে না, এই শিল্পকর্মটি মূলত ছিল ‘সময়’। একটি নির্দিষ্ট সময়ের প্রকাশ। শিল্পীর জীবনের একটি ঘটনার সাক্ষ্যপ্রমাণ।
শিল্পে শিল্পীর জীবনদর্শন, জীবনচর্চার প্রতিফলন দেখা যায় নানান ভাবেই। হোক তা আর্ট, কিংবা শক!
আর ঠিক এ কারণেই দুই বছর পর এসে করোনার সময়টির পুনর্বিন্যাস করেন শিল্পী এ সময়ে এসে। কেননা, যে ভবিষ্যতের চিন্তা তিনি করেছিলেন, যে সম্ভাবনাটি তিনি দেখেছিলেন পারিপার্শ্বিক এবং আর্টের ক্ষেত্রে, তেমনটি হয়ে ওঠেনি। আমরা যেন ভুলে গেছি আমাদের করোনার সময়ের জীবনচর্চা, অভ্যাস আর উপলব্ধিগুলো। যেসব অভ্যাস কল্যাণই বয়ে আনত, নিজেকে নিয়ে যেত আত্ম সন্ধানে, সেই সময়টিতে আরেকবার ভ্রমণ করিয়ে আনতেই কিংবা শিল্পের মাধ্যমে সেই ‘শক’টি দিতেই ওয়াকিলুর রহমান আয়োজন করলেন এ প্রদর্শনীর, অবরুদ্ধ দিনের সেই যাত্রাটি একবারে উপস্থাপিত হয় কলাকেন্দ্রের গ্যালারি কক্ষে।
মন্তব্য করুন