- বিনোদন
- ঈদের সিনেমা লাভ-ক্ষতি
ঈদের সিনেমা লাভ-ক্ষতি

মঙ্গলবার রাত ৮টা ৪৫ মিনিট। ফার্মগেটের আনন্দ সিনেমা হলের বাইরে নেই কোনো টিকিট বিক্রেতার হাঁকডাক। একটু ভেতরে প্রবেশ করে চোখে পড়ল, কাউন্টার খালি। অলস সময় কাটাচ্ছেন কর্মীরা। ভেতর থেকে একজন জানালেন, টিকিট লাগবে? ‘না’ বলতেই মলিন মুখে তাকিয়ে রইলেন তিনি। কতজন টিকিট কেটেছিলেন গত শোতে? এমন প্রশ্নের উত্তরে টিকিট বিক্রেতার উত্তর– ৯ থেকে ১০ জন। ৯টার শোতে এর বেশি দর্শক হবে না বলে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি। ওই হলে চলছে ঈদের সিনেমা ‘কিল হিম’। শুধু আনন্দ নয়, মধুমিতা সিনেমা হলে গিয়েও একই চিত্র দেখা যায়। সেখানে চলছে নাদের চৌধুরী পরিচালিত সিনেমা ‘জ্বীন’।
এবারের ঈদ উৎসবে মুক্তি পেয়েছে ৮টি সিনেমা। প্রথম দুই সপ্তাহে সিঙ্গেল স্ক্রিনে দর্শকের ভিড় থাকলে তৃতীয় সপ্তাহে কমেছে। তবে মাল্টিপ্লেক্সগুলোতে দর্শকের চাপ এখনও আছে। ফলে অনেকেই হিসাব কষছেন ঈদ সিনেমার লাভ-ক্ষতি নিয়ে। এবার রেকর্ডসংখ্যক সিনেমা মুক্তি পাওয়ায় শঙ্কা ছিল– কোনো সিনেমা ঠিকমতো ব্যবসা করতে পারবে কিনা! সে শঙ্কা উড়িয়ে দিয়েছেন দর্শক। প্রথম ও দ্বিতীয় সপ্তাহের ব্যবসায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন ঈদ সিনেমার সংশ্লিষ্টরা।
প্রথম দুই সপ্তাহে সব সিনেমার শো ছিল দর্শকপূর্ণ। সিঙ্গেল স্ক্রিনে শাকিব খানের ‘লিডার– আমিই বাংলাদেশ’-এর রাজত্ব ছিল। ছবিটি ১০০ হলে মুক্তি পেয়েছিল প্রথম সপ্তাহে। দ্বিতীয় সপ্তাহেও সমানসংখ্যক হলে দাপটের সঙ্গে চলছে সিনেমাটি। ছবিটি এখন চলছে ২৬টি হলে। প্রেক্ষাগৃহ কমে যাওয়া নিয়ে ‘লিডার– আমিই বাংলাদেশ’-এর পরিচালক তপু খান বলেন, ‘টানা দুই সপ্তাহ সিনেমার ব্যবসায়িক সাফল্য ছিল অভাবনীয়। তৃতীয় সপ্তাহে যদি শতাধিক হলে আমাদের সিনেমা চলে, তাহলে ঈদে মুক্তি পাওয়া অন্য সিনেমা লোকসানের মুখে পড়বে।
সিনেমার রেন্টাল না কমিয়ে হলের সংখ্যা কমিয়েছি।’ সিনেপ্লেক্সগুলোতে বেশি চলেছে ‘কিল হিম’, ‘জ্বীন’, ‘লোকাল’। কেরানীগঞ্জের লায়ন সিনেমাসে চারটি শো চলছে ‘লিডার– আমিই বাংলাদেশ’ সিনেমার; ‘কিল হিম’ ও ‘জ্বীন’-এর শো রয়েছে তিনটি। রাজধানীর যমুনা ব্লকবাস্টার সিনেমাসে পাঁচটি শো পেয়েছে ‘জ্বীন’; ‘লিডার– আমিই বাংলাদেশ’, ‘কিল হিম’ ও ‘লোকাল’-এর প্রদর্শনী সংখ্যা তিনটি। একই প্রেক্ষাগৃহে ‘আদম’-এর দুটি শো চলছে। ঢাকায় স্টার সিনেপ্লেক্সের বিভিন্ন শাখায় চলছে ‘লিডার– আমিই বাংলাদেশ’, ‘কিল হিম’ ও ‘জ্বীন’। স্টার সিনেপ্লেক্সের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক মেসবাহ উদ্দিন আহমেদ বললেন, ‘ঈদে বেশি সিনেমা মুক্তি পাওয়ায় দর্শক তাঁদের পছন্দসই সিনেমা দেখতে পাচ্ছেন। যে তিনটি সিনেমা তাঁদের বেশি পছন্দের, সেগুলোই তৃতীয় সপ্তাহে চলছে। এবারের ঈদের ছবিগুলোর ব্যবসায়িক সাফল্যে আমরা সন্তুষ্ট। এখানে ‘জ্বীন’ সিনেমাটি ভালো চলছে। তারপর রয়েছে যথাক্রমে ‘লিডার– আমিই বাংলাদেশ’ ও ‘কিল হিম’-এর অবস্থান। যমুনা ব্লকবাস্টার সিনেমাসের সহকারী মার্কেটিং ম্যানেজার মাহবুবুর রহমান বলেন, “করোনা-পরবর্তী সময়ে ‘পরাণ’, ‘হাওয়া’ বাংলা সিনেমায় নতুন গতি এনেছে। তবে গত তিন-চার মাস ব্যবসা ভালো যাচ্ছিল না। ঈদের সিনেমা ব্যবসায় গতি এনেছে। প্রযোজকরা তাঁদের টাকা ওঠাতে পেরেছেন। ‘প্রেম প্রীতির বন্ধন’ বাদে ঈদের সাতটি সিনেমা আমাদের হলে চালিয়েছি। তৃতীয় সপ্তাহে দর্শক কমে যাওয়ায় ‘পাপ’ ও ‘শত্রু’ সিনেমার শো রাখিনি। ‘জ্বীন’, ‘কিল হিম’, ‘লিডার– আমিই বাংলাদেশ’ ভালো চলছে। তবে এ প্রেক্ষাগৃহে এখন পর্যন্ত ব্যবসায়িক সাফল্যে ‘জ্বীন’ এগিয়ে রয়েছে। ‘আদম’, ‘লোকাল’ অ্যাভারেজ ব্যবসা করছে। চতুর্থ সপ্তাহে সব সিনেমাই চলবে প্রেক্ষাগৃহে।’
‘পাঠান’ নিয়ে নতুন অঙ্ক
‘পাঠান’ মুক্তি নিয়ে বেশ কয়েক মাস ধরেই তোড়জোড় চলছিল। বিশ্বজুড়ে তাণ্ডব চালানো সিনেমাটি অবশেষে বাংলাদেশে মুক্তি পাচ্ছে আগামীকাল। মুক্তি উপলক্ষে শুরু হয়েছে অগ্রিম টিকিট বিক্রি। দেশের সবচেয়ে বড় স্টার সিনেপ্লেক্স মাল্টিপ্লেক্স চেইনে প্রতিদিন ‘পাঠান’-এর ৩৪টি শো চলবে। রাজধানীর আরেকটি মাল্টিপ্লেক্স ‘ব্লকবাস্টার সিনেমাস’-এ প্রতিদিন ৯টি শো চলবে ‘পাঠান’-এর। এ ছাড়া পুরান ঢাকার লায়ন সিনেমাস, বগুড়ার মধুবন, শ্যামলী, চট্টগ্রামের সিলভার স্ক্রিনে এবং গ্র্যান্ড সিলেট হোটেল মুভি থিয়েটারে শো প্রদর্শিত হবে। ‘পাঠান’-এর কারণে ঈদের সিনেমাগুলোর ব্যবসায় কিছুটা হলেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন সিনেমা-সংশ্লিষ্ট অনেকেই।
প্রতিযোগিতা থাকা ভালো
মুশফিকুর রহমান গুলজার (পরিচালক ও বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সাবেক সভাপতি)
ঈদে প্রিয় নির্মাতা ও অভিনয়শিল্পীর সিনেমা দেখতে প্রেক্ষাগৃহে ঢল নামে দর্শকের। পাড়া-মহল্লায় চলে নানা আলোচনা। রাস্তার মোড়ে মোড়ে নতুন সিনেমার পোস্টার। সিনেমার ভালো-মন্দ নিয়ে হয় চুলচেরা বিশ্লেষণ। এসব যেন আজ হারাতে বসেছে। দীর্ঘদিন সিনেমা পরিচালনা করে আসছি। সময়ের পরিক্রমায় অনেক কিছুর সাক্ষী হয়েছি। এবার ঈদে আটটি সিনেমা মুক্তি পেয়েছে। সংশ্লিষ্টরা সিনেমা নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেও ব্যবসায়িক দিক থেকে অনেক সিনেমা ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে বলে শুনেছি। হল না পেয়ে এক সিনেমার নির্মাতা তো কেঁদেই ফেলেছেন। ঈদে যদি সিনেমার সংখ্যা কম, অর্থাৎ চারটি মুক্তি পেত, তাহলে বেশি হল নিয়ে সিনেমাগুলো চলত। প্রযোজকরা লাভবান হতেন। প্রতিযোগিতা থাকা ভালো, তবে যে প্রতিযোগিতা সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির জন্য শুভ কিছু বয়ে নিয়ে আসে না, সেই প্রতিযোগিতায় লিপ্ত না হওয়াই ভালো। শুনেছি, এখনই কোরবানির ঈদের সিনেমা মুক্তি নিয়ে প্রস্তুতি চলছে। আসছে ঈদে যেন সিনেমা মুক্তির হিড়িক না পড়ে– এ বিষয়ে সবারই খেয়াল রাখা দরকার। সিনেমা ব্যবসায়িক দিক থেকে লাভবান হলে চলচ্চিত্রশিল্পের জন্যই মঙ্গল। নতুন নতুন প্রযোজক সিনেমায় বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন। তৈরি হবে ভালো ভালো সিনেমা।
ব্যবসা নয়, প্রচারণাই মুখ্য
খোরশেদ আলম খসরু( চলচ্চিত্র প্রযোজক ও প্রযোজক সমিতির সাবেক সভাপতি)
ঈদে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমার সংখ্যা আটটি। এত সিনেমা কেন একসঙ্গে মুক্তি পাবে? কেউ কারে নাহি ছাড়ে, সমানে সমান– এ রকম একটি অবস্থা! এমনিতেই এখন হলের সংখ্যা মাত্র ৪০টি। মৌসুমি হল খোলা হয়েছিল ১২০টি। ঈদের একটি সিনেমাই ১০০ হল পেয়েছে। বাকি সিনেমা চলার জন্য হল কোথায়? এ সহজ বিষয়টি অনেকের মাথায় নেই। সিনেমাগুলো যদি বছরজুড়ে মুক্তি পেত, তাহলে সব সিনেমা ভালো চলত বলে আমি মনে করি। প্রযোজক ব্যবসা পেতেন। ঈদে সিনেমা নিয়ে আসতেই হবে– এই মানসিকতা পরিহার করা উচিত। কিছু কিছু সিনেমা ভালো ব্যবসা করেছে। হল থাকলে অন্য সিনেমাগুলোও ভালো চলত। যাঁরা ঈদে সিনেমা মুক্তি দিয়েছেন তাঁরা মনে করেছিলেন, ঈদে মুক্তি দিলে আলোচনায় থাকবেন। ব্যবসা তাঁদের কাছে মুখ্য নয়, প্রচারণাই বড়। যখন বাংলাদেশে ৪০০ হল ছিল, তখনও এত সিনেমা আসত না। ঈদ ছাড়াই আগে একেকটি সিনেমা থার্টি ফাইভে ৮০-৯০টি করে প্রিন্ট হতো। ৮০টি হলে মুক্তি পেত সিনেমা। দুই সিনেমা মুক্তি পেলে দেড়শ হল পেত। যখনই প্রযোজক ও পরিবেশক এক ব্যক্তি হয়েছেন, তখনই সিনেমা কেমন চলছে– তা সাধারণ মানুষের বোঝার বাইরে চলে গেছে। আগে সিনেমা নির্মাণের পর ডিস্ট্রিবিউটররা কিনে নিতেন। লাভ-লোকসান তাঁদের ছিল। তখন সত্যটা জানা যেত। সিনেমার ব্যবসা জানার জন্য বক্স অফিস প্রয়োজন। প্রযোজক, পরিবেশক কিংবা হল মালিকের কথায় নির্ভর করে পূর্ণ চিত্র পাওয়া যায় না। বক্স অফিস কার্যকর থাকলে অনেকে প্রযোজনায় আগ্রহী হতেন।
নিজেদের ক্ষতি নিজেরাই করেছি
ইফতেখার নওশাদ (মধুমিতা হলের কর্ণধার)
ঈদে সিনেমা দেখতে দর্শক এমনিতেই আসেন। এটা সাধারণ চিত্র। ঈদে বেশ বিরতির পর শাকিব খানের সিনেমা মুক্তি পেয়েছে। তরুণ প্রজন্মের দর্শক এটি বেশি দেখেছেন। হলে হলে দর্শকের ভিড় ছিল। তবে সব মিলিয়ে বলব, ব্যবসা ভালো হয়নি। আটটি সিনেমা মুক্তির বিষয়টি মোটেও ভালো লাগেনি। বেশিসংখ্যক সিনেমা মুক্তি দিয়ে নিজেদের ক্ষতি নিজেরাই করেছি। এটি ঠিক হয়নি। ‘পাঠান’ সিনেমা মুক্তির দু-তিন সপ্তাহ পর হল তো খালি থাকবে। সারাবছর তো পড়েই থাকবে। ঈদে মুক্তি না দিয়ে অন্য সুবিধাজনক সময়ে সিনেমা মুক্তি দিলে ভালো হতো। একটি ছবিকে ব্যবসাসফল বলতে হলে অনেক সপ্তাহ চলতে হবে। তাহলে টাকা উঠবে। সিনেমা ভালো চলা এককথা আর টাকা উঠে আসা অন্য বিষয়। ঈদ সিনেমা-সংশ্লিষ্ট অনেকে বলছেন, তাঁদের সিনেমার ব্যবসা ভালো হয়েছে। এটা আমি মানতে নারাজ। না বুঝেই তাঁরা এটি বলছেন। তাঁদের কাছে অর্থনৈতিক বিষয়টির চেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে প্রচারের বিষয়টি। এখন যিনি প্রযোজক, তিনিই পরিবেশক। ফলে ব্যবসার প্রকৃত চিত্রটা পাওয়া যায় না।
মন্তব্য করুন