প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক নুরুল ইসলামের প্রয়াণে আমরা যদ্রূপ শোকে স্তব্ধ, তদ্রূপ শূন্যতায় চঞ্চল। যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসির স্থানীয় সময় সোমবার রাত্রিতে তিনি যখন হৃদরোগে আক্রান্ত হইয়া শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন, তখন শেষ বৈশাখের ভ্যাপসা গরমের ঢাকায় সেই খবর আবহাওয়াকে যেন আরও ভারাক্রান্ত করিয়া তুলিয়াছিল। এই কীর্তিমান বাঙালির মৃত্যু সংবাদ কীভাবে সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে গভীর শ্রদ্ধা ও প্রাণঢালা ভালোবাসা উৎসারিত হইয়াছে, আমরা দেখিয়াছি। ঢাকা ব্যতিরেকে কলকাতা, লন্ডন, নিউইয়র্কের ন্যায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় বাঙালি অধ্যুষিত বৈশ্বিক নগরগুলিতেও নামিয়াছিল শোকের ছায়া। আবেগের ঊর্ধ্বে উঠিয়া স্বীকার করিতে হইবে, বাঙালির গড় আয়ুর অনুপাতে অধ্যাপক নুরুল ইসলাম পরিণত বয়স অতিক্রম করিয়াই প্রয়াণ লাভ করিয়াছেন। ইহাও অনস্বীকার্য, তিনি জীবনের প্রায় অন্তিম দিবস পর্যন্ত যদ্রূপ বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা করিয়া গিয়াছেন, তদ্রূপ বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত বাঙালি অর্থনীতিবিদগণকে পরামর্শ দিয়াছেন। বর্তমানে দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রায় সকল অর্থনীতিবিদের তিনি ছিলেন শিক্ষক। প্রত্যক্ষ শিক্ষকতা ছাড়িয়া দিলেও পরোক্ষ পাঠদানে তিনি ব্যাপ্ত থাকিয়াছেন। যেই কারণে এই দেশে তাঁহাকে ‘অর্থনীতিবিদগণের অর্থনীতিবিদ’ বলিয়া আখ্যা দেওয়া হইত। আমরা বিশ্বাস করি, অধ্যাপক নুরুল ইসলাম শারীরিকভাবে চিরপ্রস্থান করিলেও জীবন ও কর্ম দিয়া তিনি আমাদের মধ্যে নিঃসন্দেহে চিরস্মরণীয় হইয়া থাকিবেন। সমকালের পক্ষ হইতে আমরা তাঁহার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা এবং পরিবারবর্গের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করিতেছি।

অধ্যাপক নুরুল ইসলামের বিদায়ে বেদনার মধ্যেও স্বস্তির বিষয় হইতেছে– তিনি একটি সার্থক জীবন যাপন করিয়াছেন। সেই পঞ্চাশের দশকে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যায় প্রতিষ্ঠানে উচ্চশিক্ষা লাভ করিয়াও তিনি দেশে প্রত্যাবর্তন করিয়াছিলেন। ব্যক্তিগত লাভালাভের পরিবর্তে দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণকর অর্থনীতির অনুসন্ধান এবং উহা অপরকে জানাইবার কাজে আজীবন উৎসর্গিত ছিলেন। যদিও ষাটের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক হিসেবে তাঁহার পেশাজীবনের সূচনা এবং তথায় স্বল্পকালের মধ্যেই প্রতিষ্ঠা পাইয়াছিলেন; তিনি শুধু শিক্ষকতায় নিজেকে সীমিত রাখিতে চাহেন নাই। পরাধীন আমলে করাচিতে পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিকস-পিআইডিই প্রতিষ্ঠা হইলে তিনি উহার প্রধান হিসেবে যোগদান করেন। উন্নয়ন ও অর্থনীতিবিষয়ক গবেষণার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ওই প্রতিষ্ঠান তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তরের ক্ষেত্রে তাঁহার অবদান অবিস্মরণীয়। স্বাধীনতার পর তিনি প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের উপপ্রধানরূপে যদ্রূপ জাতীয় ক্ষেত্রে, তদ্রূপ জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এবং খাদ্যনীতিবিষয়ক সংস্থা ইফপ্রিতে কর্মের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অবদান রাখিয়াছেন।

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও উহার প্রেক্ষাপট তৈরিতে অধ্যাপক নুরুল ইসলামের বিশেষ অবদানের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ্য। পিআইডিইর প্রধানরূপে দায়িত্ব পালনকালেই তিনি পাকিস্তানের দুই অংশের অর্থনৈতিক বৈষম্য লইয়া সচেতন হইয়া ওঠেন। একই সময়ে ‘বাঙালির ম্যাগনাকার্টা’ বলিয়া বিবেচিত ঐতিহাসিক ৬-দফা প্রস্তাব উত্থাপন করিয়াছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ৬-দফার ভিত্তিতে অর্থনৈতিক পরিকল্পনার নিমিত্তে অর্থনীতিবিদের লইয়া যেই প্যানেল বঙ্গবন্ধু গঠন করিয়াছিলেন, উহার প্রধান ছিলেন অধ্যাপক নুরুল ইসলাম। মুক্তিযুদ্ধের সূচনায় তিনি যুক্তরাষ্ট্রে গিয়া স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনকার্যে ব্যাপৃত হন। পঁচাত্তরের মর্মান্তিক পটপরিবর্তনের পর তিনি আর দেশে প্রত্যাবর্তন করেন নাই বটে; প্রবাসে থাকিয়াই দেশের অর্থনীতির জন্য যেই সকল পরামর্শ দিয়াছেন; গ্রন্থ ও নিবন্ধ লিখিয়াছেন; বিভিন্ন সভা-সেমিনারে বক্তব্য রাখিয়াছেন; সামাজিক ও রাজনৈতিক উদ্যোগে পরামর্শ দিয়াছেন, সেইগুলি অতুলনীয়। বড় কথা, অধ্যাপক নুরুল ইসলাম তাঁহার আদর্শ ও বিশ্বাসের সহিত কখনও আপস করেন নাই। জীবনের প্রায় সর্বক্ষেত্রে ঋজুতা দিয়া তিনি অর্জন করিয়াছিলেন সার্বজনীন শ্রদ্ধা। আমরা মনে করি, তাঁহার সার্থকতা, সততা, নিষ্ঠা, দেশপ্রেম, জীবনাদর্শ যেইরূপ পরবর্তী প্রজন্মকে পথ দেখাইয়া চলিয়াছে, সেইরূপ ভবিষ্যতেও চলিতে থাকিবে।