কিছু হলেই বন কাটা হচ্ছে, পাহাড় কাটা হচ্ছে, গাছ কাটা হচ্ছে উল্লেখ করে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, ‘যেদিকে তাকাই পরিবেশ ধ্বংস করা হচ্ছে। কেউ চিন্তাও করে না গাছ-বন-পাহাড় না কেটে কেমন করে উন্নয়ন করা যায়।’ 

তিনি বলেন, ‘আমাদের আন্দোলন চলবে, গাছ পাহারা চলবে। এ আন্দোলন কেবলমাত্র সাতমসজিদ রোডের নয়, শুরু হয়েছে এ রোড থেকে। এ আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়বে। বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে যুব সমাজ আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। আমরা তাদের সঙ্গে নিয়ে দেশব্যাপী বৃক্ষ ও প্রাণ বাঁচানোর সংগ্রাম ছড়িয়ে দেব।’

রোববার ধানমন্ডির সাতমসজিদ সড়কে গাছ কাটা বন্ধের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দোয়েল চত্বর থেকে মিছিল নিয়ে নগর ভবন ঘেরাও করতে যান আন্দোলনকারীরা। বঙ্গবাজার মোড়ে ব্যারিকেড দিয়ে তাদের আটকে দেয় পুলিশ। মিছিল থেমে যাওয়ার পর এক ফাঁকে সমকালকে এসব কথা বলেন সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।

বেলার প্রধান নির্বাহী বলেন, ‘মেয়র কেন আমাদের যৌক্তিক কর্মসূচিতে বাধা দিয়েছেন তা জানি না। তাকে মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করা আমাদের কাজ না। তবে আমরা যেটা বুঝি, জবাবদিহিতার জায়গা থেকে তিনি জনগণের মুখোমুখি হতে একেবারেই প্রস্তুত নন। যদিও তিনি গণমাধ্যমে বলেছেন গাছ কাটার পর সাতমসজিদ রোডে যানচলাচলের গতি অনেক বেড়ে গেছে। আমার মনে হয়, তার সিদ্ধান্তটা অত্যন্ত অজনপ্রিয়। সেটাও তিনি বুঝেছেন। অজনপ্রিয় সিদ্ধান্তের স্বপক্ষে দাঁড়ানোর মতো তার কাছে কোনো যুক্তি নেই। তাহলে তিনি কেমন করে আমাদের মুখোমুখি হবেন? যুক্তি নেই বলেই মেয়র পিছিয়ে পড়েছেন এবং আমাদের যুক্তির মুখোমুখি হতে চান না।’

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘মেয়রের উচিত ছিল প্রথমেই আমাদের মুখোমুখি হওয়ার। তার সিদ্ধান্তটা কেন যৌক্তিক, আর আমাদের সিদ্ধান্তগুলোই কেন যৌক্তিক তা দেখা দরকার ছিল। কিন্তু তিনি কোনো আগ্রহ দেখাননি। আজ আমরা ঘেরাও কর্মসূচি দিয়েছি বলে আমাদের প্রতিনিধি দলকে নগর ভবনে যেতে বলা হয়েছে। আমরা যাইনি। কারণ, তার আগে আমরা নগর ভবনে দেখা করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু তখন তারা আমাদের সঙ্গে দেখা করেননি। আমরা স্মারকলিপি দিয়ে এসেছিলাম। তারপর গত ২১-২২ দিন ছেলে-মেয়েগুলো রাস্তায় গাছ পাহারা দিচ্ছে। তিনি একবারও নগরপিতা হয়ে ছেলে-মেয়েগুলোর দায়িত্ব নেওয়ার কোনো প্রয়োজন বোধ করেননি। তারা কোথায় ঘুমায়, কোথায় খায়, কোথায় তাদের প্রয়োজন মেটায়- এ দায়িত্ববোধটুকুও মেয়র দেখাননি।’

পরবর্তী কর্মসূচি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমরা একটা কর্মসূচি নিয়ে এসেছি। পরবর্তীতে আমরা কী করব তা সকলে মিলে বসে সিদ্ধান্ত নেব। আমি একা এ সিদ্ধান্ত নিতে পারব না। মেয়র তার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবেন- এমন ঘোষণা যতক্ষণ না আসবে, ততক্ষণ আমাদের আন্দোলন চলবে, গাছ পাহারা চলবে। এ আন্দোলন কেবলমাত্র সাতমসজিদ রোডের নয়, শুরু হয়েছে এ রোড থেকে। এ আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়বে।’

সাতমসজিদ সড়কে গাছ কাটা বন্ধে আইনের আশ্রয় নেওয়া হবে কি না- এমন প্রশ্নে বেলার প্রধান নির্বাহী বলেন, ‘আইন দিয়ে আমরা সকল সমস্যার সমাধান চাই না। আমরা যে আন্দোলন করছি, তা আইনের মধ্যে থেকেই করছি। আইনের পরিসীমার মধ্যে থেকে সুশৃঙ্খলভাবে জনগণের সাংবিধানিক অধিকার রক্ষার আন্দোলন করছি। শেষ পর্যন্ত মেয়র কিংবা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বিরুদ্ধে মামলা করব কি না সেটা আমরা আন্দোলনের মধ্য থেকেই সিদ্ধান্ত নেব। কারণ, এটা আসলে বাঁচা-মরার লড়াই হয়ে গেছে। খালি একটা কোর্টের আদেশের মাধ্যমে এই বাঁচা-মরার লড়াই নির্ভর করে না। আমরা সকলে মিলে একটা সচেতনতা তৈরি করব। ফলে আন্দোলনটা জিইয়ে রাখার প্রয়োজনীয়তা দেখি।’

আন্দোলন থেকে মেয়রের পদত্যাগের দাবিতে স্লোগান দেওয়া হচ্ছে- এ বিষয়ে জানতে চাইলে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘একজন প্রশাসক যদি জনগণের যৌক্তিক দাবি শোনারই মানসিকতা না রাখেন এবং তিনি যদি মনে করেন আস্তে-ধীরে কথা বলে এটা পাস কাটিয়ে যাওয়া যাবে... উনার ঠিকাদার যে বুদ্ধি দেবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সেই বুদ্ধিতেই কথা বলবে- আমরা তো সেটা মানব না। স্পষ্টতই তার পদত্যাগের দাবির মাধ্যমে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিষয়ে আমাদের যে দাবি ছিল সেটি আমরা তুলে ধরেছি। তাদেরকে আমরা পরিবেশগতভাবে সংবেদনশীল মনে করি না।’

তিনি বলেন, ‘যে নগর ব্যবস্থাপনা পরিবেশগতভাবে সংবেদনশীল নয়, তার জন্য আমি আমার করের টাকা দেব কি দেব না, সে সিদ্ধান্ত নিশ্চয়ই আমার। সে জায়গা থেকেই আমরা পদত্যাগের দাবি তুলছি। এটা কোনো রাজনৈতিক দাবি নয়। গ্রহণযোগ্যতার দিক থেকে আমরা মনে করি মেয়রের পরিবেশ সংবেদনশীলতা একেবারেই নেই। সাতমসজিদ রোডে মানুষকে ছায়া দেওয়া গাছগুলোকে কেটে বাগান বিলাসের গাছ লাগিয়েছে। সেখানে কামিনী গাছ লাগানো হয়েছে। এটা আমাদের সঙ্গে কী ধরনের উপহাস? এটাতো আমাদের করের টাকা, উনার নিজের পয়সা তো নয়। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে কী টাকা বানানোর ছাপাখানা আছে যে, ছাপাখানা থেকে টাকা বানিয়ে এসব করবে? তাহলে আমাদের জবাব দিতে ভয় কোথায়? সে অবস্থান থেকেই আমরা পদত্যাগের ঘোষণা চেয়েছি।’

রাজধানীর ধানমন্ডির সাতমসজিদ সড়কে গাছ কাটা বন্ধের দাবিতে প্রায় ২০ দিন ধরে নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে চলছে আন্দোলন। রোববার দোয়েল চত্বর থেকে নগর ভবন ঘেরাও করতে যাওয়ার পথে বঙ্গবাজারের সামনে আন্দোলনকারীদের থামিয়ে দেয় পুলিশ। এ সময় সড়কে অবস্থান নিয়েই স্লোগান দিতে থাকেন তারা। এমন পরিস্থিতিতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) একটি প্রতিনিধি দল আন্দোলনকারীদের সঙ্গে দেখা করে। ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী মিজানুর রহমান আন্দোলনকারীদের জানান, দাবিগুলো তিনি মেয়রকে জানাবেন। তবে তিনি সুস্পষ্ট কোনো আশ্বাস দেননি। পরে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে দক্ষিণ সিটির নগর ভবন ঘেরাও কর্মসূচি শেষ করা হয়।