ঢাকা রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫

নাক-কান-গলার ক্যান্সার

নাক-কান-গলার ক্যান্সার

ডা. মো. আব্দুল হাফিজ শাফী

প্রকাশ: ২৯ জুলাই ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ২৯ জুলাই ২০২২ | ২৩:৫০

মাথার খুলি, মুখের অঞ্চল ও গলার ভেতরে অনেক স্ট্রাকচার বা অঙ্গ আছে। যেমন-
নাক, সাইনাস, নাকের পেছনে ন্যাসোফ্যারিংস, মুখ, মুখগহ্বর, জিহ্বা, গলার টনসিল, শ্বাসনালি, খাদ্যনালি, থাইরয়েড গ্রন্থি, লালা গ্রন্থির সমষ্টিগত ক্যান্সারকে হেড-নেক ক্যান্সার বলা হয়। আমাদের গলার ভেতরের দিক একটা আবরণে আবৃত থাকে, যেটাকে আমরা মিউকাস মেমব্রেন বলি। এই মিউকাস মেমব্রেনের আবরণে ক্যান্সার বেশি হয় এবং যেটাকে আমরা চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায়  Squamous Cell  ক্যান্সার বলে থাকি। তবে একে বিশেষজ্ঞরা প্রতিরোধযোগ্য ঘাতক ব্যাধি নামে আখ্যায়িত করেন। যদি প্রাথমিক অবস্থায় রোগ নির্ণয় করা যায় তাহলে সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা দ্বিগুণ।

নাক-কান-গলার ক্যান্সারের কারণ
- তামাক ও মদ্যপান মূল কারণ বিবেচ্য হলেও, আমাদের দেশের জন্য পান-সুপারি-জর্দা অনেকাংশে দায়ী।
- অতিরিক্ত রেডিয়েশনের সংস্পর্শে আসার ইতিহাস।
-সুপারি চিবানোর অভ্যাস/ দীর্ঘক্ষণ সুপারি গালের চিপায় রেখে চিবানো থেকে এ ধরনের ক্যান্সার হতে পারে।
- অতিরিক্ত ঝাল ও মসলা জাতীয় খাবার নিয়মিতভাবে খাওয়ার অভ্যাস থেকে হতে পারে মুখ ও মুখগহ্বরের ক্যান্সার।
-হিউম্যান প্যাপিলমা ভাইরাস (HPV-16) নামে এক ধরনের ভাইরাসের সংক্রমণকে ইদানীং ওরোফ্যারেনজিয়াল ক্যান্সারের জন্য দায়ী বলে ধরা হচ্ছে। এই ভাইরাস গলা ছাড়াও নারীদের জরায়ু ক্যান্সারের কারণ হতে পারে।
- এ ছাড়া কিছু নির্দিষ্ট প্যাকেটজাত লবণাক্ত খাবার এবং যাঁরা বিভিন্ন ফার্নিচার কারখানায় কাঠ ও রঙের কাজ করেন, তাঁদের ক্ষেত্রে নাক ও নাকের পেছনে ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
-জেনেটিকস বা বংশগত কারণ থেকেও হতে পারে, তবে খুব কম।
-  Gastro oesophsgul Reflex Disorder (GERD অর্থাৎ অ্যাসিডিটি সমস্যা থেকে খাবার পাকস্থলী থেকে বেরিয়ে আসার রোগে দীর্ঘদিন ভুগলে গলায় ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
- সবুজ শাকসবজি ও ভিটামিন সি-যুক্ত পুষ্টিকর খাবার নিয়মিত পর্যাপ্ত পরিমাণে গ্রহণ না করলে।
-মুখের ভেতর অপরিস্কার রাখলে এবং দাঁতের ক্রনিক ইনফেকশন।
- নারীদের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন রক্তশূন্যতায় ভুগলে।

 উপসর্গ কী
সাধারণত ৬০ শতাংশ রোগী অ্যাডভান্স স্টেজে ডাক্তারের কাছে আসে। বিলম্বে আসার প্রধান কারণ হলো- অসচেতনতা, অবহেলা, রোগের ভয়াবহতা সম্পর্কে অবহিত না থাকা এবং অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা। প্রথমে এই রোগীরা কবিরাজ, হোমিওপ্যাথি ইত্যাদি চিকিৎসা নিয়ে রোগ সারানোর চেষ্টা করে। দেখা যায়, যাকে সামান্য টিউমার ভেবে গুরুত্ব দেয়নি, সেটিই বহুদিন ধরে বয়ে চলেছে প্রাণঘাতী ক্যান্সারের জীবাণু। কারণ এটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ব্যথাহীন। এতে সামান্য কিছু শারীরিক পরিবর্তন দেখা যায়, যা প্রায়ই উপেক্ষা করা হয়। তাই রোগীরা দেরি করে আসে। এই ক্যান্সারের সাধারণ উপসর্গ বা লক্ষণ-
- মুখ ও গলার ভেতর বা বাইরে ঘা/ ক্ষত/ আলসার, যা প্রাথমিক চিকিৎসা সত্ত্বেও সহজে শুকায় না; বরং দিন দিন বেড়ে যায়। এই ক্ষতের কারণে খাবার চিবোতে বা গিলতে কষ্ট হয় এবং জলপান করতেও অসুবিধা হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে মনে হয়, গলায় কিছু আটকে আছে।
- গলা বা হেড-নেক আক্রান্ত অঞ্চলে ফোলা ভাব, অর্থাৎ লাম্প, যাকে টিউমার বলে থাকি। মুখ, গলা ও ঘাড়ের পেছনে ফোলা।
-একপাশে গলাব্যথা, এতে স্বাভাবিক খাবার গ্রহণ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়।
- জিহ্বা নাড়াতে অসুবিধা।
- দাঁত নড়ে যাওয়া বা দাঁতে ব্যথা ও ফোলা।
- এই অঞ্চলের টিউমারের সঙ্গে কানে ব্যথা। এ ক্ষেত্রে কানে কোনো সমস্যা নেই। গলার ক্যান্সারের কারণে কানে ব্যথা হয়।
- কর্কশ কণ্ঠ। অর্থাৎ কোনো কোনো সময় গলার স্বরভঙ্গ নিয়েও রোগী আসতে পারে। তবে স্বরভঙ্গ হলেই যে ক্যান্সার, এটি মনে করে আতঙ্কিত হওয়া নয়। কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন বা গলাভাঙা যে কোনো কারণে হতে পারে। প্রাথমিক ওষুধ খাওয়ার পরও তিন সপ্তাহের অধিক স্বরভঙ্গ থাকলে সে ক্ষেত্রে অবশ্যই দেরি না করে নাক-কান-গলা ও হেড-নেক বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে। এই গলাভাঙা থেকে হঠাৎ শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়।
- অস্বাভাবিকভাবে ওজন হ্রাস; সঙ্গে অরুচি ও ক্ষুধামান্দ্য।
- জিহ্বা অথবা মুখের ভেতরের উপরিত্বকে সাদা-লাল ছোপ।
-নাকের ক্যান্সারের ক্ষেত্রে নাক দিয়ে রক্ত আসা। হঠাৎ মুখের গঠনগত পরিবর্তন।
- মুখ দিয়ে অস্বাভাবিক রক্তপাত। কাশির সঙ্গে রক্ত।
- চোয়াল শক্ত হয়ে যাওয়া এবং মুখ খুলতে অসুবিধা।
-থাইরয়েড গ্রন্থি যেটা গলার সামনের দিকে থাকে, সেটা দীর্ঘদিন ফুলে শক্ত হয়ে থাকা। অনেক সময় এই থাইরয়েড গ্রন্থি ফোলার সঙ্গে গলার কণ্ঠস্বর ভেঙে যেতে পারে।
- মুখের উভয় পাশে কানের ঠিক নিচে যে লালা গ্রন্থি আছে, সেটা ধীরে ধীরে বড় হয়ে শক্ত হয়ে যদি মুখ বেঁকে যায় এবং সঙ্গে এই লালা গ্রন্থির ফোলায় ব্যথা থাকতে পারে।
এসব লক্ষণ দেখা দিলে অবশ্যই দেরি করা নয়। নাক-কান-গলা ও হেড-নেক ক্যান্সারের সুচিকিৎসা আমাদের দেশেই সম্ভব।

 চিকিৎসা পদ্ধতি
ক্যান্সার চিকিৎসায় সার্জারি, রেডিওথেরাপি, কেমোথেরাপি, টারগেটেড থেরাপি ও কম্ব্বাইন্ড থেরাপি প্রচলিত এবং এসবের ফলে ক্যান্সারমুক্তির হার দিন দিন বাড়ছে। জনসচেতনতা ও চিকিৎসা পদ্ধতির প্রসারই এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তার পরও যে হারে ক্যান্সার বাড়ছে, সে তুলনায় আমাদের দেশে চিকিৎসা সুবিধা অপ্রতুল। অবশ্য খুশির খবর হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী সব বিভাগীয় হাসপাতালে ক্যান্সার হাসপাতাল স্থাপনের যুগোপযোগী প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞ সার্জন দেখিয়ে ক্যান্সার ধরা পড়লে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসা করানো উচিত।

চিকিৎসা পদ্ধতি নির্বাচন বিভিন্ন বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। ক্যান্সারের ধরন ও পর্যায়, টিউমারের অবস্থা সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং রোগীর সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যের অবস্থার ওপর নির্ভর করে। হেড-নেক ক্যান্সারের চিকিৎসা রোগ এবং রোগীর ফ্যাক্টর বিবেচনা করে নিল্ফেম্ন লেখা এক বা একাধিক প্রক্রিয়ায় করা হতে পারে-

সার্জারি/অপারেশন: প্রাথমিক টিউমারের অস্ত্রোপচার, যেমন- জিহ্বার ক্যান্সার ক্ষত অপসারণ (গ্লসেকটমি) চোয়ালের আক্রান্ত একটি অংশের অপসারণ (ম্যানডিবুল্যাকটমি)/ মুখের শক্ত উপরিতলের একটি বা সমগ্র অংশের অপসারণ (ম্যাক্সিল্যাকটমি)/ ঘাড়ের ব্যবচ্ছেদ এবং আংশিক বা গোটা ল্যারিংক্স বা স্বরযন্ত্রের অপসারণ (ল্যারিংজ্যাকটমি)/ ঘাড়ের গোটা অপসারণ (নেক ডিসেকশন)/ ক্যান্সার আক্রান্ত থাইরয়েড গ্রন্থির টিউমার অপসারণ (থাইরয়েডেকটমি)/ ক্যান্সার আক্রান্ত লালা গ্রন্থি প্যারোটিড টিউমারের অপসারণ (প্যারোটিডেক্টমি) করেন আমাদের শ্রদ্ধেয় ইএনটি ও হেড-নেক ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ সার্জনরা।

রেডিওথেরাপি: বহিরাগত বিম রেডিয়েশন বা আভা বিকিরণ ও অভ্যন্তরীণ রেডিয়েশন বা বিকিরণ থেরাপি মিলে রেডিয়েশন থেরাপি সৃষ্টি হয়। রেডিওথেরাপি নিয়ে সমাজে ভ্রান্ত ধারণা আছে। অনেকে মনে করেন, রেডিওথেরাপিতে ইলেকট্রিক শক দেওয়া হয়। এটা পুরোপুরি ভুল ধারণা। আসলে এক্স-রেতে যেভাবে রেডিয়েশন দেওয়া হয়, তেমনি রেডিওথেরাপিতে নির্দিষ্ট ক্যান্সার আক্রান্ত স্থানে বিকিরণ দেওয়া হয়।
- কেমোথেরাপি দেওয়া যেতে পারে বিশেষ ক্ষেত্রে।
- অ্যাডভান্সড ক্ষেত্রে মিলিতভাবে সার্জারি ও রেডিওথেরাপি।

 ক্যান্সারের চিকিৎসায় প্রায়ই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। তাই বলে আতঙ্কিত না হয়ে ক্যান্সার মোকাবিলার জন্য আল্লাহর ওপর ভরসা করে দ্রুত চিকিৎসা শুরু করে দিতে হবে। কারণ আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের যুগে সব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সমাধান রয়েছে। ভয়কে করতে হবে জয়। রোগীকে চিকিৎসার ব্যাপারে আগ্রহী হতে হবে। থাকতে হবে ইচ্ছাশক্তি।

 [রেজিস্ট্রার, নাক-কান-গলা বিভাগ, সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সিলেট]

আরও পড়ুন

×