'রাজনেত্র' পুরাণ থেকে সমকালে নাট্যভ্রমণ
-samakal-6306ee48bf019.jpg)
'রাজনেত্র' নাটকের দৃশ্য
সুদীপ চক্রবর্তী
প্রকাশ: ২৪ আগস্ট ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ২৪ আগস্ট ২০২২ | ২১:৩৬
ব্যসদেব বিরচিত 'মহাভারত', রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'রক্তকরবী' এবং উইলিয়াম শেকসপিয়রের 'ম্যাকবেথ'-এর রাজনৈতিক অন্তর্বস্তু মিলিত হয়েছে হারুন রশীদের 'রাজনেত্র' নাট্যের বিন্যস্ত ঘটনাবলির মধ্য দিয়ে। 'রাজনেত্র' ক্ষমতা কাঠামোর বহুরূপী ও বহুস্তরায়িত আগ্রাসনের প্রতি মুহুর্মুহু প্রশ্নবাণ ছুড়ে দিয়ে দর্শকদের ব্যস্ত রাখে, চিন্তার খোরাক জোগায়। নাটকের গল্পে দেখা যায়, এক অত্যাচারী এবং ভোগী রাজার আমত্য এবং পারিষদরা রাজার চোখে পরিয়ে দিয়েছে এক রাজ উপনেত্র। ওই উপনেত্র পরেই প্রজাদের দেখেন রাজা। এক সময় রাজার বোধোদয় হয়- রাজ উপনেত্র তাঁকে প্রজাদের আসল অবস্থা দেখতে দেয় না।
রাজা এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে চান। খালি চোখে দেখতে চান রাজ্যকে, রাজ্যের মানুষকে। প্রধান পার্ষদ তাঁকে সাবধান করে- খালি চোখে প্রজাদের দেখলে রাজ্যহারা হবেন রাজা। রাজা অনুভব করেন- যখনই তিনি রাজ্যের উন্নতি, প্রজাদের কল্যাণ ভাবনায় নিজেকে নিয়োজিত করতে চান, তখনই ইন্দ্রিয়সুখে মোহগ্রস্ত করে রাখা হয় তাঁকে। নিরাপত্তার অজুহাতে তাঁকে যেতে দেওয়া হয় না রাজপ্রাসাদের বাইরে। কার্যত বন্দি করে রাখা হয় তাঁকে। রাজাকে প্রাসাদ প্রাচীরে স্থিত করতে চক্রান্ত করে প্রান্তিক নারী বিশাখার সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয় রাজার। বিশাখা রাজাকে বুঝতে চেষ্টা করেন। রাজা তাঁর কাছে জীবনের স্বাভাবিকতা দেখার আর নিজের চোখ দিয়ে প্রজাদের দেখার আকুতি জানান। বিশাখা রাজার প্রতি মমতার হাত বাড়িয়ে দেন। বিশাখার হাতে হাত রেখে রাজা চলে যান প্রকৃতির কাছে, মানুষের কাছে। রাজ উপনেত্র ছাড়া রাজার জনপদে যাওয়া এবং খালি চোখে মানুষকে দেখা মেনে নেয় না রাজার আমত্য এবং পারিষদরা। তাই অনিবার্য হয়ে পড়ে রাজার চূড়ান্ত প্রস্থান। রাজার স্থলাভিষিক্ত হন নতুন রাজা। রাজ্য ফিরে পায় তার শক্তি, গতি, শাসন, ত্রাসন আর পীড়নের প্রাচীন বৈশিষ্ট্য।
ক্ষমতার মোহরূপী একটা চশমা- নাট্যকারের মতে 'শাসনের উপনেত্র' চোখে না দিলে যে রাজা মানবিক থাকেন, সে রাজাই চশমাখানা চোখে দেওয়া মাত্রই রূঢ় ও অমানবিক হয়ে ওঠেন। এমন ঘটনা বিন্যাসে নাটক তার লক্ষ্যে অটুট থাকে কিনা- দর্শক মনে সেই প্রশ্ন জাগাটা অবান্তর নয় নিশ্চয়। কোথায় যেন 'আমাদের রাজা একজন ভালো লোক, কিন্তু তাঁকে ঘিরে থাকা বাকি লোকজন সবাই খারাপ' এমন বাণী প্রতিষ্ঠার একটা চেষ্টা সক্রিয় আছে এই নাটকে। তবে হ্যাঁ, ঘটনাপ্রবাহের বাঁকে বাঁকে এমন সব সংলাপ শোনা যায় যা ক্ষমতা কাঠামোর চিরায়ত অনমনীয় অবস্থানকে অস্থিতিশীল করে তোলে।
হারুন রশীদ নিজেই নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছেন। নাটকে নৃত্য, গীত, দেহবিন্যাস ও দৃশ্য পরিবর্তন যেন ঘটনাপ্রবাহে একীভূত হয়, সেজন্য আরও মহড়া প্রয়োজন বলে মনে হচ্ছিল। অভিনয় আয়তনে অভিনেতাদের পারস্পরিক নৈকট্য ও দূরত্ব যে চরিত্রগুলোর মধ্যকার সম্পর্ক নির্ণয় করে দিতে সক্ষম, সে বিষয়টিতে নির্দেশকের আলোকপাত করা প্রয়োজন।
তবে আরণ্যকের নাটক দেখতে গেলে বারবার বিস্ময় জাগায় অভিনেতাদের প্রখর-স্বতঃস্ম্ফূর্ত-বুদ্ধিদীপ্ত অভিনয়। আরণ্যকের অভিনয় প্রশিক্ষণ ও প্রয়োগের ধারা সর্বজনবিদিত। 'রাজনেত্র' নাটকে অভিনেতাদের অভিনয় দর্শকদের প্লাবিত করেছে। তবে মঞ্চকুশীলবদের মধ্যে সূচনাকারী, ফারাবী, পাটরানী এবং বয়স্ক নারী চরিত্রে অভিনেতাদের অধিক অনুশীলন প্রয়োজন। এঁরা নাট্যঘটনাকে স্রোতস্বিনী করে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন।
নাটকের মঞ্চ পরিকল্পনা অসাধারণ ও তাৎপর্যপূর্ণ। এই দায়িত্ব পালন করেছেন বাংলাদেশের নগরায়তনিক নাট্যচর্চায় এক নিপুণ ডিজাইনার ফয়েজ জহির। যত্নের সঙ্গে গল্পানুগ আবহ সংগীত পরিকল্পনা করেছেন পরিমল মজুমদার এবং পোশাক পরিকল্পনা করেছেন এনাম তারা সাকি। একটা বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন, প্রায়ই বিভিন্ন দলের নাট্যাভিনয়ে চোখে পড়ে অভিনেতাদের পোশাকের এদিক-ওদিক থেকে সুতা ঝুলে ঝুলে পড়ছে। বিষয়টি যত্নের দাবি রাখে। একইভাবে যত্নের দাবি রাখে অভিনয় আয়তনে যথাসময়ে অভিনেতাদের আলোকিত করা।
এ কথাও বলা দরকার, বহুদিন ধরে ঢাকার শিল্পকলা একাডেমির প্রতিটি মিলনায়তনের এবং মহিলা সমিতির আলোক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চূড়ান্তভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। প্রতিটি নাট্য দলকে বাইরে থেকে লাইট ভাড়া করে আনতে হয়। আলোর উৎসগুলো নাটকজুড়ে হঠাৎ হঠাৎ স্বয়ংক্রিয়ভাবে জ্বলতে-নিভতে থাকে। ফলে অভিনেতা ও দর্শক উভয়ের মনোযোগে বিঘ্ন ঘটে। বেশি বিঘ্ন ঘটে তখন, যখন প্রথম সারিতে বসে এক দর্শক বা ফটোগ্রাফার নাটকজুড়ে সশব্দে (কখনও ফ্লাশ ব্যবহার করে) ছবি তুলতে থাকেন, আর এদিক-ওদিক মোবাইলের রিংটোন বাজতে থাকে! অধিক আশ্চর্যের বিষয়, মিলনায়তন ব্যবস্থাপনায় থাকা লোকজন কেউ এসে কোনো রূপ বাধাও দেন না। ফলে পুরো ব্যাপারটাই অপেশাদার দেখায়।
সর্বোপরি, নাটকে দর্শকদের অংশগ্রহণ যে অপরিসীম গুরুত্ব বহন করে, সেটা দর্শকদের বোঝানো দরকার। মিলনায়তনে প্রবেশের আগেই মোবাইল ও ক্যামেরা ব্যবহারের বিষয়টি দর্শকদের বোঝানোর দায়িত্ব আমাদেরই নিতে হবে। এবং দর্শকদের সহযোগিতা পাওয়া যাবে এটা আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। 'রাজনেত্র' নাটকের নিয়মিত প্রদর্শনী অব্যাহত থাকুক।