ঢাকা শুক্রবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৫

গাড়ির বডি ও স্পেয়ার পার্টস উৎপাদন বাড়ছে যশোরে

গাড়ির বডি ও স্পেয়ার পার্টস উৎপাদন বাড়ছে যশোরে

তৌহিদুর রহমান, যশোর

প্রকাশ: ২৯ জুলাই ২০২২ | ১২:০০

বাইরে থেকে খুব একটা বোঝা না গেলেও কারখানার ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ল বিশাল কর্মযজ্ঞ। ছোট্ট পরিসরের এই কারখানায় কর্মব্যস্ত অন্তত ৫০ শ্রমিক, যেন দম ফেলার সময় নেই কারও। লোহার টুংটাং আর মেশিনের জোরালো শব্দে কাজের ফাঁকে নিজেদের মধ্যে কথা বলারও নেই সুযোগ। গাড়ির স্প্রিংপাতি তৈরির কাজে মনোযোগী কারখানার কর্মীরা।
যশোর উপশহরে এসকে মেটাল ইন্ডাস্ট্রিজ নামে কারখানাটির মালিক কামরুল হাসান সোহেল জানালেন, শিক্ষাজীবন শেষে চাকরি নিয়েছিলেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। পরে চাকরি ছেড়ে তিন বছর আগে গড়ে তোলেন কারখানাটি। এখন মাসে আড়াই থেকে তিন হাজার পিস স্প্রিংপাতি উৎপাদন করছেন তাঁরা। চায়না ব্র্যান্ড এস পিকআপ, টিকিং পিকআপ, জেক ও আইশার পিকআপে ব্যবহার হচ্ছে তাঁদের উৎপাদিত স্প্রিংপাতি।
যশোর বিসিক শিল্পনগরীর এনায়েত ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে গিয়ে দেখা গেল কর্মযজ্ঞ আরও বিশাল। গাড়ির ব্রেকড্রাম, পেসারপ্লেট, গিয়ারবক্স, ব্রেকডিস্ক, ইঞ্জিন হাউজিং, হ্যাঙ্গার, গিয়ার বক্সের বডি থেকে শুরু করে ৮-১০ ধরনের স্পেয়ার পার্টস তৈরি হচ্ছে সেখানে। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী আক্তার হোসেন জানালেন, দেশে গাড়ির পার্টস উৎপাদনে শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি এই কারখানা। এখানে শতাধিক ব্র্যান্ডের গাড়ির বেশ কয়েক ধরনের স্পেয়ার পার্টস উৎপাদন করা হয়। ৫০০ থেকে ৫ হাজার টাকা মূল্যমানের এসব পার্টস বিক্রি হয় সারাদেশে।
যশোর শহরের বকচর, হুশতলা, বিসিক, মুড়ালী, চাঁচড়াসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় এরকম আট শতাধিক অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ রয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তির মেশিনারির ব্যবহার ছাড়াই আগেকার দিনের হাতুড়ি-ছেনি ও ক্ষুদ্র যন্ত্রপাতির সাহায্যে অর্ধশিক্ষিত শ্রমিকরা টিন, কাঠ আর হরেক রকমের নাট-বল্টু ব্যবহার করে নামিদামি কোম্পানির গাড়ির বডি তৈরি করে সুখ্যাতি কুড়িয়েছে যশোরের ওয়ার্কশপগুলো। নতুন বাস-ট্রাকের বডি তৈরি ছাড়াও পুরোনো বডি সংস্কার, রং, ওয়্যারিং ও ইঞ্জিন মেরামত কাজ হয় এখানে। স্বল্প খরচে ভালো সেবা দেওয়ার কারণে সারাদেশের বাস-ট্রাক মালিকরা আসেন যশোরের ওয়ার্কশপে।
যশোর শহরের বগচরের আল-একলাস হোল্ডিং ওয়ার্কশপের মালিক নুরুজ্জামান শেখ বলেন, যশোরের ওয়ার্কশপগুলোতে হাতুড়ি-ছেনি দিয়েই তৈরি করেন কোরিয়ান, জাপানি, ইন্ডিয়ান গাড়ির বডির আদলে বাস-ট্রাকের বডি ও কেবিন। শুধু চোখে দেখেই তাঁরা যে কোনো মডেলের বডিসহ অন্যান্য অংশ তৈরি করতে সক্ষম। পুরোনো জরাজীর্ণ গাড়ির চেসিসে নতুন করে সংযোজন করা বডি কমপক্ষে ৩০ থেকে ৪০ বছর পর্যন্ত টেকসই হয়। তিনি জানান, হিনো-টাটা, ভলভোর মতো অত্যাধুনিক ব্র্যান্ডের বাসের বডিসহ কাভার্ডভ্যান, পিকআপ ভ্যানসহ বিভিন্ন বডি, কেবিন তৈরি ও মেরামতে ঢাকার চেয়ে যশোরে খরচ অনেক কম। বর্তমানে একটি নতুন ট্রাকের পূর্ণাঙ্গ বডি তৈরি করতে খরচ হয় সাড়ে ৩ লাখ টাকা। বাসের ৯ থেকে ১০ লাখের মধ্যে। ঢাকা-চট্টগ্রামে একই বাস-ট্রাকের বডি তৈরিতে ৩ থেকে সাড়ে ৩ লাখ টাকা বেশি খরচ হয়।
যশোর অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি আশরাফুল আলম বলেন, যে কোনো জায়গার তুলনায় খরচ কম এবং কাজের মান ভালো হওয়ায় সারাদেশের বিভিন্ন এলাকার গাড়ি মালিকরা বডি তৈরি করতে যশোরে আসেন।
যশোর চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি মিজানুর রহমান খান জানান, আগে ক্ষুদ্র যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে গাড়ির চেসিস পর্যন্ত সবকিছু আসত ভারতসহ অন্যান্য দেশ থেকে। এখন অনেক যন্ত্রাংশই তৈরি হচ্ছে যশোরে। এতে একদিকে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হচ্ছে, অন্যদিকে বাড়ছে কর্মসংস্থানের সুযোগ। এ কার্যক্রম আরও গতিশীল করতে দক্ষ জনবল গড়ে তুলে আধুনিক মেশিনারিজ দিয়ে উৎপাদন করতে হবে। উদ্যোগ নিতে হবে রপ্তানিরও।
মোটর গাড়ির বডি ও পার্টস ছাড়াও যশোরে তৈরি হচ্ছে স্টোন মিনি ক্র্যাশার, ইটভাঙা, পাথরভাঙা মেশিন, ইস্পলার, প্রেশার পুলি, শ্যালো ইঞ্জিনের মেশিনসহ বিভিন্ন ধরনের মেশিনারিজ। যশোরের রিপন মেশিনারিজের স্বত্বাধিকারী আশরাফুল ইসলাম বাবু জানান, তাঁদের উৎপাদিত পাথরভাঙা মেশিন ভারতেও রপ্তানি হচ্ছে। অগ্রণী ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্বত্বাধিকারী শমসের আলী বলেন, তাঁদের তৈরি সরিষার তেল ভাঙানো মেশিন, বোতলজাতের জন্য ফিল্টার দেশের ৪০টি জেলায় বাজারজাত হচ্ছে।
বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প মালিক সমিতি যশোর জেলা শাখার সদস্য সিরাজ খান মিন্টু জানান, জেলায় ৩০০টির মতো হালকা ও ভারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে ২৫টি ভারী প্রতিষ্ঠান শিল্পপণ্য উৎপাদন করছে। প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাজ করেন ৫ হাজারেরও বেশি শ্রমিক। এ খাতে প্রতি মাসে কমপক্ষে ৮ কোটি টাকার ব্যবসা হয় প্রতিষ্ঠানগুলোর।
তবে যশোর জেলা অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক বাবুল আলম বাবুর মতে, করোনার কারণে গত দু'বছরে এ শিল্প-সংশ্নিষ্টদের অন্তত ২৫ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। ব্যাপক সম্ভাবনাময় এ শিল্পে সরকারিভাবে সহায়তা তো দূরের কথা, ব্যাংক ঋণ পর্যন্ত পান না ওয়ার্কশপ মালিকরা। এই শিল্পে সরকারি সহযোগিতা ও ব্যাংক ঋণ পেলে বছরে অন্তত ৫০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি সৃষ্টি হবে দুই লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ।
সংশ্নিষ্টরা জানান, প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে যশোরে মোটরগাড়ি মেরামতের কাজ দিয়ে এ খাতের শুরু। আশির দশকে হিনো গাড়ি আমদানি শুরু হওয়ার পর ব্যস্ততা বাড়তে থাকে এখানকার অটোমোবাইল ওয়ার্কশপগুলোর। এরপর ক্রমান্বয়ে বিকশিত হতে থাকে এ খাত। আশির দশকে বছরে সর্বোচ্চ এক হাজার গাড়ির বডি তৈরি ও পুনঃস্থাপন হতো। এখন তা বেড়ে ৮ থেকে ১০ হাজারে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবছর বাড়ছে স্পেয়ার পার্টসের উৎপাদনও।

আরও পড়ুন

×