ঐতিহ্য
গ্রামীণ ঐতিহ্য 'চাঁই'

মোহাম্মদ মহসীন
প্রকাশ: ২৯ জুলাই ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ২৯ জুলাই ২০২২ | ২৩:৪৬
যে গ্রামটিতে যোগেশ চন্দ্র দাস বংশপরম্পরায় বসবাস করেন, তার নাম সাহাপুর। গ্রামের পাশ ধরেই হাঁটছিলাম। তখনই স্কুলজীবনের বন্ধু যোগেশের সঙ্গে দেখা। সেও হাসি দিয়ে তড়িঘড়ি করে বসতে দেয়। কথার ছলে খোঁজ-খবর নিই। সে বলতে লাগল জীবন নামের গল্প। বাবা ভাসানী চন্দ্র দাস কর্মক্ষমতা হারানোর সময় সে হাইস্কুলে পড়ত।
তারা ছয় ভাই, দুই বোন। সংসারের টানাপোড়েনে এসএসসি পরীক্ষা না দিয়ে অর্থ উপার্জনে পারি দেয় দক্ষিণ কোরিয়া। যোগেশ টাকা কামাই করে বড় ভাইদের কাছে পাঠিয়েছিলেন। বিদেশ বিভুঁইয়ে শরীরের চামড়া যখন কুঁচকে যায়, তখন বাড়িতে ফিরে টাকার হিসাব চান। ভাই-বোনরা তখন সুকুমার রায়ের কবিতার একটি পঙ্ক্তি মতো জানিয়ে দেন- 'সারা জীবন মরলিরে তুই খাটি/ জ্ঞান বিনা তোর জীবনটা যে চারি আনাই মাটি।' এরপর পেছনে না ফিরে বংশের রেওয়াজ ধরে জীবিকা নির্বাহ শুরু করেন যোগেশ। একটি প্রবাদ আছে- 'ভাইয়ের শত্রু ভাই, মাছের শত্রু চাঁই।' চাঁই তৈরির কারখানা দেন। এরপর বিয়ে। যোগেশের দুই ছেলে; বড় ছেলে লোক চন্দ্র দাস অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে আর ছোট্ট ছেলে পুরঞ্জন দাস দ্বিতীয় শ্রেণিতে। ঝুপড়ি ঘরে চারজনের জীবন কাটছে কোনো রকমে।
সোনারগাঁ পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ডের সাহাপুর গ্রামের দেড় শতাধিক পরিবারের শত বছরের পুরোনো পেশা মাছ ধরার চাঁই। এটি বাঁশের চিকন শলাকা, বানা দিয়ে তৈরি করা হস্তশিল্প, যা মাছ ধরার ফাঁদ। গ্রামের পুরোনো ঐতিহ্য চাঁই তৈরি করেই শত শত বছর ধরে বংশানুক্রমে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করতে দেখা যেত। পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে আজ তা বিলুপ্তির পথে। আষাঢ় থেকে বর্ষা মৌসুমে তাদের ব্যবসা খানিক ভালো চলে। বর্ষায় টইটম্বুর না থাকলেও বাকি মাস কয়টা অভাব-অনটনেই কাটে। যোগেশের মতো অন্যদেরও সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। যোগেশ জানান, পরিশ্রমের তুলনায় আয় নেই, খরচ বেশি। তাঁর দশজন কারিগর। একটি চাঁই একজনে তৈরি করলে ৫০ টাকা মজুরি দিতে হয়। বানা তৈরিতে ১০ টাকা, চান্দা ৫ টাকা, ফিটিং ১০ টাকা, প্লাস্টিকের সুতার দাম কেজিপ্রতি আড়াই'শ টাকা। একটি চাঁই বিক্রি হয় মাত্র ৮০ টাকা। এই কারণে বাপ-দাদার পুরোনো পেশা আঁকড়ে ধরে রাখা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বর্ষা এলেই দূরের ও কাছের পাইকাররা চাঁইয়ের জন্য ভিড় জমাতেন, প্রাচীন বাংলার রাজধানী সোনারগাঁয়ে যার খ্যাতি-যশ আজও আছে। কিন্তু এই অঞ্চলের মেঘনা ছাড়া বাকি বিভিন্ন খাল-বিল, ঝিল, নদী-নালা, ধানের জমিতে সরবে-নীরবে কারখানার বিষাক্ত কালো পানিতে সয়লাব। মাছ ধরার মতো পরিবেশও নেই।
সাহাপুর গ্রামের হিন্দুপট্টিতে বর্ষা মৌসুমে নারী-পুরুষ ও উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়ের বাঁশের তৈরি মাছ ধরার চাঁই বানানোর ব্যস্ততা অনেক বেড়ে যেত। তবে এ বছর চাঁইয়ের চাহিদা তেমন একটা দেখা যাচ্ছে না। জলাশয় ভরাট ও পানি দূষণের কারণে পরিবেশের ভারসাম্যহীনতার ফলে মাছ উৎপাদন বিপন্ন হয়েছে ও হচ্ছে।
যোগেশ কাতর কণ্ঠে বলেন, 'বাড়ি ছাড়াও আনন্দবাজার, কাইকারটেক হাটে চাঁইয়ের আমদানির তুলনায় বেচাকেনা কম। বর্তমানে দেশীয় চাঁইয়ের চেয়ে ভিনদেশি চায়না চাঁইয়ের ব্যাপক চাহিদা হাটবাজারে।'
এই হস্তশিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারি-বেসরকারি অর্থ সহযোগিতা ও স্বল্প সুদে ঋণ প্রদানের জন্য তাঁরা আকুলতা প্রকাশ করেন। সহযোগিতা পেলে হয়তো এই পেশা রক্ষা করা যেতে পারে। তা না হলে জীবিকা নির্বাহের জন্য অন্য কাজ ছাড়া কোনো গতি থাকবে না তাঁদের।
- বিষয় :
- ঐতিহ্য