এখন ফেসবুক খুললেই হরেক বিজ্ঞাপন। এই ভিড়ে শিশু বিক্রিরও বিজ্ঞাপন চলছিল। তাতে সাড়া দিলেন নিঃসন্তান এক দম্পতি। এর পর দিনদুপুরে নগরের গলি থেকে ৩ বছরের এক শিশুকে উঠিয়ে নেওয়া হলো। ওই শিশু বিক্রির চুক্তি হলো দুই লাখে। পুলিশি উদ্যোগে শিশুটি শেষমেশ উদ্ধার হয়। অপহরণকারীরাও ধরা পড়ে। (সমকাল, ২৩ মে, ২০২৩)।
বাংলাদেশে ৪০ লাখের বেশি অনাথ শিশু রয়েছে। অনাথ ও পরিত্যক্ত শিশুদের জন্য সমাজসেবা অধিদপ্তরের ছোটমণি নিবাস আছে। আর আছে ১৮ঌ০ সালের অভিভাবক ও প্রতিপাল্য আইন। নিঃসন্তানের হাহাকার আছে সন্তানের জন্য। অনাথ-পরিত্যক্ত শিশুদেরও চাই পরিবার। এর পরও সমাজ, আইন ও রাষ্ট্রের মানবিক সমন্বয়ের অভাবে শিশু অপহরণের মতো অপরাধ সংঘটিত হলো।

প্রতিবেশী দেশের দিকে যদি তাকাই, দুই দত্তক কন্যাসন্তান নিয়ে বলিউড অভিনেত্রী সুস্মিতা সেনের আবেগ সব সময়ই টইটম্বুর। বড় মেয়েকে ২০০০ সালে যখন দত্তক নিয়েছিলেন তখন মোটে ২০ পেরিয়েছেন সুস্মিতা। ২০১০ সালে তাঁর কোলে আসে আরেক দত্তক কন্যা। ওদের কাছে কিছুই লুকোছাপা নেই। কন্যাদের ভালোবাসায় সিক্ত সুস্মিতা তাই বলতে পারেন, দত্তক নেওয়া তাঁর জীবনের সেরা সিদ্ধান্ত।   

ব্র্যাড পিট ও অ্যাঞ্জেলিনা জোলিকে নিয়ে কথা বলা মানে তাঁদের ছয় সন্তানের কথাও আসবে। এর মধ্যে তিন সন্তান দত্তক নিয়েছেন তাঁরা। গায়ের রং কালো বলে অনেকে দত্তক নেয়নি যে শিশুটিকে, তাকে নিজের করে নেন সানি লিওন। দত্তক কন্যাসহ তিন সন্তানকে নিয়ে মা সানি লিওনের মুখে এখন সবসময় প্রশান্তির হাসি।

এক শিশুকে কুড়িয়ে এনে পরে দত্তক নিয়েছিলেন সালমান খানের বাবা। মেয়েটি পারিবারিক নাম পেয়েছে, উচ্চশিক্ষা পেয়েছে,  ব্যক্তিস্বাধীনতা পেয়েছে, আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছে। সালমানের স্নেহের বোন অর্পিতা খানই হলো সেই দত্তক নেওয়া শিশুটি।
ভারত, আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, জাপানসহ অনেক দেশে সন্তান দত্তক নিতে ‍আগ্রহীদের জন্য আইন আছে। ভারতে নারী ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে দেশের মধ্যে ও আন্তঃদেশীয় দত্তক নিয়ে কাজ করে সেন্ট্রাল অ্যাডপশন রিসোর্স অথরিটি (সিএআরএ)। সংস্থাটির ওয়েবসাইটে প্রতি বছরের দত্তক পরিসংখ্যান আছে। ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত ৩ হাজার ১৪২ জন শিশুকে দত্তক নেওয়া হয়েছে। সিএআরএ জরিপ বলছে, পশ্চিমবঙ্গেও ২০২১-২২ সালে ২২৯ জন শিশুকে দত্তক নেওয়া হয়েছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের চিত্র কী? এতিম, পরিত্যক্ত শিশু গ্রহণ করার উদাহরণ বহু বছর ধরেই দেখা যায় দেশে। যে কোনো দুর্ঘটনায় আলোচিত শিশুকে নিতে আগ্রহীদের লাইন ধরার খবর দেখেছি সংবাদমাধ্যমে। কিন্তু এ দেশে সরকারি-বেসরকারি সূত্রে দত্তকবিষয়ক পরিসংখ্যান মেলা দুষ্কর। পরিসংখ্যান না থাকলেও হাসপাতালগুলোতে গমগম করা ফার্টিলিটি, গাইনোকলজি বিভাগ বলে দেয় সন্তান আকাঙ্ক্ষীদের গল্প। আশপাশে কান পাতলেই শোনা যায়, ডায়াবেটিস, হরমোন কিংবা থাইরয়েড বা পিরিয়ড সমস্যা, মানসিক চাপ, এন্ডোমেট্রিওসিস সমস্যায় সন্তান নিতে গিয়ে হতাশ হচ্ছেন কত দম্পতি!

মেডিকেল শতকরা সম্ভাবনা যত অল্পই দিক, সন্তান পেতে বিশেষ করে বিত্তবানরা আইভিএফ বা টেস্টটিউব বেবি আর বিদেশে চিকিৎসায় উজাড় হাতে অর্থ ঢালেন। এসব না পারলে কেউ হয়তো শিশু কেনাবেচার হাটে সন্তান খোঁজেন।
পশ্চিমবঙ্গেও আইনগতভাবে সন্তান দত্তক নিতে সচেতন করার উদ্যোগ রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে দত্তকে উৎসাহ দিয়ে কোনো প্রচারণা নেই। 

একাত্তরের পর দেশে যুদ্ধশিশুদের জন্য দত্তক আইন করা হয়। নানা প্রেক্ষাপটে এ আইন স্থগিত হয় আশির দশকে। তাই বলে দত্তক নিতে হাহাকার থেমে যায়নি। কিন্তু পুরোনো অভিভাবক ও প্রতিপাল্য আইনে ভগ্ন মনোরথ হচ্ছেন– এমন উদাহরণ জরিপ করলে বহু মিলবে।    
অনেকে ধর্মীয় কারণে দত্তক নিতে নিরুৎসাহিত করেন। ধর্মে পালক সন্তানের প্রকৃত বাবা-মায়ের পরিচয় মুছে না দিতে বলা আছে। কিন্তু বিদেশে সামাজিকভাবেই দত্তক সন্তানের পরিচয় লুকিয়ে রাখার চর্চা উঠে গেছে। সন্তানরা স্পষ্ট জানে নিজের জন্ম ও দত্তক ইতিহাস। বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচএম এরশাদের পালিত ছেলে ও মেয়ে রয়েছে– এ কথাও গোপন নয়। তাদের নামে এরশাদের নামও যুক্ত রয়েছে।

আরব নিউজে পড়েছিলাম, সৌদিতে এতিমখানায় নয়, শিশুর অভিভাবকত্ব নিতে পরিবারগুলোকে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। সরকারি নিবন্ধন ও খোরপোশ সুবিধাও রাখা হচ্ছে। ২০১৭ সালে ৮ হাজার ৪১২ জন শিশুকে দত্তক নেওয়া হয়। ২০২০ সালে ৮ হাজার ৬৯৪টি পরিবার সন্তান দত্তক নেয় বলে তথ্য দিয়েছিল সৌদি সরকার। মালয়েশিয়াতে মুসলমানদের জন্য দত্তক আইন ছিল না। পরে এ জটিলতা নিরসনে আরেকটি আইন করে কোনো শিশুর অভিভাবকত্ব নেওয়ার পথ সুগম করা হয়।  

দত্তক আইনের সুযোগ নিয়ে শিশু পাচার হতে পারে– এমন ‘আশঙ্কা’ রয়েছে।  কিন্তু দত্তক আইন না থাকায় বরং পরিস্থিতি খারাপ দিকেই মোড় নিচ্ছে। হাসপাতাল থেকে শিশু চুরি, নবজাতক বদল, অভাবে শিশু বিক্রি, শিশু অপহরণ নতুন কোনো ঘটনা নয়। দত্তক নেওয়ার সুস্থ পারিবারিক-সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পথ না থাকায় বাড়ছে লোভ ও অপরাধের মিশেলে অবৈধ পথে শিশু লেনদেন। ‘ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দিয়ে শিশু বিক্রি’ শিরোনামে সমকালের খবরটি তো সে কথাই স্পষ্ট করল।  
বায়োলজিক্যাল মা ও শিশুর সম্পর্ক আম্বিলিকাল কর্ড দিয়ে। বায়োলজিক্যাল বাবা মানে শিশুর সঙ্গে ক্রোমোজোমের সম্পর্ক। কিন্তু মাতৃত্ব-পিতৃত্ব শুধু জিনগত অনুভূতি নয়। একুশ শতকে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ শুধু ঔরসজাত শিশুকে নিজের মনে করলে এই মাতৃত্ব-পিতৃত্ব চিরন্তন নয়। সুস্মিতা সেন বিশ্বাস করেন, দত্তক নেওয়া সন্তানের সঙ্গে হৃদয় দিয়ে যোগাযোগ হয়, যে সম্পর্কের দৃঢ়তা কখনও কাটা যায় না।

নিঃসন্তান দম্পতি, ডিভোর্সড নারী-পুরুষ, সিঙ্গেল ফাদার-মাদার, এমনকি অবিবাহিত নারী-পুরুষকে সহজভাবে দত্তক নিতে দেওয়া মানবিক রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সন্তান দত্তক নেওয়া অপরাধ নয়। দত্তক সন্তানের প্রতি সমাজ, পরিবারের আত্মীয়দের বাঁকা চোখই অপরাধ। নিজের সন্তান থাকলেও বিত্তবান পরিবারকে দত্তক নিতে উদ্বুদ্ধ করা চাই।
সামাজিক সংকীর্ণতা কাটাতে তাই দত্তক আইন ফিরিয়ে আনা হোক এখনই। সরকারি ওয়েবসাইটে থাকতে হবে দত্তক পরিসংখ্যান। দত্তক শিশুর পারিবারিক অধিকার নিশ্চিতে আন্তর্জাতিক সমাজের কথা জানা চাই। দত্তক নিয়ে সর্বস্তরে মন খুলে আলাপ শুরু হোক। দত্তক নিয়ে কাটুক নারী-পুরুষ, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের যত জড়তা ও কুসংস্কার।

আইরিন সুলতানা: লেখক ও অধিকারকর্মী