গল্প বলার স্বাধীনতা চাই: আশফাক নিপুণ

নির্মাতা আশফাক নিপুণ
আশফাক নিপুণ
প্রকাশ: ১৫ আগস্ট ২০২৪ | ১২:৪৯ | আপডেট: ১৫ আগস্ট ২০২৪ | ১৯:৪৬
একজন চিত্রনাট্যকার ও নির্মাতা হিসেবে নতুন সরকারের কাছে প্রথমেই গল্প বলার স্বাধীনতা চাই। একটি মানবিক সমাজ কিংবা বৈষম্যমূলক রাষ্ট্রের জন্য দুটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বলা যায়, অনেকটা মৌলিক চাহিদার মতো। সেগুলো হলো– ‘ফ্রিডম অব স্পিচ’ ও ‘ফ্রিডম অব আর্ট’।
আমাদের এই দুটি বিষয়ের চর্চা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। কারণ এই দুটি বিষয়ের চর্চা যখন ব্যাহত হয়, তখন রাষ্ট্র কাঠামোগতভাবে যতই উন্নত হোক না কেন, সে রাষ্ট্রের আদতে কোনো উন্নয়নই হয়নি। আমরা যদি বিশ্বের বড় বড় দেশের দিতে তাকাই, তাহলেই বিষয়টি বোঝা যাবে। বিশেষ করে যদি আমরা ফ্রান্সের দিকে তাকাই, তাহলে বুঝতে পারবে। অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য কিন্তু মানুষ ফ্রান্সকে চেনে না। চেনে শিল্পের শহর বা শিল্পীদের শহর হিসেবে। তাই নতুন সরকারের কাছে প্রথমেই চাই গল্প বলার স্বাধীনতা।
গত ১৫ বছর ধরে বা তারও আগে থেকেই আমাদের সব ধরনের গল্প বলার ক্ষেত্রে বাধা ছিল। গত ১৫ বছরে দেশে গল্প বলার স্বাধীনতা না থাকার কারণে অনেক নির্মাতার সিনেমা সেন্সর বোর্ডে আটকে আছে। যেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো– এনামুল করিম নির্ঝরের ‘নমুনা’, মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘শনিবার বিকেল’, সাজ্জাদ খানের ‘কাঠগোলাপ’, রায়হান রাফির ‘অমীমাংসিত’সহ আরও কয়েকটি। আর এমনটা হোক চাই না। আমরা চাই সেন্সর বোর্ড পুরোপুরিভাবে উঠে গিয়ে একটা সার্টিফিকেশন বোর্ড হোক। যারা নির্ধারণ করে দেবেন, সিনেমাটি কোন বয়সী দর্শকদের জন্য উপযোগী। এটা আমাদের জন্য খুবই দরকার। নতুন সরকার বা এর পর যারা আসবেন, তাদের কাছে এটা আমাদের প্রত্যাশা। শিল্পীরা সবসময় কিন্তু সমাজের কথা বলেন। কিন্তু যখন একজন শিল্পী তাঁর মনের ভাব প্রকাশ করতে পারেন না, তখন তিনি সমাজের কথা বলতে পারেন না। সমাজ তখন বিকলাঙ্গ হয়। ফলে শিল্পীদের মনের ভাব প্রকাশের সুযোগ দিতে হবে।
এখানে একটি উদাহরণ দিতে যাই, ১৯৭৪ সালে দেশের প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদিন দুর্ভিক্ষের ছবি এঁকেছিলেন। কিন্তু সেই ছবি আঁকার জন্য কিন্তু তাঁকে কোনো শাস্তি পোহাতে হয়নি বা দেশের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন হয়নি। তিনি দেশের তখনকার অবস্থা তুলে ধরেছিলেন। আমরাও চাই, এ ধরনের ভয়ের সংস্কৃতিতে যেন আমাদের গল্প বলতে না হয়।আমি ওটিটি মাধ্যমের জন্য ‘মহানগর’ ও ‘মহানগর ২’ নির্মাণ করেছি। কিন্তু এই সিরিজটি বানাতে আমাকে অনেক সেল্ফ সেন্সরশিপ করতে হয়েছে। তাতেও কিন্তু পোষায়নি। সিরিজটির জন্য আমাকে অনেক ধরনের ঝামেলর মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। সঙ্গে ছিল টেনশন, তুলে নিয়ে যাওয়া, হাজিরা দেওয়ার মতো নানা কিছু।
সুতরাং আমি চাই না নতুন সরকারের আমলে বা নির্বাচন-পরবর্তী যে সরকারই আসবে, তাদের আমলে একই ধরনের অভিজ্ঞতা আর কারও হোক। আর আমরা যদি একটা গণতান্ত্রিক সমাজ গড়তে চাই, তাহলে আমাদের ‘ফ্রিডম অব স্পিচ’-এর চর্চা করতে হবে। কথা বলতে দিতে হবে। তীব্র সমালোচনাকারীর কথাও শুনতে হবে বা তাঁর কথা বলার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। একটা রাষ্ট্রের কাছে যদি সমালোচনাকারী নিরাপদ না থাকেন, তাহলে সেই রাষ্ট্র একটা ব্যর্থ রাষ্ট্র।
আমরা দেখেছি, ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট’ প্রথমে তৈরি করা হয়েছিল ডিজিটাল অন্যায়গুলো রুখে দেওয়ার জন্য। কিন্তু সেটা সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে সাংবাদিক এবং সাধারণ মানুষের ওপর। শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখালেখির কারণে বা কার্টুন এঁকে প্রতিবাদ করার কারণে। এসবের কারণে পুলিশ কাস্টোডিতে ন্যক্কারজনকভাবে অনেকের মৃত্যু হয়েছে বা অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে জেলে জীবন কাটাতে হয়েছে। এই যে ভয়ের সংস্কৃতি, তা আর না থাকুক আমাদের দেশে। হ্যাঁ, প্রবল সমালোচনার মুখে ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট’ পরিবর্তন করে ‘সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট’ করা হয়েছে। আর বলা হচ্ছে, এটা জনগণবান্ধব। কিন্তু বিগত বছরগুলোতে আমরা দেখে এসেছি, যখনই শাসকদের হাতে এমন আইন থাকে, তখন সেটা জনগণের টুঁটি চেপে ধরার জন্য প্রয়োগ করা হয়। আমাদের দেশে নীতিমালা তৈরি এক ধরনের শৃঙ্খলা আনার অজুহাতে। কিন্তু শৃঙ্খলটা পরিয়ে দেওয়া হয় শিল্পী বা সাধারণ মানুষের হাতে।
সুতরাং অবিলম্বে সেন্সর বোর্ড প্রথা উঠিয়ে দিয়ে নিয়ে আসতে হবে সার্টিফিকেশন বোর্ড। যে কোনো ধরনের সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট বাতিল করতে হবে। দেশের সব ধরনের মানুষকে কথা বলতে দিতে হবে। কারণ কথা বলা আমাদের মৌলিক অধিকার। মানুষ যখন তাঁর নিজের কথা বলতে পারেন না, তখন ভেতরে ক্ষোভ হয়। এই ক্ষোভ জমতে জমতে এক দিন বিস্ফোরণ ঘটে। আর সেটা কিন্তু আমরা মাত্র কয়েকটি দিন আগেই দেখিছি।
এখন আমাদের দেশ গড়ার সময়। আমাদের এখন সবচেয়ে কঠিন কাজ, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র তৈরি করতে হবে। আমরা চাই না, আমাদের ভেতরে সেই ক্ষোভ জমে জমে বিস্ফোরণ ঘটুক। আমরা চাই কথা বলা, সিনেমা নির্মাণ, কবিতা লেখা, কার্টুন আঁকা বা শিল্পচর্চার জন্য আমরা যে কোনো রকম বাধার সম্মুখীন না হই।
- বিষয় :
- সিনেমা