
সিরিজ : মেটামরফসিস, শিল্পী :: আলপ্তগীন তুষার
‘Journey’ শিরোনামে গ্যালারি কায়া’তে শিল্পী আলপ্তগীন তুষারের যে একক প্রদর্শনী শুরু হয়েছে ৫ মে, এই প্রদর্শনীর নামটিই একটি অনুসন্ধানের মতো। কারণ, এই যাত্রাতেই অনুভব করা যেতে পারে শিল্পীর ভাবনা আর তত্ত্ব। এই আলোচনা তাই শুধু সেই যাত্রার প্রতি অনুসন্ধিৎসা।
বিগত পঞ্চাশ বছরে কী করে শিল্পীর এই ‘একক প্রদর্শনী’টি হয়ে ওঠেনি, এই প্রশ্নই মাথায় আসতে পারে প্রথম। শিল্পী আর্ট কলেজে পড়াশোনা করেছেন ঢাকা, দিল্লি এবং জাপানে। তাই সময়, সমাজ এবং মনস্তাত্ত্বিক বদলের কারণেই তিনি এঁকে গেছেন একটানা, নানান মাধ্যমে, নানান চিন্তা থেকে। তাই বিথোভেনের মতো আলপ্তগীন তুষারের কাজও বিগত দিনগুলোর জরা, আনন্দ আর চেষ্টার প্রতিচ্ছবি।
এই প্রদর্শনীর মোট ৮৭টি কাজ যদি একটানা দেখা হয়, সেখানে প্রাতিষ্ঠানিক অনুশীলন, পোর্ট্রেট কিংবা মুখাবয়বে দক্ষতা অথবা স্টিল লাইফের ক্লাসিক্যাল প্রভাব চোখে পড়ে। অথচ এই শিল্পী কাজ করেছেন ‘Metamorphosis’, ‘Catharsis’ কিংবা ‘Light & Dark’-এর মতো সিরিজ নিয়ে। যেখানে উঠে আসে সমাজ, সংঘর্ষ, পরিত্রাণ, এমনকি মহাকাল। তবে কেন তাঁর প্রথম একক প্রদর্শনীতে সে সমস্ত পরিণত সিরিজ উপস্থাপন না করে তিনি বরং বেছে নিলেন বছর চল্লিশেক আগের কাজও? এখানেই তাঁর প্রদর্শনীর নামের সার্থকতা।
আমরা ভাবতে পারি একটি যুবকের কথা। যে বেড়ে উঠেছে একরকম উত্তাল সময়ে। নিজের সমাজ আর দূরের পৃথিবীর মূল্যবোধগুলো নানাবিধ বিভীষিকায় থইথই। এসবের মাঝে তিনি যখন আর্ট কলেজে পড়ছেন, ভাবনার নানান দিকের উন্মোচন নিশ্চয়ই হচ্ছিল তখন থেকেই। কেননা, আমরা সেসবের প্রতিফলন দেখি তাঁর পরবর্তী সময়ের কাজগুলো থেকে। তবু যে সৌন্দর্যবোধের চর্চা তিনি করেছেন, সেই চর্চার সময়কালটি বোধ হয় তিনি প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন সর্বপ্রথম। তাই তিনি শুরু করলেনই ‘শুরু’ থেকে।
আলপ্তগীন তুষার তাঁর ‘নাচোল বিদ্রোহ’ নিয়ে আঁকা ছবিগুলোতে চারকোলে করা সাঁওতাল নরনারীর শরীরে যে গতিশীলতা এঁকেছেন, সেটি সময়ের প্রয়োজনে আঁকা গতি। কিংবা ধর্ষণের বিরুদ্ধাচরণ করে তাঁর আঁকা ছবিগুলোতে যে নির্ভয় আর তীব্রতা দেখা যায়, সেসবের ঠিক বৈপরীত্য রয়েছে অন্য অনেক কাজে। সেখানে ব্রাশের স্ট্রোক হয়েছে শান্ত, তাড়াহীন। তাই যুদ্ধ কিংবা বিদ্রোহ অথবা অবক্ষয়ের ছবিগুলো আঁকতে গিয়ে যে শিল্পীর চিরাচরিত ধরনটিও বদলে যায়, এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
প্রদর্শনীর ছবিগুলোর চেয়ে বরং শিল্পীর অন্য কাজগুলো নিয়ে বেশি আলোচনা করার পথটি বোধ হয় শিল্পীই দেখালেন সূক্ষ্মভাবে। নতুবা তিনি অন্য কাজগুলোর মাঝে তাঁর Light & Dark সিরিজের কাজটি হয়তো রাখতেন না। এতে করে আমরা পেয়ে গেলাম নতুন এক চিন্তার উৎস। তাই হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ সেই কাজটির সামনে গিয়ে কারও মনে হতেই পারে, এখানেই শেষ নয়। শিল্পী নিজেকে গড়েছেন যেমন, ভেঙেও দেখেছেন একই সঙ্গে। তাই তাঁর সৃষ্টিও নানারূপ।
জাপানে যাওয়ার পরে বক্স আকারের ত্রিমাত্রিক কাজগুলো কিংবা ‘Catharsis’-এর উজ্জ্বল আলোর নারী অবয়বের ছবির পর যখন Metamorphosis সিরিজের ছবি দেখা হয়, স্বভাবতই ধাক্কা লাগে। হয়তো একটু অন্যরকমও হতে পারে, তবু এটুকু অনুমান করা যায়, চারপাশে চলা অবিরাম অবিচার, ঘৃণা আর নিজের বিলীন হওয়ার যে গোলকধাঁধা, সেসবের প্রতিচ্ছবিই এই সিরিজটি। যেখানে শিল্পীর দেশ বিভাজিত, সমাজ বিভাজিত, সেখানে তিনি নিজেকেও কল্পনা করেন দ্বিখণ্ডিত হিসেবে। তাই এমন ছবিও তিনি এঁকেছেন। এই ছবিগুলো দেখলে গয়ার সেই বাকরুদ্ধ সময়ের কথা মনে আসে, যখন সে উদ্ভ্রান্তের মতো এঁকে গেছে রোমান্টিক আর কিছুটা পরাবাস্তববাদী ছবি।
‘Green’ নামের সিরিজটি আলপ্তগীন তুষারের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ; যেটি এখনও চলমান। এই সময়ে পৃথিবীকে যে রকম ক্রমাগত ধ্বংসই করা হচ্ছে, তার প্রতিকার শিল্প কী করে করতে পারে? শিল্পের উদ্দেশ্য এখানে কী করে সিদ্ধ হয়? আলপ্তগীন তুষার এই সিরিজে গাছরূপী যে নারীদের এঁকেছেন, তাঁদের অর্ঘ্যদান করা হচ্ছে নানাভাবে, যেটাই মূলত করার কথা ছিল। বরঞ্চ আমরা গাছ দিয়ে বানানো কুঠার দিয়েই কাটছি গাছ। এমন নির্মমতা যখন মুখে বলে বোঝানো যায় না, তখন সেসব শিল্পীর তুলির ভাষায় উঠে আসে।
এই প্রদর্শনীর ছবিগুলোয় মনস্তাত্ত্বিক চিন্তার চেয়ে উন্মেষের যাত্রাটিই ফুটে ওঠে অনেক বেশি। যেমন, মাতিসের কাজগুলোর পূর্ববর্তী যে সময়, সে সময়টি তুলে ধরা হয়েছিল বলেই বোঝা গিয়েছিল, তাঁর শুরু কী থেকে, আর উদ্দেশ্য বা পরিণতি কোথায় গিয়ে? এ ক্ষেত্রে আলপ্তগীন তুষারের গন্তব্য কোথায়? তিনি নিজে মনে করেন তাঁর Light & Dark-এর ছবিগুলো এক ধরনের পরিণতি। অর্থাৎ জীবনের ভালো-মন্দের বোঝাপড়ার একটি প্রকাশ। যেখানে দিনের আলোর এসে অন্ধকার সরিয়ে দেয়। আবার কোনোটিই উপেক্ষা করা সম্ভব নয়।
তবে এই যে ‘যাত্রা’, এই যাত্রায় তিনি তো একটানা কোথাও কোনো ধরন বা Style-এ স্থির রইলেন না। বরং সময়ের গতি এবং নিজের মানসিক চিন্তা যে সময় যেদিকে নিয়ে গেছে, তিনি কেবল হেঁটেছেন। তাঁর বিভিন্ন সময়ের ছবিগুলোর ধরন এই যাত্রাপথে কেবল একেকটা স্টেশনের মতো। যেখানে তিনি থামেন কিন্তু তাঁর যাত্রা জারি থাকে। এই পথিকের পথ থেকেই বোঝা যায়, তাঁর গন্তব্য তিনি খুঁজে নেবেন তাঁর বিভিন্ন পর্বের তুলির মতোই। সময়ের সঙ্গে চলমান হয়ে। আজ ১৯ মে প্রদর্শনীর শেষ দিন।
মন্তব্য করুন