- বিনোদন
- বিএসটিআইতে ঝুঁকি ভাতার নামে প্রতারণা
বিএসটিআইতে ঝুঁকি ভাতার নামে প্রতারণা

ঝুঁকি ভাতার নামে সরকারের পণ্যমান নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বিএসটিআইর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তিন বছরে ১০৭ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তরের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে এ ভাতা বন্ধের সুপারিশ করা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ থেকে এই ভাতা বেআইনি উল্লেখ করে বন্ধের আদেশ দেওয়া হলেও তা মানা হয়নি।
ঝুঁকি ভাতার নামে সরকারি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগটি অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এরই মধ্যে তাঁরা এ-সংক্রান্ত নথিপত্র সংগ্রহ করেছে।
জানা গেছে, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) মোট জনবলের ৩০-৪০ শতাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারী ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন। তাঁদের বড় একটি অংশ পণ্যমান পরীক্ষা গবেষণাগারে কর্মরত আছেন। এ ছাড়া যাঁরা পণ্যমান যাচাই করতে অভিযান পরিচালনা করেন, তাঁরাও ঝুঁকির আওতাভুক্ত। তবে ঝুঁকি ভাতা পাচ্ছেন এর বাইরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও। বিএসটিআইর বর্তমান কর্মকর্তা-কর্মচারী ৪৪৮ জন।
সূত্র জানায়, বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তর বিএসটিআইর ২০১৮-১৯, ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরের কার্যক্রমের নিরীক্ষা শেষে ভাতা বন্ধের সুপারিশ করেছে। অধিদপ্তর থেকে নিরীক্ষা প্রতিবেদন বিএসটিআই কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এক আদেশে এই ভাতা বন্ধের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এর পরও ভাতা বন্ধের কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।
বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তরের নিরীক্ষায় বলা হয়, বিএসটিআইর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বেআইনিভাবে তাঁদের মূল বেতনের (বেসিক) সমপরিমাণ ঝুঁকি ভাতা গ্রহণ করছেন। তাঁরা ওই তিন অর্থবছরে ভাতার নামে ১০৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
অর্থ বিভাগ গত বছরের ৫ জুন বেআইনি ঝুঁকি ভাতা বন্ধের আদেশ দিয়ে একটি চিঠি পাঠিয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে। চিঠিতে বলা হয়, বিএসটিআই তার নিজস্ব আয়ের ৪০ শতাংশ অর্থের কিছু অংশ পেনশন তহবিল ও কল্যাণ তহবিলে স্থানান্তর করে থাকে। অবশিষ্ট অর্থ সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর মাঝে ঝুঁকি ভাতা হিসেবে প্রদান করা হচ্ছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের সংশোধিত ও ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রাক্কলিত বাজেট সভায় বিএসটিআইর ঝুঁকি ভাতার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। ওই সময় ঝুঁকি ভাতা প্রদানে প্রশাসনিক অনুমোদন-সংক্রান্ত কাগজপত্র ও তথ্যাদি পর্যালোচনা করা হয়। তাতে দেখা যায়, বিএসটিআইর সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর মূল বেতনের সমপরিমাণ ঝুঁকি ভাতা প্রদানে যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হচ্ছে, সেই প্রক্রিয়ায় এই হারে ঝুঁকি ভাতা প্রদানের কোনো সুযোগ নেই।
এ ছাড়াও ঝুঁকি ভাতার বিষয়ে যেসব কাগজপত্র অর্থ বিভাগে সরবরাহ করা হয়েছে, তার অধিকাংশই অস্পষ্ট। চিঠিতে আরও বলা হয়, সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে যে হারে ঝুঁকি ভাতার নামে অর্থ প্রদান করা হচ্ছে, তাতে অর্থ বিভাগের সম্মতি নেই। অবিলম্বে এই ভাতা বন্ধ করার পাশাপাশি প্রকৃত ঝুঁকি ভাতার আওতাভুক্তরা যাতে ভাতা সঠিকভাবে পান, সেই লক্ষ্যে নীতিমালা তৈরি করে অর্থ বিভাগের সম্মতির জন্য পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে ওই চিঠি গত বছরের ৬ জুন বিএসটিআইর মহাপরিচালকের কাছে পাঠানো হয়। সূত্র জানায়, অর্থ বিভাগের ওই নির্দেশনার পরও ঝুঁকি ভাতা বন্ধ করা হয়নি, বরং অর্থ বিভাগের ওই চিঠি চ্যালেঞ্জ করে বিএসটিআইর সহকারী পরিচালক মো. তুহিন আহমেদ হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। এই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট গত বছরের ২০ ডিসেম্বর এক আদেশে অর্থ বিভাগের ঝুঁকি ভাতা বন্ধের নির্দেশনামূলক চিঠির কার্যকারিতা স্থগিত করেন চলতি বছরের ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত। তাতে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ২৫ থেকে ২৭ ক্যাটাগরির মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ গ্রহণ অব্যাহত আছে।
বিএসটিআইর পরিচালক (প্রশাসন) মো. তাহের জামিল এ প্রসঙ্গে সমকালকে বলেন, ১৯৫৬ সাল থেকে ঝুঁকি ভাতা চালু রয়েছে। তখন বিএসটিআইর কার্যক্রম সেন্ট্রাল টেস্টিং ল্যাবরেটরি (সিটিএল) নামে পরিচালিত হতো। প্রতিষ্ঠানের সব পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীর মাঝে বেতন-ভাতার সমতা বজায় রাখতে বিএসটিআই কাউন্সিল এই ভাতার অনুমতি দিয়েছে। বিএসটিআইর নিজস্ব আয় থেকে এই ভাতা প্রদান করা হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, ঝুঁকি ভাতার নামে সরকারি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগটির অনুসন্ধান চলছে। এরই মধ্যে এ-সংক্রান্ত নথিপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে। অনিয়ম, দুর্নীতি ও আইন লঙ্ঘনের প্রমাণ পাওয়া গেলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
সূত্র জানায়, বিএসটিআই পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণকারী গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পণ্যের মান নির্ণয় ও তথ্য প্রকাশ করা। পণ্যের মান নিয়ে গবেষণা করে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে অবগত করা এবং তা বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা, সে ব্যাপারে তদারকি করা। বিএসটিআইর গবেষণা অনুযায়ী, সরকারি-বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো উৎপাদন পর্যায়ে পণ্যমান কার্যকর করছে কিনা– এ নিয়ে তদারকি করা হচ্ছে না। বিএসটিআই এই মূল কাজটি না করে পণ্যের মান দেখার জন্য এখতিয়ারবহির্ভূতভাবে বিভিন্ন সময় শপিংমল, মার্কেট, দোকানে অভিযান পরিচালনা করছে। প্রকৃতপক্ষে বড় বড় শপিংমল, বাজারের পণ্য বিক্রেতারা ওইসব পণ্য উৎপাদনের সঙ্গে কোনোভাবেই জড়িত নয়। পিপিআর লঙ্ঘন করে ঠিকাদারকে অর্থ প্রদান: বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তরের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারের ক্রয়সংক্রান্ত আইন (পিপিআর) লঙ্ঘন করে দরপত্র মূল্যায়নে বাতিল হওয়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বিএসটিআই সদরদপ্তরের প্রশাসনিক ভবনের বর্ধিত চতুর্থ তলা নির্মাণের কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছিল। দরপত্রের শর্তে অংশগ্রহণকারী কোম্পানির ১ কোটি টাকার লিকুইড অ্যাসেট থাকার কথা ছিল। এই পরিমাণ অর্থ কার্যাদেশ পাওয়া ঠিকাদার মেসার্স রূপালী কনস্ট্রাকশনের ছিল না। এই দরপত্রে অংশ নেওয়া অন্য দুই কোম্পানি মেসার্স লাবণী এন্টারপ্রাইজ ও মেসার্স আতাউর রহমান অ্যান্ড কোম্পানির ১ কোটি টাকা করে লিকুইড অ্যাসেট থাকলেও এই দুটির একটিকেও কার্যাদেশ দেওয়ার জন্য বিবেচনা করা হয়নি। স্বজনপ্রীতি করে বেআইনিভাবে রূপালী কনস্ট্রাকশনকে কার্যাদেশ দিয়ে পিপিআরের বিধি ৯৮(২) লঙ্ঘন করা হয়েছে।
মন্তব্য করুন