উড়তে না জানা পাখিদের কথা

--
প্রকাশ: ২৯ জুলাই ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ২৯ জুলাই ২০২২ | ২৩:৪৩
আকাশে চিল, শালিক, কাক, বুলবুলি এমন অজস্র পাখিকে যেমন উড়তে দেখা যায়, তেমনি হাঁস-মুরগির মতো উড়তে না পারা পাখিও দেখা যায় আমাদের চারপাশে। তবে মুরগি এবং হাঁস সামান্য উড়তে পারলেও পৃথিবীতে এমন অনেক পাখি আছে, যারা একদমই উড়তে পারে না। উড্ডয়নের অভাবটুকু পূরণে তাদের রয়েছে অভিনব আয়োজন। এমনই সব পাখিদের বিচিত্র জীবনযাপন নিয়ে লিখেছেন মুনাম কবির
উড়তে পারার ক্ষমতা পাখির জন্য দরকারি হলেও এ জন্য পাখির প্রচুর পরিমাণ শক্তি খরচ করতে হয়। ফলে উড়তে পারা পাখিদের দেহের আকার সাধারণত ক্ষুদ্র হয়ে থাকে। কিন্তু যেসব পাখি উড়তে পারে না, তারা এই শক্তি দেহে জমা রেখে ডাঙায় বেঁচে থাকার কাজে খরচ করে। পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রায় ৬০ প্রজাতির উড়তে না পারা পাখির অনেকেই বৈরী পরিবেশে খাদ্যস্বল্পতার মাঝে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে। উড়তে না পারা পাখির তালিকায় রয়েছে- পেঙ্গুইন, উটপাখি, ইমু, ওয়েকা, ক্যাসোওয়ারিস, রিয়াস, গ্রেবেস প্রভৃতি পাখি।
উড়তে ভুলে যায় তারা
পাখির দেহের হাড় বেশ ফাঁপা এবং বায়ু দ্বারা পূর্ণ থাকে। এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে এরা আকাশে উড়তে পারে। আবহাওয়া পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অন্য এলাকায় ভ্রমণের জন্য, হিংস্র পশুর হাত থেকে প্রাণ বাঁচাতে, খাবারের সন্ধানে উড়ে যাওয়ার জন্য পাখির উড়তে পারার বিষয়টি খুবই সহায়ক। ওজনে হালকা হওয়ার জন্য হেঁটে দূর-দূরান্তে ভ্রমণ করার চেয়ে উড়ে যাওয়ায় বেশি সুবিধা হয় পাখিদের। বিজ্ঞানীদের ধারণা, পাখিদের যদি ওড়ার কোনো প্রয়োজন না থাকে, তাহলে তারা উড়বে না- এই বৈশিষ্ট্য থেকে তারা উড়তে ভুলে যায়।
পাখির উড়তে পারা অনেক বিষয়ের ওপর নির্ভর করে থাকে। তবে এই উড়তে না পারা কিন্তু একদিনে তৈরি হয়নি। ধরুন কোনো একটি পাখি এমন অঞ্চলে বসবাস করে, সেখানে তাদের কোনো পশুর আক্রমণের মুখোমুখি পড়তে হয় না বা খাদ্যের অভাবও সেই অর্থে নেই। তাই এভাবেই ডানার চেয়ে হাঁটাই বেশি শ্রেয় বলে মনে করতে শুরু করল তারা। এভাবে বিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাওয়ার ফলে কোনো এক পাখির শরীরে গজাতে শুরু করল ভারী পালক। ডানা আরও সরু ও পাতলা হয়ে উঠল। ধীরে ধীরে ডানার ব্যবহার লোপ পেল, ফলে ওড়া বন্ধ হয়ে গেল সেসব পাখির।
বিজ্ঞানীদের ধারণা, অনেক পাখি কোনো নিরাপদ দ্বীপে প্রত্যাবর্তন করার পর তাদের উড়বার ক্ষমতা ত্যাগ করেছে। যদি দ্বীপে কোনো শিকারি পশু না থাকে এবং এর আবহাওয়া স্থিতিশীল থাকে, সে ক্ষেত্রে একই স্থানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম কাটিয়ে দিতে পারে এসব পাখি। তবে সব পাখির আবির্ভাব একরকম নয়। উড়তে না পারা পাখিদের দেহ কিছুটা ভারী হয়ে থাকে। অনেক সময় এরা আকারে বেশ বড় হতে পারে।
পাখিদের যদি ওড়ার কোনো প্রয়োজন না থাকে, তাহলে তারা উড়বে না। এমন বৈশিষ্ট্য থেকে শুরু হয় এদের না উড়বার যাত্রা। যেমন- ইমু পাখিটির কথাই ধরা যাক। ইমু এমন অঞ্চলে বসবাস করে, যেখানে তাকে কোনো শিকারি পশু আক্রমণ করে না। আশপাশে খাদ্যের অভাব নেই। তাই সে ওড়াওড়ি কমিয়ে দিল। এভাবে কয়েক প্রজন্ম পর্যন্ত ইমু পাখিরা উড়ল না। এর মাধ্যমে ইমু পাখির সদস্যদের মাঝে কম ওড়ার একটি প্রবণতা সৃষ্টি হলো। দেখা গেল, যেসব ইমু পাখি জন্ম নিল, তারা কয়েক প্রজন্ম আগের উড়তে পারা পাখিদের চেয়ে একদম আলাদা হয়ে উঠল। উল্লেখযোগ্য কিছু পাখির বৈশিষ্ট্য তুলে ধরলে বিষয়টি স্পষ্ট হয়।
পেঙ্গুইন
আমাদের তালিকা শুরু হলো অ্যান্টার্কটিকার শীতল পরিবেশে বসবাস করা পেঙ্গুইনের মাধ্যমে। প্রায় ১৮ প্রজাতির পেঙ্গুইন রয়েছে এবং এদের কেউই উড়তে পারে না। তবে এদের পাখা রয়েছে, যা সাঁতার কাটার জন্য মোক্ষম অঙ্গ হিসেবে কাজে দেয়। একটি পেঙ্গুইন তার জীবনের বড় একটা সময় সাঁতার কেটে কাটিয়ে দেয়। অ্যান্টার্কটিকা ছাড়াও এরা গ্যালাপাগোস দ্বীপ অঞ্চলে বসবাস করে। এরা লম্বায় মাত্র ৪ ফুটের মতো হয়। সরু এবং ক্ষুদ্র পায়ের সাহায্যে এরা বেশ নান্দনিকভাবে হেঁটে বেড়ায়। এরা মাছ, ক্রিল এবং স্কুইড জাতীয় প্রাণীর ওপর জীবন ধারণের জন্য নির্ভরশীল।
অস্ট্রিচ
শুধু উড়তে না পারা নয়, সকল পাখির সর্দার ধরা হয় এই শক্তিশালী অস্ট্রিচ বা উটপাখিকে। উড়তে না পারা এই পাখিদের প্রধান প্রতিরক্ষা অস্ত্র এদের পা। এই শক্ত পায়ের সাহায্যে এরা বেশ দ্রুত দৌড়াতে পারে। এদের গতিবেগ ঘণ্টায় প্রায় ৭৩ কিলোমিটার। শত্রুর মুখোমুখি হলে এরা পায়ের সাহায্যে আঘাত করতে পারে। উটপাখির প্রধান বাসস্থান আফ্রিকা। আফ্রিকার উন্মুক্ত ভূমিতে এরা স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করতে পারে। এ ছাড়া দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার কিছু অঞ্চলে খুব অল্প সংখ্যক উটপাখি পাওয়া যায়।
কিউই
পাঁচটি ভিন্ন প্রজাতির সমন্বয়ে গঠিত কিউই পাখির জাত। কিউই দেখতে বেশ নাদুসনুদুস একটি পাখি। এর প্রধান আবাসস্থল নিউজিল্যান্ড। এদের নামের সঙ্গে মিলিয়ে নিউজিল্যান্ডের স্থানীয়দের 'কিউই' নামে ডাকা হয়। এদের লুকানো পাখা রয়েছে, যেখানে চুলের মতো বেশ হালকা পালক রয়েছে। এদের পাখা অনেক ছোট হওয়ায় পাখি উড়তে পারে না। কিউইদের নাসারল্প্রেব্দর অবস্থান এদের সরু ঠোঁটের শীর্ষে। কিউই দেখতে বেশ আদুরে একটি পাখি। এ কারণে পর্যটকদের কাছে এই পাখি অন্যতম আকর্ষণীয় প্রাণী। ১৮ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হতে পারে কিউই। ওজন হয় সাড়ে তিন কেজি পর্যন্ত। এই পাখিদের ডিমের ওজন প্রায় ১ পাউন্ড। কিউই পাখির ডিম তুলনামূলক ছোট হলেও, দেহের বিচারে ডিমের আকার বেশ বড়।
ওয়েকা
ওয়েকার জন্মস্থান নিউজিল্যান্ডে। শুধু জন্মস্থানেই নয়, ওয়েকার দেখা মেলে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। পাখিটির আকৃতি ছোট মুরগির মতো। গায়ের রঙে বাদামি ও কালোর মিশ্রণ। প্রথম দেখে যে কেউ একে মুরগি ভেবে ভুল করতে পারেন। তবে আকার যেমনই হোক না কেন, ওয়েকার সবচেয়ে অভিনব বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর জোরালো ও কর্কশ কণ্ঠস্বর। ছোট পাখি ও উড়তে পারে না বলে পাখি প্রজাতিতে এর বিশেষ সমাদর রয়েছে। অন্যের খাদ্য চুরিতে এরা ওস্তাদ। মাঝে মাঝে এরা ঘরবাড়ির ফেলে দেওয়া ছোটখাটো বস্তু ঠোঁটে নিয়ে চলে আসে। আকাশে ওড়ার ক্ষমতা না থাকলেও এই পাখি কিন্তু চৌকস সাঁতারু। এদের প্রধান খাবার অমেরুদণ্ডী ছোট প্রাণী ও নানা ধরনের ফল। সাধারণত আগস্ট থেকে জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে তারা ডিম পাড়ে। ওয়েকা মাওরি শব্দ।
স্টিমার হাঁস
পাখা আছে, কিন্তু উড়তে পারে না এই তালিকায় আরও রয়েছে স্টিমার হাঁসের নাম। এই হাঁসের দেখা মেলে লাতিন আমেরিকায়। স্টিমার হাঁসের চার প্রজাতির মধ্যে তিন প্রজাতি উড়তে পারে না। অথচ ওড়ার জন্য যথেষ্ট পালক এদের রয়েছে। না উড়তে পারার কারণ হচ্ছে, হাঁসদের অতিরিক্ত ওজন। প্রজাতিভেদে এরা চার থেকে পাঁচ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। ওজন অনুযায়ী এদের ডানার দৈর্ঘ্য কম হয় বলে ভালো করে উড়তে পারে না। এই হাঁসদের নামের সঙ্গে যুক্ত আছে জলযান স্টিমারের নাম। এর কারণ, এরা যখন পানি দিয়ে দ্রুত ছুটে যায়, তখন এরা স্টিমারের মতো পানি ছিটিয়ে দেয়। দূর থেকে দেখে মনে হয়, পানির ওপর দিয়ে হাঁসেরা সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে। উড়তে না পারলেও এদের ডানা বেশ শক্তিশালী হয়। দেখতে হাঁসের মতো নিরীহ হলেও বাস্তবে খুবই আগ্রাসী স্বভাবের হয়ে থাকে স্টিমার হাঁস। নিজের জায়গা ভাগাভাগি নিয়ে এরা প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে মুখোমুখি লড়াইয়ে মেতে ওঠে।
ক্যাসোওয়ারিস
ক্যাসোওয়ারিস পাখি একটু দস্যি ধরনের। পাপুয়া নিউগিনি অঞ্চলে বাস করা এই পাখি উড়তে না পারলেও অন্য পাখিদের ভয় দেখিয়ে উড়িয়ে দিতে ভালোবাসে। এদের গোপন অস্ত্র হিসেবে রয়েছে প্রায় ৪ ইঞ্চি লম্বা ধারালো নখর। এই ভয়ংকর পাখি সর্বভুক বৈশিষ্ট্যের। ফলমূল, লতাপাতার বাইরে পোকামাকড় খেয়ে এরা জীবনধারণ করে। ওজন ও আকারের বিচারে এদের অবস্থান উটপাখির ঠিক পরেই। এরা স্থলে বেশ দাপটের সঙ্গে পদচারণা করে। যদি ডাঙায় বসেই রাজত্ব করা যায়, তাহলে আর আকাশে উড়ে বেড়ানোর প্রয়োজন কী?
- বিষয় :
- পাখি