গানে গানে ৬০ বছর
১২ বছরে গান গাওয়া শুরু, রুনা লায়লা সম্পর্কে রইলো অজানা তথ্য

গানে গানে ৬০ বছর কাটিয়ে দিলেন রুনা লায়লা।
রাসেল আজাদ বিদ্যু
প্রকাশ: ২৪ জুন ২০২৪ | ১৩:৪৪ | আপডেট: ২৪ জুন ২০২৪ | ১৪:০০
গানে গানে অগণিত শ্রোতার হৃদয় জয় আর পথচলার ছয় দশক পূর্ণ করলেন নন্দিত কণ্ঠশিল্পী রুনা লায়লা। ১৯৬৪ সালের এই দিনে [২৪ জুন] ‘জুগনু’ সিনেমার গানে প্রথম কণ্ঠ দেন তিনি। মাত্র ১২ বছর বয়সে গাওয়া ‘গুড়িয়া সি মুন্নি মেরি ভাইয়া কি পেয়ারি’ উর্দু গানটির কথা লিখেছিলেন তিসনা মেরুতি, আর সুর করেছিলেন মানজুর। প্রথম গানের অনিন্দ্য কণ্ঠ আর অনবদ্য গায়কী দিয়ে তিনি মুগ্ধ করেছেন শ্রোতাদের। সেই সুবাদে এ শিল্পীর কাছে বাড়তে থাকে সংগীতপ্রেমীদের প্রত্যাশা। যে কারণে আর থেমে থাকার অবকাশ পাননি রুনা লায়লা। গানের ভুবনে শুরু হয় তাঁর দুর্বার পথচলা, যা ছয় দশক পরেও থেমে যায়নি। শিল্পীজীবনের এই দীর্ঘ সফরে রুনা লায়লা ১৮টি ভাষায় গেয়েছেন ১০ হাজারের বেশি গান। নিজেকে নিয়ে গেছেন কিংবদন্তিদের কাতারে। পেয়েছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতি, রাষ্ট্রীয় পদকসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা। কণ্ঠশিল্পী হিসেবে ছয় দশকের মাইলফলক স্পর্শ করা নিয়ে রুনা লায়লা বলেন, ‘আমি ভীষণ ভাগ্যবতী যে শুরু থেকে এখন পর্যন্ত কোটি কোটি মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। এখনও গান গাইতে পারছি, সুর করছি, এটাই অনেক বড় বিষয়। তাই আজীবন সংগীতের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রাখতে চাই।’
রুনা লায়লার সংগীত জীবনের অধ্যায়ে এমন অনেক বিষয় যুক্ত হয়েছে, যা একদিকে যেমন বিস্ময়কর, তেমনি গর্বের। তাঁর জীবন অধ্যায়ের ঘটনাগুলো এটাও প্রমাণ করে তিনি মানবিক, দেশপ্রেমী এবং স্পষ্ট করে তোলে কেন তিনি তাঁর কালের শ্রেষ্ঠ শিল্পী। এবার স্মরণীয় এবং অবাক করার মতো তেমনি কিছু ঘটনা তুলে ধরা যাক–
# ১৯৬৪ সালের মাত্র ১২ বছরে বয়সে ‘জুগনু’ সিনেমায় মধ্য দিয়ে প্লেব্যাক শিল্পী হিসেবে অভিষেক হয় রুনা লায়লার। মজার বিষয় হলো এই সিনেমায় রুনা লায়লার বড় বোন দীনা লায়লাও প্লেব্যাক করেছিলেন।
# মুক্তিযুদ্ধের আগেই রুনা লায়লা দেশীয় বাংলা সিনেমায় প্লে-ব্যাক করেন। ১৯৭০ সালের ২৯ মে মুক্তি পাওয়া ‘স্বরলিপি’ সিনেমায় তিনি গেয়েছিলেন ‘গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে’ শিরোনামের গানটি; যা তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা এ গানের সুর করেছিলেন সুবল দাস।
# রুনা লায়লা প্রথম বাংলা গান গেয়েছিলেন পাকিস্তান রেডিও ট্রান্সক্রিপশন সার্ভিসে। দেবু ভট্টাচার্যের সুরে তাঁর গাওয়া গান দুটি ছিল ‘নোটন নোটন পায়রাগুলো’ আর ‘আমি নদীর মতো পথ ঘুরে’।
# পাকিস্তানের অসংখ্য সিনেমায় প্লেব্যাক করেছিলেন রুনা লায়লা। পাকিস্তান টেলিভিশনেও নিয়মিত গান করেছেন। যার সুবাদে অল্প সময়েই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। তারপরও পাকিস্তান ছেড়ে স্বাধীন বাংলাদেশের ফিরে আসতে এতটুকু দ্বিধা করেননি। দেশপ্রেমের কারণে পাকিস্তানে গড়ে ওঠা সংগীত ক্যারিয়ার নিয়ে এক মুহূর্ত ভাবেননি।
# ১৯৮২ সালে ‘হিজ মাস্টার ভয়েজ’ থেকে বাপ্পী লাহিড়ীর কম্পোজিশনে প্রকাশ পায় ‘সুপার রুনা’ অ্যালবামটি। এ অ্যালবামের শৈলী সাইলেন্দ্রর লেখা ‘শোনো শোনো মেরি ইয়ে কাহানি’, অঞ্জনের লেখা ‘হাইয়া হো’, ‘দে দে পেয়ার দে’ গানগুলো শ্রোতাদের মাঝে দারুণ সাড়া ফেলেছিল।
# রুনা লায়লা একমাত্র বাংলাদেশি শিল্পী হিসেবে প্রথম বলিউডে প্লেব্যাক করেন। ১৯৭৪ সালে সংগীত পরিচালক জুটি কল্যাণজি-আনন্দজির সুরে ‘এক সে বড়কর এক’ বলিউড সিনেমায় প্লেব্যাক করেন তিনি। তাঁর গাওয়া ‘ও মেরা বাবু চেল চাবিলা’ গানটি ভারতসহ বিভিন্ন দেশে তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। এর পর ‘জান-এ বাহার’, ‘ ইয়াদগার’, ‘ ঘর দুয়ার’, ‘অগ্নিপথ’, ‘স্বপ্ন কা মন্দির’সহ আরও বেশকিছু ভারতীয় সিনেমায় তিনি প্লেব্যাক করেছেন।
# ভারতীয় সিনেমায় প্লেব্যাক এবং কনসার্ট ছাড়াও ‘দ্য গ্রেট বিগ ইন্ডিয়ান ওয়েডিং’ শিরোনামের একটি সংগীত আয়োজনে পাঞ্জাবি বিয়ের গান গেয়েছেন রুনা লায়লা। দিল্লিতে গিয়ে রেকর্ড করেছিলেন নির্বাচিত আটটি গান।
# কণ্ঠশিল্পী হিসেবে বিশ্বজুড়ে পরিচিতি পেলেও রুনা লায়লা শুরুতে নৃত্যশিল্পী হতে চেয়েছিলেন। ছোটবেলায় পাকিস্তানের বুলবুল একাডেমি অব ফাইন আর্টসে ভর্তিও হয়েছিলেন তিনি। নাচের তালিমও নিয়েছেন অনেক দিন।
# বোন দীনা লায়লার স্মৃতিতে শিশু হাসপাতালে ওয়ার্ড নির্মাণ, অনুদান দেওয়াসহ বিভিন্ন শিল্পী দুঃসময়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন রুনা লায়লা। এ ছাড়া জনসচেতনতামূলক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বিভিন্ন সময়।
# নন্দিত অভিনেতা ও নির্মাতা আলমগীর পরিচালিত ‘একটি সিনেমার গল্প’ সিনেমায় সুরকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন রুলা লায়লা। এবং প্রথম সিনেমাতেই সুরকার হিসেবে পান জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। তাঁর সুরে ‘গল্প কথা কল্পলোকে’ গানটি গেয়ে শেষ্ঠ কণ্ঠশিল্পীর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান শিল্পী আঁখি আলমগীর।
# সিনেমার পাশাপাশি রুনা লায়লার সুরে একটি মিশ্র অ্যালবাম তৈরি হয়েছে। যেখানে গেয়েছেন ভারতের কিংবদন্তী কণ্ঠশিল্পী আশা ভোঁসলে, হরিহরণ, পাকিস্তানের নন্দিত শিল্পী আদনান সামি ও রাহাত ফতেহ আলী খান।
# গানের পাশাপাশি ‘শিল্পী’ সিনেমায় অভিনয় করে দর্শকদের নজর কাড়েন রুনা লায়লা। দেশীয় এ সিনেমার অভিনয়ের আগেও ভারত ও পাকিস্তানে অভিনয়ের প্রস্তাব পেয়েছিলেন তিনি।
# কনকর্ড নামের একটি প্রতিষ্ঠানের চারটি অ্যালবামের জন্য গান গাইতে মুম্বাই গিয়েছিলেন রুনা লায়লা। চার অ্যালবামের ৪০টি গানের মধ্যে এক দিনেই কণ্ঠ দিয়েছিলেন ৩০টিতে। এক দিনে ৩০ গানের রেকর্ড করে ‘গিনেস বুক অব রেকর্ডসে’ নাম লিখিয়েছিলেন এই কণ্ঠশিল্পী।
# ভারতীয় টিভি চ্যানেল স্টার জলসা রুনা লায়লার জন্মদিন উপলক্ষে ‘কে আপন কে পর’ সিরিয়ালের একটি বিশেষ পর্ব নির্মাণ করেছিল। পর্বটি ২০১৯ সালের শিল্পী জন্মদিনে প্রচার করা হয়।
# ভাইনাল রেকর্ড, অডিও ক্যাসেট, সিডি, ভিসিডি থেকে শুরু করে অনলাইনে প্রকাশ পেয়েছে রুনা লায়লার অ্যালবাম এবং একক ও দ্বৈত গান। স্টেজ, টিভি, রেডিওতে যেমন গেয়েছেন, তেমনি সিনেমায় প্লেব্যাকের পাশাপাশি কণ্ঠ দিয়েছেন নাটকের গানেও। এক কথায় ছয় দশকে সংগীতের প্রতিটি মাধ্যমেই শোনা গেছে তাঁর মাদকতায় ভরা, শ্রুতিমধুর কণ্ঠস্বর। এবং এখনও তাঁর গায়কী ও সংগীতচর্চা অব্যাহত রয়েছে।
- বিষয় :
- রুনা লায়লা
- সংগীতশিল্পী